আনিসুল হকের কলাম

বাড়িগুলো বোমার মতো ফেটে পড়ছে কেন

৫ মার্চ সকালে আচমকা বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকার শিরিন ভবন। পাশের ভবনও এমন এমন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।
ছবি কৃতজ্ঞতা: মাহবুবুল আকরাম

সবকিছু ভেঙে পড়ে। ডব্লিউ বি ইয়েটস তাঁর ‘সেকেন্ড কামিং’ কবিতায় লিখেছিলেন—
‘সবকিছু ভেঙে পড়ে, কেন্দ্র আর ধরে রাখতে পারছে না।
স্রেফ নৈরাজ্য ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বিশ্বজুড়ে।
খুলে দেওয়া হয়েছে রক্তের জোয়ার।
সবখানে নিষ্পাপেরা ডুবে যাচ্ছে।
ভালোরা হতভম্ব, খারাপেরা আপ্রাণ সচেষ্ট।’

বাংলাদেশেও যেন এখন সবকিছু ভেঙে পড়ছে। কেন্দ্র আর কিছুই ধরে রাখতে পারছে না। আমাদের ঘরবাড়ি দালানগুলো একেকটা বারুদের ঘরে পরিণত হয়েছে। তারা একযোগে, একটার পর একটা বিস্ফোরিত হতে শুরু করেছে।

আমাদের কান্নার দাগ শুকাচ্ছে না। আমরা একটার জন্য শোক করব, প্রতিবাদ করব, তা করে ওঠার আগেই ঘটে যাচ্ছে অন্য আরেকটা দুর্ঘটনা। আমরা আগেরটা ভুলে যাচ্ছি। বর্তমানের দিকে তাকানোর আগেই আগামীর দুর্ঘটনা আমাদের উড়িয়ে নিচ্ছে, ভাসিয়ে নিচ্ছে, ভুলিয়ে নিচ্ছে।

পঞ্চগড়ে এতগুলো বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হলো, মানুষ খুন হলো, আমরা নির্বিকার। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে যাওয়ার পর নানা উদ্যোগের প্রস্তাব এল, নানা ব্যবস্থার সুপারিশ হলো, কিন্তু কিসের কী, আবারও সীতাকুণ্ডে অক্সিজেন কারখানায় ঘটল বিস্ফোরণ। ঘটনাস্থল থেকে আধা মাইল দূরের মানুষও শিকার হলো সেই বিস্ফোরণের। ঢাকার সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় একটা ভবন হঠাৎ বিস্ফোরিত হলো। মারা গেলেন অনেকে। অফিস করতে গিয়েছিলেন তাঁরা। আহত আরও অনেক।

সেটা কেন হলো, কী করণীয়—বুঝে ওঠার আগেই এবার ঢাকার সিদ্দিকবাজার এলাকায় বিস্ফোরিত হলো আরেকটা ভবন। ভয়াবহ মাত্রার সেই বিস্ফোরণ। আশপাশের ভবনগুলো পর্যন্ত ধ্বংসপ্রায়। কেন ঘটেছে? উভয় ভবনের ক্ষেত্রেই কারণ সম্পর্কে প্রাথমিকভাবে বলা হয়েছে, জমে থাকা গ্যাসে হঠাৎ অগ্নিসংযোগ ঘটার কারণে এই বিস্ফোরণ।

পয়ঃপ্রণালি থেকে কি বিস্ফোরক গ্যাস জমতে পারে? হ্যাঁ। পারে। আমাদের সুয়ারেজ সুড়ঙ্গে, কূপে, ট্যাংকে মিথেন গ্যাস ও হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাস থাকে। এ গ্যাস যদি বদ্ধ ঘরে এসে দিনের পর দিন জমে, তাহলে তা বিপজ্জনক বিস্ফোরণের কারণ হতে পারে। দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালানো বা বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট—যেকোনো উপায়ে আগুন জ্বলামাত্র ওই ঘর বিস্ফোরিত হবে। ২০২১ সালের ১৯ ডিসেম্বর পাকিস্তানের করাচিতে একটা ব্যাংক ভবনের নিচের সুয়ারেজ ট্যাংকে জমে থাকা গ্যাস বিস্ফোরিত হয়ে ১৭ জনের মৃত্যু ঘটেছিল। আমেরিকায় ২০২২ সালের জুলাইতে মিনেসোটায় একটা ক্যাম্পাস খালি করতে হয়েছিল পয়ঃপ্রণালির গ্যাসের বিস্ফোরণের বিপদ থেকে বাঁচতে। ম্যানহোলের ঢাকনা উড়ে গিয়েছিল, আগুন উঠেছিল জ্বলে।

আর আমাদের ক্ষেত্রে বিপদ বাড়িয়ে দিয়েছে পাইপলাইনের জ্বালানি গ্যাস। আমাদের বিদ্যুতের লাইন, গ্যাসের লাইন, সুয়ারেজ লাইন জড়িয়ে পেঁচিয়ে বিপজ্জনক বোমা হয়ে আছে। আর রান্নাঘরের গ্যাসের লাইনের লিক, গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ, শোবার ঘরে এসির বিস্ফোরণ তো নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা!

আমরা এ দেশে বারুদের বস্তার ওপরে বসবাস করছি। যেকোনো সময় যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে এবং আপনি দায়ী না হলেও শিকারে পরিণত হতে পারেন। আপনি সিদ্দিকবাজারের সামনে দিয়ে, মীরপুর রোড দিয়ে যাচ্ছেন নিজের কাজে, রাস্তার পাশের ভবন বিস্ফোরিত হয়ে আপনি ছিটকে গেলেন তিন শ ফুট দূরে। আপনার মাথার ওপরে নির্মীয়মাণ উড়ালসড়কের গার্ডার পড়তে পারে, ফুটওভার ব্রিজ ভেঙে পড়তে পারে। আপনাদের মনে আছে, ২০১০ সালের নিমতলীর সেই ভয়াবহ রাসায়নিক অগ্নিকাণ্ডের কথা, ২০১৯ সালের চকবাজারের চুড়িহাট্টার দুর্ঘটনার কথা? রিকশায় করে যাচ্ছিল তরুণ-তরুণী, আগুনে শেষ হয়ে গেল মুহূর্তেই। সুমনের বয়স মাত্র ১৯। শবে বরাতের রোজা রেখে ইফতারি কিনতে বেরিয়েছিলেন তিনি। বাসার লোকজন অপেক্ষা করছেন ইফতারের সময়, সুমন ফেরেন না। সিদ্দিকবাজারের দুর্ঘটনায় পড়ে লাশ হয়ে হাসপাতালে পড়ে আছেন সুমন।

নাগরিক হিসেবে নিজেকে রক্ষার জন্য নিজের কিছু করণীয় আছে। নিজের ঘরের বিদ্যুতের লাইন, গ্যাসের লাইন, সুয়ারেজ নিয়মিত চেক করাতে হবে, এসি সার্ভিসিং করাতে হবে। রান্নাঘরের জানালা খুলে রাখতে হবে। গ্যাসের চুলা বন্ধ রাখতে হবে কাজ শেষে। চুলা জ্বালানোর আগে শুঁকে বোঝার চেষ্টা করতে হবে ঘরে গ্যাস জমেছে কি না।
তা না হয় করলেন। কিন্তু রাস্তায়, অফিসে, দোকানে আপনার ওপরে ভবন ভেঙে পড়লে, রাস্তায় সামনের গাড়ির অ্যাসিড আপনার গায়ে এসে পড়লে আপনি কী করবেন?

এখানেই আসে সুশাসনের কথা! আমরা মধ্যম আয়ের দেশ হচ্ছি, কিন্তু আমাদের শাসন এখনো মধ্যম মানের নয়। আমরা বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ঝাড়ুদার নিয়োগের জন্য লাখ টাকার ঘুষ আদানপ্রদান করি। এই লোকের কাছে আপনি কী সেবা আশা করেন?

আমরা শিক্ষক নিয়োগ দিই দুর্নীতি করে। সেই শিক্ষক কী পড়াবেন? এখন সেই শিক্ষককে মনিটর করবেন যে পরিদর্শক, তিনিও ঘুষ দিয়ে যদি চাকরি নিয়ে থাকেন, তিনি কী রিপোর্ট দেবেন? তিনিও ঘুষ খাবেন। ফলে আপনার প্রশ্নপত্র ফাঁস হবে। আপনার প্রশ্নপত্রে প্রশ্ন আসবে, ‘অমুক একজন কলেজশিক্ষিকা, তাঁর প্রেম ছিল, ভেঙে গেছে। এখন আর তাঁর বিয়ে হয় না। রবীন্দ্রনাথের ছদ্মনাম কী ছিল?’ কোথায় রবীন্দ্রনাথ, কোথায় স্কুলশিক্ষিকার বিয়ে না হওয়া; এই প্রশ্নকর্তার রুচি, মূল্যবোধ আপনি ভালো আশা করেন কেন? পুরো ব্যবস্থাই তো ভঙ্গুর। এখন এই প্রশ্নপত্র যাঁরা যাচাই-বাছাই করেন, তাঁরাও তো একই ব্যবস্থার অংশ এবং ধারক। তাঁরা কেন যাচাই করবেন? করার যোগ্যতা আছে কি?

আর এই যে ব্যবস্থাটা বদলাতে হবে, কারা বদলাবেন? আমাদের জনপ্রতিনিধিদের কতজন আসলে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন? আমাদের জনপ্রশাসন, আমাদের সেবা খাতের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা জনগণের সেবা করার কাজে মনপ্রাণ উজাড় করে দিচ্ছেন, নাকি তাঁদের ‘জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ’ করেই সময়টা পার করে দিতে হচ্ছে? তাঁরা নিয়োগ পেয়েছেন সদুপায়ে তো?

ঢাকার ভবনগুলোর নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার পর যে একটা সনদ নেওয়ার কথা, তা নিয়েছে মাত্র কয়েক শ ভবন, বাকি সব কটি ভবনে আমরা আছি, কাজ করছি সনদ ছাড়াই। কে দেবে সনদ? হাজার হাজার ভবন। কে এসব পরীক্ষা করবে? লোক কই? আর দরকারই-বা কী? উপরি আয়ের কারখানা তো খোলা আছে। সে কারণেই সবকিছু ভেঙে পড়ছে।

শুধু মাথাপিছু আয় দিয়ে উন্নত দেশ হওয়া যায় না। সর্বক্ষেত্রে উন্নতি দরকার। উন্নতি দরকার মূল্যবোধে। আমাদের কোনো ছাড়পত্রনির্ভর যান-নির্মাণ-কারখানা যাচাই-বাছাই হয়ে যোগ্য বলে ছাড়পত্র পায়, নাকি নির্ধারিত অফিসে গিয়ে বাড়তি টাকার বিনিময়ে ছাড়পত্রটা পায়? যানবাহনের ফিটনেস সার্টিফিকেটটা পরীক্ষা করে দেওয়া হলে ঢাকার রাস্তায় এসব লক্কড়ঝক্কড় বাস একটাও চলতে পারত কি? ঢাকার ভবনগুলোর নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার পর যে একটা সনদ নেওয়ার কথা, তা নিয়েছে মাত্র কয়েক শ ভবন, বাকি সব কটি ভবনে আমরা আছি, কাজ করছি সনদ ছাড়াই। কে দেবে সনদ? হাজার হাজার ভবন। কে এসব পরীক্ষা করবে? লোক কই? আর দরকারই-বা কী? উপরি আয়ের কারখানা তো খোলা আছে।

সে কারণেই সবকিছু ভেঙে পড়ছে। কেন্দ্র আর কিছুই ধরে রাখতে পারছে না। থিংস ফল অ্যাপার্ট। দ্য সেন্টার ক্যান নট হোল্ড। কিন্তু আমরা কি এভাবেই শুধু মারা পড়ব? প্লেগের ইঁদুরের মতো মাথা কুটে কুটে মারা যাব? আমাদের কোনো উদ্ধার নেই? কোনো আশা নেই? নিশ্চয়ই আছে। এ দেশে এমন কর্মকর্তা আছেন, যাঁরা দক্ষ, যাঁরা সৎ, যাঁরা মানবপ্রেমিক। এমন নেতা আছেন, যাঁরা আসলেই দেশের জন্য মানুষের জন্য একটা কিছু করতে চান।

দরকার ভালোর একটা বিস্ফোরণ। আলোর একটা বিস্ফোরণ। আর বিগ ব্যাং। সেটা করতে হলে পুরো ব্যবস্থাটাই পাল্টাতে হবে। এভাবেই চলবে—এটা মেনে নেওয়া বন্ধ করতে হবে। নাগরিকদের প্রতিবাদ করতে হবে। আর দায়িত্বে যাঁরা আছেন, যাঁদের হাতে আমাদের ভালোমন্দের ভার, তাঁদের বলতে হবে, এবার ফিরাও মোরে।
পৃথিবীর সভ্য উন্নত দেশগুলো প্রতিটা ভবন, লোকালয়, যানবাহন ও মেশিনের নিরাপত্তার স্টান্ডার্ড করণীয়, শর্তের ম্যানুয়াল করে রেখেছে। সেসব অনুসরণে বাধ্য করার জন্য চাই নতুন বৈপ্লবিক উদ্যোগ। সে আশায় চেয়ে থাকি।

  • আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক