দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ঘটনা ঘটে গেছে। অগণতান্ত্রিক ও কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠা এবং দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা একটি সরকারের পতন ঘটিয়ে দিয়েছে ছাত্র–জনতা। যেটিকে আমরা বলছি গণ-অভ্যুত্থান। অনেকে বলছেন বিপ্লব। যদিও প্রকৃত অর্থে সেটি বিপ্লবের চরিত্র ধারণ করে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। আবার অনেকে বলছেন, দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জন। এই স্বাধীনতা মূলত বাক্স্বাধীনতা ফিরে পাওয়া, প্রাণ খুলে কথা বলা বা প্রতিবাদ করার স্বাধীনতা।
বিপুল রক্তের বিনিময়ে একটি স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটিয়েছে ছাত্রজনতা। ফলে নতুন সরকারের ওপর তৈরি হয়েছে জনআকাঙ্ক্ষার তীব্র চাপ। আবার সর্বমহলে গত পনেরো বছরে জমে থাকা পাহাড়সম বঞ্চনার মোচন ও দাবি পূরণের চাপও নিতে হচ্ছে তাদের। সেসব একটি অন্তবর্তীকালীন সরকারের পক্ষে কতটা সম্ভব, তা অন্য বিবেচনা।
এর মধ্যে সরকারের দুই মাস পূর্ণ হতে চলল। এখনো দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। অচল করে দেওয়া পুলিশ বাহিনীকে সচল করা ও স্বৈরাচারী কাঠামোর প্রশাসনকে ঢেলে সাজানোয় সেই অর্থে কোনো কার্যকর প্রচেষ্টা আমরা এখনো দেখিনি, কেবল রদবদল ছাড়া। ফলে অনেক মানুষের মধ্যে এমন ‘মাত্রাহীন স্বাধীনতাও’ দেখা যাচ্ছে, তাতে ঘটে যাচ্ছে নানা অঘটন।
দীর্ঘদিনের ক্ষোভ, পুরোনো বিরোধ থেকে এবং নিত্যকার ব্যক্তিগত ও সামাজিক নানা ঘটনায় মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে। যেটিকে আমরা মব জাস্টিস বা লিঞ্চিং বা ভায়োলেন্স বলছি।
অনেকে বলতে পারেন, গত এক যুগে বিচার বিভাগের যে সর্বনাশ করা হয়েছে, তার প্রতিফলন নয় কি এবং আগে তো এসব আরও বেশি হতো। কিন্তু এমন পুরোনো ধাঁচের পর্যালোচনা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কতটা যুতসই আসলে।
হ্যাঁ, আদালত–বিচার বিভাগ ও প্রশাসন–পুলিশের মতো প্রতিষ্ঠান বিনষ্ট করার ফলাফল হয়তো আরও অনেক বছর আমাদের টানতে হবে। কিন্তু সমাজে এখন যে নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা তা কি চলতেই থাকবে? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিনিয়ত ‘কালচারাল ওয়ার’ বা সাংস্কৃতিক লড়াই চলছে, সেটি নিয়েও তো অনেকের প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।
সব ধরনের মতাদর্শের, রাজনৈতিক চিন্তার ও বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষের সম্মিলিত আন্দোলনের ফলে জুলাই অভ্যুত্থান সম্ভব হয়েছে। সাংস্কৃতিক লড়াইগুলো আমাদের সংগত কারণে ভাবায় যে এক–দুই মাস না যেতেই সম্মিলিত সেই শক্তি যেন নানাভাবে বিভাজিত হয়ে পড়ছে। এটি সত্য যে যুগ যুগ ধরে ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক কিছু অমীমাংসিত বিষয় থেকে গেছে। পরোক্ষ-প্রত্যক্ষভাবে ডিভাইড অ্যান্ড রুলের মাধ্যমে রাষ্ট্র সেই বিষয়গুলোকে শোষণের হাতিয়ারও বানিয়েছে।
আবার কিছু মীমাংসিত বিষয় বা যেসব বিষয় নিয়ে সমাজে অতটা বিভেদ বা বিরোধ ছিল না, থাকলেও সম্প্রীতি ও সহনশীলতার কারণে অতটা প্রকট ছিল না, সেগুলো এখন প্রবলভাবে হাজির হয়েছে নানা তর্ক-বিতর্ক-কুতর্কের মাধ্যমে। এর ফলে সমাজ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একধরনের অস্থিরতা বা অসহিষ্ণুতা আমরা দেখতে পাচ্ছি। সবাই এতটাই ‘উঠেপড়ে’ লেগেছে যেন এই তো সুযোগ বা এই তো সময় নিজের মত প্রতিষ্ঠা করার এবং প্রয়োজনে জোরপূর্বকভাবে বা অপরের ওপর চাপিয়ে দিয়ে হলেও। এটি করতে গিয়ে নানা হামলা বা হেনস্তার ঘটনাও ঘটেছে।
ছাত্র–জনতার আন্দোলনকে আমরা বিপ্লব কিংবা গণ-অভ্যুত্থান যা-ই বলি, এ ধরনের গণবিস্ফোরণ মূলত একটা দায়িত্বশীল প্রতিক্রিয়া, যেটি মোমেন্টাম বা সময় ও পরিস্থিতির কারণে অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এই প্রতিক্রিয়ার আবার একটি ‘নেগেটিভ এনার্জি’, এর একটি বিপজ্জনক দিকও আছে।
দাবি বাস্তবায়ন, উদ্দেশ্য পূরণ বা সফলতার পর অথবা সেই মোমেন্টাম কেটে যাওয়ার পর এটিকে দ্রুত নিউট্রালাইজ বা নিবৃত্ত করতে হয়। নয়তো সেই নেগেটিভ এনার্জি পরিবারে, সমাজে বা প্রতিষ্ঠানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে থাকে।
এ ছাড়া একটি রক্তক্ষয়ী গণ-আন্দোলন গোটা জাতিকে বা জাতির বড় একটি অংশকে মানসিক বিপর্যস্ততার মধ্য ফেলে দেয়। এখন সেই নেগেটিভ এনার্জি ও ট্রমার কারণে মানুষ এমন আচরণ করতে শুরু করে, যাতে অনেক সময় অঘটন বা অপরাধমূলক ঘটনা ঘটে যায়। সেখানে থাকে স্বার্থের দ্বন্দ্বও। কোনো অপশক্তির বিরোধে যে লড়াই যে সবার সম্মিলিত অংশগ্রহণ ছিল, তাদের মধ্যেই তখন তৈরি হয় ছায়া-লড়াই।
যুদ্ধ ও বিপ্লব–পরবর্তী দেশ ও সময়ে এমন বাস্তবতা নতুন নয়। জুলাই–পরবর্তী সামাজিক পরিস্থিতি ও সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে সেই বাস্তবতা কিছুটা হলেও আঁচ করা যাচ্ছে। সেখানে মিলেমিশে একাকার গত এক–দেড় দশকে বাইরের বিভিন্ন ধর্মীয় ফেনোমেনা, পশ্চিমা ওয়ার অ্যান্ড টেরর প্রকল্পের প্রভাব, নানা ষড়যন্ত্রতত্ত্ব ও বহুমুখী প্রোপাগান্ডা।
ফ্যাসিবাদ–পরবর্তী সময়ে এ দেশকে এগিয়ে নিতে হলে অনেক কিছুই ঢেলে সাজাতে হবে। এখানে শুধু চিন্তাচর্চাই যথেষ্ট নয়, মাঠেও নেমে যেতে হবে। আর সে কাজটি করতে হবে তরুণদেরই। আর এত কাজ থাকতে পুরোনো বিরোধে জড়িয়ে বা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ থেকে কোনো অঘটন ঘটিয়ে এবং একের পর এক বা ঘুরেফিরে একই সাংস্কৃতিক লড়াইয়ে কেন শক্তি ক্ষয়!
আমরা দেখলাম, জুলাই অভ্যুত্থানের পর ট্রাফিক পুলিশশূন্য হয়ে পড়ে গোটা দেশ। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরাই প্রায় এক সপ্তাহ ধরে রাজধানী ঢাকাসহ সব শহরে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা সামলিয়েছে। সে সময় গোটা দেশের দেয়াল গ্রাফিতিতে রাঙিয়ে দিয়েছিল শিক্ষার্থীরা। যেখানে আন্দোলনের সাহসিকতা, ত্যাগ ও বিসর্জনের গাথা যেমন উঠে এসেছে, আঁকা হয়েছে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্নও।
এরপর আমরা দেখলাম, দেশের পূর্বাঞ্চলে বন্যা মোকাবিলায় কীভাবে ঝাঁপিয়ে পড়লেন তরুণেরা। ট্রমা কাটানো ও নেগেটিভ এনার্জিকে নিবৃত্ত করার বা ইতিবাচক কাজে লাগানোর দারুণ উদাহরণ এসব; কিন্তু এখানেই থেমে গেলে চলবে না।
দলীয় রাজনীতির প্রভাব ও ক্ষমতাচর্চাসহ নানা কারণে স্থানীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সব ধরনের সংগঠন অনেক আগেই গুরুত্ব হারিয়েছে। এখন দায়িত্বশীল প্রতিক্রিয়াকে দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচির দিকে নিয়ে যেতে চাইলে এসব সংগঠন নতুন করে গড়ে তোলার বিকল্প নেই। তরুণদেরই সেটি করতে হবে।
এলাকায় এলাকায় গ্রন্থাগার ও পাঠচক্র চর্চা ফিরে আনতে হবে। নদী ও খাল দূষণ-দখলমুক্ত করতে পরিবেশ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এখন বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির উপযুক্ত সময়, সেখানে জোরেশোরে নেমে যেতে হবে। জুলাই অভ্যুত্থান নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বিতর্ক প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নাটিকা, দেয়ালিকা হতে পারে।
ক্রীড়া সংগঠন গড়ে তুলে নিয়মিত ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করা যায়। নৌকাবাইচ, সাঁতার ও গ্রামীণ খেলাও শুরু হোক। সামাজিক সংগঠন গড়ে তুলে ভাঙা রাস্তা মেরামত, সাঁকো-পুল নির্মাণে নেমে পড়তে হবে। এলাকায় কোনো পুরাকীর্তি বা পুরোনো স্থাপত্য থাকলে সেগুলোর যত্ন নেওয়া যায়। মেডিকেল কলেজের বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে এলাকায় গরিব ও দরিদ্রদের বিনা মূল্যে চিকিৎসা ক্যাম্প করা যায়। আন্দোলনে হতাহত ও তাঁদের পরিবারের কাছে যান, তাঁদের খোঁজ খবর নিন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের স্বেচ্ছাসেবী প্রকল্প নিয়ে সাংবাদিক বন্ধু নাজমুল আহসান দারুণ কিছু প্রস্তাব দিয়েছেন। যেমন যাঁরা আইন বিভাগে আছেন, তাঁরা শুরু করতে পারেন আইন সহজীকরণ প্রকল্প। দেশের আইনকানুন, জমিজিরাতের দলিল–দস্তাবেজ ইত্যাদি সহজ প্রমিত বাংলায় প্রকাশ করার উদ্যোগ নেওয়া যায়। প্রযুক্তি নিয়ে আগ্রহীরা কাজ করতে পারেন বাংলা ইন্টারনেটকে আরও কীভাবে ব্যবহার উপযোগী ও গ্রহণযোগ্য করা যায়, কীভাবে অন্ধ মানুষও ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারেন, তা নিয়ে।
যাঁরা আর্কিটেকচারে পড়েন, তাঁরা একটি পাবলিক টয়লেটের নকশা করেন কিংবা কোনো জেলখানার যেখানে কয়েদিরা একটু ভালো পরিবেশ পাবেন। ঢাকা শহরের বস্তিগুলোকে কীভাবে বাসযোগ্য করা যায়, তার নকশা করা যায়।
অর্থনীতির শিক্ষার্থীরা খুচরা ব্যবসায়ী, চা–দোকানি, গাড়ির হেলপার, গৃহকর্মীদের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও কর্মসংস্থান নিয়ে জরিপ ও গবেষণা চালাতে পারে। সাংবাদিকতার শিক্ষার্থীরা কয়েক পাতার ক্যাম্পাসভিত্তিক সাপ্তাহিক বা পাক্ষিক পত্রিকা বের করতে পারে। জিওগ্রাফি বা স্ট্যাটিসটিকসের ছাত্রছাত্রীরা মিলে চেষ্টা করা যেতে পারে বাংলাদেশের প্রতিটা গ্রাম, বাজার ইত্যাদির জিওআইডি বানানো যায় কি না।
একটি উপজেলা বা ইউনিয়ন দিয়ে শুরু করা যায়। কম্পিউটার সায়েন্সের শিক্ষার্থীরা মানুষের জীবন সহজ করতে নানা ধরনের সফটওয়্যার ডেভেলপ করতে পারে। কোডিংয়ে নিজেকে আরও দক্ষ করে তুলতে পারে। আর জুলাই অভ্যুত্থান নিয়ে গান, ভিডিও কনটেন্ট বানানো, কবিতা, নাটক লেখা ও সেগুলোর প্রদর্শনী করা—কত কাজই তো করা যায়। উইকিপিডিয়ায় জুলাই অভ্যুত্থান ও শহীদদের নিয়ে তথ্য সমৃদ্ধকরণে যুক্ত হওয়া যায়।
স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর সবার মনোযোগ রাষ্ট্র ও রাজনীতি সংস্কারের দিকে; কিন্তু সমাজটা কীভাবে পুনর্গঠন করতে হবে, কীভাবে সামাজিক ঐক্য ধরে রাখতে হবে—এ নিয়ে কোনো আলাপ, কার্যক্রম, উদ্যোগ বা কর্মসূচি নেই বললেই চলে।
ফ্যাসিবাদ–পরবর্তী সময়ে এ দেশকে এগিয়ে নিতে হলে অনেক কিছুই ঢেলে সাজাতে হবে। এখানে শুধু চিন্তাচর্চাই যথেষ্ট নয়, মাঠেও নেমে যেতে হবে। আর সে কাজটি করতে হবে তরুণদেরই। আর এত কাজ থাকতে পুরোনো বিরোধে জড়িয়ে বা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ থেকে কোনো অঘটন ঘটিয়ে এবং একের পর এক বা ঘুরেফিরে একই সাংস্কৃতিক লড়াইয়ে কেন শক্তি ক্ষয়!
রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী। ই–মেইল: rafsangalib1990@gmail.com