ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে এক দিনের ক্রিকেটে বাংলাদেশের প্রাপ্ত নম্বর দশে দশ। টেন অন টেন। পরপর দশটা ওডিআই ম্যাচে বাংলাদেশ জিতল পরাক্রমশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে। এই সেদিনও বাংলাদেশ দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ওডিআই সিরিজে হারিয়েছে। বিশ্বকাপের বাছাইপর্বের সুপার লিগে ১৩টা দলের মধ্যে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের অবস্থান ২ নম্বরে। ১ নম্বর ইংল্যান্ডও ১৮টা ম্যাচের ১২টায় জিতেছে এবং বাংলাদেশও জিতেছে ১৮টার মধ্যে ১২টা। অর্থাৎ সমানে সমান।
অথচ এই বাংলাদেশ দলই টেস্টে ও টি-টোয়েন্টি ম্যাচে পারে না কেন? ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে এই সফরেই বাংলাদেশ এই দুই ফরম্যাটে ধবলধোলাই হয়েছে। সে দলটিই কী করে ওডিআইতে এমন দাপুটে হয়ে উঠল? কারণটা কী?
চ্যানেল টিস্পোর্টসের আলোচনায় সাবেক অধিনায়ক ও সিলেক্টর হাবিবুল বাশারকে এই প্রশ্ন করা হয়েছিল। তিনি বলেছেন, এই প্রশ্ন তাঁরও, এটা যতটা ক্ষোভ, তার চেয়েও বেশি জিজ্ঞাসা। আমরা কেন টেস্ট আর টি-টোয়েন্টি পারি না। তিনি বলছেন, িট-টোয়েন্টি আমরা বেশি খেলিনি, তা ঠিক, কিন্তু টেস্ট তো অনেক দিন ধরে খেলছি, টেস্টে তো আমাদের ভালো খেলা উচিত।
‘ওয়ানডেতে কেন বাংলাদেশ অন্য রকম’, প্রথম আলোয় (১৪ জুলাই) তামিম ইকবালের মত প্রকাশিত হয়েছে, ‘এই একটা খেলায় আমরা বেশ স্বস্তিতে থাকি। অনেক ম্যাচও খেলেছি আমরা। বাংলাদেশে ঘরোয়া ক্রিকেটেও ঢাকা প্রিমিয়ার লিগই সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। সেটা একটা কারণ হতে পারে। আর যখন ফল পক্ষে আসে, তখন দলের পরিবেশটাই অন্য রকম থাকে।’
সাকিব আল হাসান অনেকবার বলেছেন, িট-টোয়েন্টিতে আমরা ভালো করতে পারি না, কারণ আমাদের কোনো বিগ হিটার নেই, আমরা পাওয়ার ক্রিকেট খেলতে পারি না। অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সংগঠন ও বাঙালি বইয়ে বারবার করে বলেছেন বাঙালির স্বাস্থ্যহীনতার কথা। মুখোমুখি: আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বইয়ে তিনি বলেছেন, ‘আমি পৃথিবীতে বেশ কিছু দেশে গিয়েছি, কিন্তু বাঙালিদের চেয়ে স্বাস্থ্যহীন মানুষ আমি কোথাও দেখিনি।’
টেস্ট খেলা পাঁচ দিন ধরে হয়। এই পাঁচটা দিন ক্রিকেটারদের ৯টা থেকে ৫টা পর্যন্ত মাঠে থাকতে হয়। তার মানে তাঁরা ঘুম থেকে ওঠেন ভোর ৫টায়, মাঠ থেকে হোটেলে ফেরেন ৭টায়। খেলা তো খেলা, যে সাংবাদিকেরা ওই খেলার খবর দিতে স্টেডিয়ামে নিয়মিত যান, তাঁরাই ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে পড়েন। এই কারণে শুধু বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরা নন, অন্যান্য দেশের ক্রিকেটাররাও টেস্টে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। যে কারণে পঞ্চম দিনে ২০০ রান তাড়া করে খুব কম দলই টেস্ট জিততে পারে। মানুষ তো মানুষ, পিচই তো ভেঙেচুরে যায়।
পাকিস্তানের ফাস্ট বোলার শোয়েব আখতার একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, টেস্টে বল করে এসে রোজ রাতে তিনি ব্যথায় কাঁদতে বসতেন। বাথরুমে যেতেন হামাগুড়ি দিয়ে। এখন একে তো আমরা ঊনস্বাস্থ্য মানুষ। তার ওপর ছোটবেলা থেকে আমাদের জীবনযাপন আলস্যময়, আরামপ্রিয়। আমরা আধা কিলোমিটার পথও হাঁটতে চাই না, রিকশা খুঁজি। হেঁটে গেলে যে পথ পাঁচ মিনিটে যাওয়া যায়, তা অতিক্রম করার জন্য বাসের সিটে বসে থাকি, যানজটে আধঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও থাকি নির্বিকার।
আমাদের দেশে আনন্দের জন্য খেলাও উঠে যাচ্ছে। আমরা আর দৌড়াই না, ছোটাছুটি করি না, নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতার কাটি না। আমরা এখনো আশা করি না, অলিম্পিকে কোনো একটা ইভেন্টে আমরা সোনা জয় করতে পারব। সে ক্ষেত্রে টেস্ট বা টি-টোয়েন্টির মতো খেলা, যেখানে শারীরিক শক্তি, দম, সক্ষমতা বড় একটা উপাদান, সেখানে ভালো করা কঠিনই বটে।
ভাগ্যিস, খেলাধুলা কেবল শারীরিক উচ্চতা আর বলশালিতার ব্যাপার নয়। শচীন টেন্ডুলকার কিংবা মেসি, কেউই অনেক লম্বা–চওড়া মানুষ নন। খেলায় দরকার হয় প্রতিভা, অনুশীলন, সাধনা, প্রশিক্ষণ, মনের শক্তি। সে কারণেই বাংলাদেশের ছোটখাটো ছেলেরা অস্ট্রেলিয়া, ওয়েস্ট ইন্ডিজের লম্বা–চওড়া খেলোয়াড়দেরও হারিয়ে দিতে পারে।
বাংলাদেশের টেস্ট দল, ওডিআই দল, টি-টোয়েন্টি দল প্রায় অভিন্ন। তিনটা খেলার ধরন আলাদা, নিশ্চয়ই মানসিকতাও আলাদা হতে হয়, রণকৌশল ভিন্নতা দাবি করে, অনুশীলনও তাই ভিন্ন রকমই হওয়া উচিত। আমাদের খেলোয়াড় পুলে বেশিসংখ্যক খেলোয়াড় সংরক্ষিত নেই। ফলে তিন ফরম্যাটের জন্য দল আলাদা করার সুযোগ নেই।
আরেকটা কথা অনেকেই বলেন—দেশের মাটিতে পিচ বানানো হয় স্পিনবান্ধব। ফলে ব্যাটসম্যানরাও বাউন্সি উইকেটে ফাস্ট বল মোকাবিলা করা অনুশীলন করতে পারে না, ফাস্ট বোলাররাও গড়ে ওঠে না। দেশে বাউন্সি উইকেট বানিয়ে অনুশীলন করা হলে বাইরে গিয়ে তার সুফল পাওয়া যেতে পারে।
ডেভিড শেংকের লেখা বই দ্য জিনিয়াস ইন অল অব আস-এ সহজাত প্রতিভা বনাম চেষ্টা নিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। বইটা শুরু হয়েছে বেসবলের কিংবদন্তি টেড উইলিয়ামস প্রসঙ্গ দিয়ে। টেড উইলিয়ামস ছিলেন বেসবলের সুপারম্যান, হিটার, বিগ হিটার। অন্যরা মনে করত, এই ব্যাপারে তিনি একটা জিনিয়াস, জন্মগতভাবেই তিনি বলটা অন্যদের চেয়ে ভালোভাবে দেখতে পেতেন। এটা তাঁর প্রকৃতিদত্ত ক্ষমতা। কিন্তু টেড উইলিয়ামস বলেছেন, না, প্রতিভা নয়। তিনি বলেছেন, ‘অনুশীলন, অনুশীলন, অনুশীলন। তোমার ভেতরে এই ক্ষমতাটা এনে দেবে অনুশীলন। আমি যে বেশি দেখতে পেতাম, কারণ আমি ছিলাম একাগ্র, এতই ইনটেন্স...আমার বেশি দেখার কারণ ছিল সুপার নিয়মানুবর্তিতা, সুপার দৃষ্টিশক্তি নয়।’ ছোটবেলা থেকেই তিনি হতে চেয়েছেন সর্বশ্রেষ্ঠ হিটার। তাঁর কাছে বল হিটিংই ছিল জীবন। সারাক্ষণই তিনি থাকতেন ব্যাট হাতে। তাঁর বন্ধুরা দেখেছেন, সান ডিয়েগোর নর্থ পার্ক মাঠে ব্যাট হাতে যতক্ষণ জেগে থাকতেন, ততক্ষণ দিনের পর দিন, বছরের পর বছর উইলিয়ামস বল হিট করা অনুশীলন করতেন।
অনুশীলন, জেতার আগ্রহ বা ক্ষুধা—যার সুন্দর একটা বাংলা শব্দ আছে জিগীষা; প্রশিক্ষণ, বুদ্ধিমত্তা, কৌশল—সবটা মিলিয়ে একজন খেলোয়াড় ভালো করেন। আর একটা এভারেস্ট পাওয়ার জন্য অনেক বড় হিমালয় রেঞ্জ লাগে। অনেক খেলোয়াড় তৈরি হলে সেখান থেকে একটা বিশ্বজয়ী টিম বানানো যায়। সে জন্য দরকার খেলোয়াড়ি জাতি, অবকাঠামো, সংগঠন, পরিকল্পনা, প্রস্তুতি, প্রতিজ্ঞা, ব্যবস্থাপনা। দরকার বড় স্বপ্ন এবং বড় প্রস্তুতি।
টেস্ট ও টি-টোয়েন্টিতে আমরা ভালো করছি না, কিন্তু সার্বিক পরিকল্পনা, অনুশীলন ও প্রশিক্ষণ থাকলে আমরাও পারব। ‘পারিব না এ কথাটি বলিও না আর, একবার না পারিলে দেখো শতবার।’
আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক