মতামত

‘অবিকল্প’ মোদির সামনে ‘নবজন্মের’ রাহুল : কী হবে ভারতের রাজনীতিতে

বছরের শেষে এভাবে হোঁচট খেতে হবে বিজেপি ভাবেনি। ২০২২ যেভাবে শুরু হয়েছিল, বিজয়রথ যেভাবে গড়গড়িয়ে এগোচ্ছিল, বছর শেষে সেই সুমধুর সমীরণ থমকে গেল। ‘দেবভূমি’ হিমাচল প্রদেশ বোঝাল নজরুল ইসলামের কথাই চিরসত্য, ‘চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়।’

শুধু দেবভূমি কেন? দিল্লিও তো বিজেপির থেকে মুখ ঘোরাল! গুজরাট ও হিমাচল প্রদেশের সঙ্গেই ভোট হলো দিল্লি পৌরসভার। বিজেপি ভেবেছিল, তিনটি পৌরসভা মিলিয়ে একটি করে ওয়ার্ডের সীমানাবিন্যাস ঘটিয়ে মোট আসন ২৭০ থেকে ২৫০ করে পৌরসভা দখলে রাখবে। ভারতের কোনো প্রধানমন্ত্রী কোনো দিন কোনো পৌরসভার ভোটে প্রচার করেননি! নরেন্দ্র মোদিকে নামিয়ে বিজেপি সেই রেকর্ডও গড়ল! তবু তীরে তরি ভিড়ল না।

অথচ বছরের গোড়ায় পাঁচটি রাজ্যে বিধানসভার ভোট হয়েছিল। উত্তর প্রদেশ, উত্তরাখন্ড, গোয়া ও মণিপুর দখলে বিজেপিকে বেগ পেতে হয়নি। পাঞ্জাব জয়ের আশা তারা করেনি। জেতেওনি। বছর শেষে গুজরাটে দাপট দেখালেও সব ভন্ডুল করে দিল হিমাচল প্রদেশ ও দিল্লি।

দুঃখ ঢাকতে চতুর্গুণ উৎসাহে তারা গুজরাট জয় উদ্‌যাপন করেছে। সেই ফাঁকে আসল কথাটা কবুল করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। এক সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছেন, সর্বভারতীয় স্তরে কংগ্রেসই তাঁদের প্রধান প্রতিপক্ষ। কিছুটা মান্যিগণ্যি ও সমীহ তাঁরা কংগ্রেসকেই করেন।

এই দুই দলের কাছে ২০২৩ কোন বার্তা বয়ে আনতে পারে, সেই আভাস ২০২২ কিছুটা স্পষ্ট করেছে। সাত বিধানসভা ভোটের মধ্যে পাঁচটিতে জেতা মোটেই চাট্টিখানি কথা নয়। যদিও প্রতিটি ভোট প্রমাণ করেছে বিজেপি কতটা মোদিনির্ভর। উত্তর প্রদেশ একমাত্র রাজ্য, যেখানে মোদির পাশে কিছুটা হলেও যোগী আদিত্যনাথের উপস্থিতি চোখ টেনেছে। অন্যত্র এক থেকে এক শ নরেন্দ্র মোদিই! উত্তরাখন্ড ও হিমাচল প্রদেশে তিনি তো বলেইছেন, জনতা যেন তাঁকেই ভরসা করেন। তাঁর ওপর আস্থা রাখেন। তাঁকেই যেন ভোট দেন। একই ছবি গুজরাটেও। তবু কেন হিমাচল প্রদেশ ও দিল্লির জনতা তাঁর ওপর ভরসা রাখল না, সেই উত্তর বিজেপিকে নতুন বছরে খুঁজতেই হবে। কারণ, ভবিষ্যতে তাদের চ্যালেঞ্জ আরও কঠিন।

কঠিন এই কারণে, নতুন বছরে মোট ৯টি রাজ্যে বিধানসভার ভোট। এগুলোর মধ্যে চার বড় রাজ্যে কংগ্রেস তাদের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী। এদের মধ্যে রাজস্থান ও ছত্তিশগড়ে কংগ্রেস ক্ষমতাসীন। মধ্যপ্রদেশ তারা হারিয়েছিল দলত্যাগের কারণে। সেখানে পাল্টা ছোবল মারতে কংগ্রেসের গোষ্ঠীপতিরা এখনো এককাট্টা। রাজস্থানের মতো বিভাজিত নয়। রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশে বিজেপিতেও গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব প্রবল। কর্ণাটকের শাসক হিসেবে তারা যত দুর্বল হচ্ছে, তত বেশি করে আঁকড়ে ধরছে কট্টর হিন্দুত্ববাদ ও মুসলমানবিরোধিতাকে।

‘ঘৃণার বাজারে ভালোবাসার দোকান’ খোলার যে ন্যারেটিভ রচনায় রাহুল পদযাত্রী, তা কঠিন লড়াই। দীর্ঘমেয়াদিও। নতুন বছরে ভোটভাগ্য সহায় হলে সেই লড়াই ক্ষুরধার হবে। অবশ্য কে না জানে, একমাত্র কংগ্রেসই পারে নিশ্চিত জয়ের মুখ থেকে অবিশ্বাস্য পরাজয় ছিনিয়ে নিতে!

দক্ষিণি এই রাজ্যে কংগ্রেসের দুই অধিপতি সিদ্ধারামাইয়া ও ডি কে শিবকুমারের মধ্যে মিল ভূমিপুত্র কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে ঘটাতে পারলে বিজেপির হালে পানি পাওয়া কঠিন। ওই রাজ্যে ভোট মে মাসে। চমক দেখাতে পারলে নভেম্বর–ডিসেম্বরে রাজস্থান, ছত্তিশগড় ও মধ্যপ্রদেশের ভোটে কংগ্রেসের পালে বাড়তি হাওয়া লাগবে।

দক্ষিণের অন্য রাজ্য তেলেঙ্গানায় জয়ের আশা দেখছে বিজেপি। তেলেঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতির বাড়া ভাতে ছাই পড়লে অঘটন গণ্য হবে না। ওই রাজ্যে অনেক দিন ধরেই কাঁঠালের ওপর মাছির মতো ভনভন করছে বিজেপি। নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহ প্রাণপাত করছেন। একদা শক্তিধর কংগ্রেস সেখানে নকড়াছকড়া। বাকি চার রাজ্যের মধ্যে ফেব্রুয়ারি–মার্চে ভোট হবে ত্রিপুরা, মেঘালয় ও নাগাল্যান্ডে, মিজোরামে বছর শেষে। উত্তর–পূর্বাঞ্চলীয় ভারতে বিজেপির দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা। তাঁর কারণেই বিজেপি এই তল্লাটে নিশ্চিন্ত।

এই ৯ রাজ্যের মোট লোকসভা আসন ১১৬টি। সাধারণত রাজ্যের শাসক দল লোকসভা ভোটে বাড়তি সুবিধা পায়। এটাই ভোটের পাটিগণিত। কিন্তু গত দুটি লোকসভা নির্বাচনে জনতা তাদের সচেতনতা ও বোধবুদ্ধির প্রমাণ রেখেছে। ২০১৮ সালের বিধানসভা ভোটে রাজস্থান, ছত্তিশগড় ও মধ্যপ্রদেশের জনতা শাসক হিসেবে কংগ্রেসকে পছন্দ করলেও পরের বছর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদিকে বেছেছিলেন। ওডিশায় একসঙ্গে ভোট হয়েছিল বিধানসভা ও লোকসভার।

সেখানেও জনতা রাজ্যে নবীন পট্টনায়ককে পছন্দ করলেও দিল্লিতে বেছে নিয়েছেন মোদিকে। এই রাজনৈতিক মানসিকতা ও সচেতনতা বিজেপির ভরসা ও শক্তি। মোদির কারণেই জনতা বুঝতে শিখেছে রাজ্যের রাজনৈতিক চালচিত্রের সঙ্গে কেন্দ্রের ক্যানভাসের তফাতটা কোথায়। দেশকে নেতৃত্বদানের ক্ষেত্রে নরেন্দ্র মোদি এখনো অবিকল্প। তাঁর বলয়ের ধারেকাছে কেউ নেই। দেশ–বিদেশের যাবতীয় জরিপেও এই সত্য উপস্থাপিত। ২০২৩ তো বটেই, ২০২৪ সালেও তাই মোদিই বিজেপির সেরা তুরুপের তাস।

নিজের তো বটেই, সরকারের ভাবমূর্তিও ঝকমকে করতে আগামী বছর অনেক সুযোগ মোদি পাবেন। ‘হিন্দু হৃদয় সম্রাট’–এর জন্য রয়েছে অযোধ্যার রামমন্দিরের উদ্বোধন। নিঃশব্দে আগুয়ান কাশী–মথুরার ‘শৃঙ্খলমুক্তি’ আন্দোলনও। লোকসভা ভোটের আগে শেষ পূর্ণাঙ্গ বাজেট রয়েছে জনমুখী চমকের জন্য। খয়রাতি রাজনীতির কঠোর সমালোচনা সত্ত্বেও ভোট জেতার তাড়নায় মোদিও অবতীর্ণ সেই খেলায়। আরও এক বছর ৮১ কোটি দরিদ্রকে বিনা পয়সায় রেশন দেওয়ার ঘোষণাও সেই লক্ষ্যে। ভোট–রাজনীতির সঙ্গে লড়াইয়ে আজ পর্যন্ত এ দেশে অর্থনীতি কখনো জেতেনি!

এর বাইরে রয়েছে ‘জি–২০’–এর সভাপতিত্ব। নতুন বছরের পুরোটাই কাটবে সেই উৎসবে। জম্মু–কাশ্মীরের ভোট ভালোয়–ভালোয় সাঙ্গ হলে সেটাও হবে মোদির পাগড়ির আরও এক ঝলমলে পালক। সর্বোপরি যদি তাঁর দৌত্যে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ থামায়, ‘বিশ্বগুরু’ মোদির কাছে তাহলে ২০২৪–এর হ্যাটট্রিক অবধারিত।

এতৎসত্ত্বেও কংগ্রেস বিজেপির গলার কাঁটা। বিজেপির বিজয়রথের সামনে কিছুটা ‘যদি’ ও ‘কিন্তু’ কংগ্রেসই হাজির করেছে।

পরিবারের বাইরে দলীয় সভাপতিত্ব অর্পণ ও ‘ভারত জোড়ো’ যাত্রা—এই দুই সিদ্ধান্ত আঁকড়ে কংগ্রেস শুরু করেছে তাদের নতুন পথচলা। সেই চরৈবেতিতে উৎসাহ জুগিয়েছে হিমাচল প্রদেশ। ২০১৮ সালের পর এই প্রথম কোনো রাজ্যজয়ের রেশ নিয়ে কংগ্রেস বছর শেষ করল। এই জয় ও ‘ভারত জোড়ো’ যাত্রা নতুন বছরে তাদের সঞ্জীবনী সুধা।

‘ভারত জোড়ো’ যাত্রা গত আট বছরে কংগ্রেসের একমাত্র দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি। এই যাত্রা কংগ্রেসকে চনমনে করে তুলেছে। রাহুল গান্ধীকেও মেলে ধরছে অন্য আলোয়। ‘ননসিরিয়াস’, ‘পার্টটাইম পলিটিশিয়ান’, ‘পাপ্পু’ তকমা ঘুচিয়ে এটা তাঁর নবজন্ম। প্রতিপক্ষ বাধ্য হচ্ছে তাঁর নবমূল্যায়নে। এই যাত্রা বিজেপির বিকল্প রাজনীতির আশ্রয় হবে কি না, তা বোঝা যাবে নতুন বছরে। বিজেপি কিছুটা চিন্তিত। কোভিডের দোহাই দিয়ে যাত্রা বন্ধের উদ্যোগ তারা এমনি এমনি নেয়নি।

‘ভারত জোড়ো’ যাত্রা কংগ্রেসকে কতটা উজ্জীবিত করবে, হৃত শক্তি কতটা ফেরাবে, রাহুলকে কতটা বিশ্বস্ত করে তুলে গ্রহযোগ্যতা বাড়াবে, তার ওপর নির্ভর করবে আগামী দিনের ভোট–রাজনীতি বিশ্বকাপ ফুটবল ফাইনালের মতো চিত্তাকর্ষক হবে কি না। ‘ঘৃণার বাজারে ভালোবাসার দোকান’ খোলার যে ন্যারেটিভ রচনায় রাহুল পদযাত্রী, তা কঠিন লড়াই। দীর্ঘমেয়াদিও। নতুন বছরে ভোটভাগ্য সহায় হলে সেই লড়াই ক্ষুরধার হবে। অবশ্য কে না জানে, একমাত্র কংগ্রেসই পারে নিশ্চিত জয়ের মুখ থেকে অবিশ্বাস্য পরাজয় ছিনিয়ে নিতে!

  • সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি