ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখা ঘোষণার পেছনে কী

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বৈঠক করেন
ছবি: মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর টুইট থেকে নেওয়া

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ‘ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখা’ ঘোষণা একাধিক কারণে কৌতূহলোদ্দীপক। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, কোন সময়ে এই রূপরেখার কথা ঘোষণা করা হলো। এ ঘোষণার পটভূমি স্মরণ না করলে বাংলাদেশের অবস্থানের তাৎপর্য বোঝা যাবে না।

এই ‘রূপরেখা’র উদ্দেশ্য কী, সেটাও বিবেচ্য। বিগত বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে টানাপোড়েন এবং চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ মৈত্রীর প্রেক্ষাপটে এই ঘোষণা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয় কি না, সেই প্রশ্নও উঠবে।

এ ধরনের রূপরেখা যে অকস্মাৎ তৈরি হয়নি, সেটা সহজেই বোধগম্য। ভৌগোলিক অবস্থান ও অর্থনৈতিক স্বার্থ বিবেচনায় বাংলাদেশের এ বিষয়ে আরও আগেই একটি সুস্পষ্ট অবস্থান তৈরি করা দরকার ছিল। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ক্ষমতাসীন নীতিনির্ধারক ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এ বিষয়ে বেশ কিছু সময় ধরেই প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু এই রূপরেখা ঘোষণার প্রেক্ষাপট লক্ষ করার মতো। সেটা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র সফর।

১০ এপ্রিল সংসদে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির কঠোর সমালোচনা করেছেন। সংসদে এ ধরনের বক্তব্য রাখার মাসখানেকের কম সময়ের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী ওই বক্তৃতায় এ অভিযোগও করেন যে যুক্তরাষ্ট্র তাঁর সরকারকে হটিয়ে দিয়ে সরকার বদলের চেষ্টা করছে। একই সময়ে প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা এবং তাঁর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরকে ‘একদল ভণ্ড’-এর (বাঞ্চ অব হিপোক্রেটস) আখড়া বলে বর্ণনা করেন।

উল্লেখ্য, ওই কাছাকাছি সময়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে বৈঠক করেন। এই বৈঠকে ব্লিঙ্কেন বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ও মতপ্রকাশের অধিকারের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ পুনরায় ব্যক্ত করেন এবং বলেন, বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনের দিকে সারা বিশ্ব তাকিয়ে আছে। যদিও এসব বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো অনেক দিন ধরেই বলে আসছে, কিন্তু মোমেন-ব্লিঙ্কেনের বৈঠকের আগে-পরে এবং সম্ভবত বৈঠকেও যুক্তরাষ্ট্রের বার্তা ছিল আরও কঠোর ও সবচেয়ে খোলামেলা।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক-বিষয়ক বিশেষজ্ঞদের অনেকের মতে, চীন মনে করে, বিরাজমান বিশ্বব্যবস্থার কাঠামো পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের অনুকূলে এবং তা ভেঙে ফেলে নতুন কাঠামো গড়ে তোলা দরকার। চীনের প্রস্তাবিত এ ধরনের নতুন বৈশ্বিক কাঠামোর একটি অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দিক আছে, আর তা হচ্ছে গণতান্ত্রিক শাসনের বদলে একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থা। এই প্রশ্নে বাংলাদেশের নীতিগত অবস্থান এবং বাস্তব অবস্থা বলে যে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনেরা চীনের মডেলকেই গ্রহণযোগ্য মনে করছে।

ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখা ঘোষণার একটি দীর্ঘ ও আন্তর্জাতিক পটভূমি আছে। এ ধারণার প্রধান উদ্যোক্তা যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৯ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার দিকে মনোযোগ দিতে শুরু করে এবং এরপর ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি বা আইপিএসের কথা ঘোষণা করে। যার লক্ষ্য, এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বৃদ্ধি। এর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তাসংক্রান্ত চারদেশীয় সংলাপকে (যা কোয়াড নামে পরিচিত) শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেয়।

২০০৭ সালে জাপানের পক্ষ থেকে এর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানকে নিয়ে গঠিত এই অনানুষ্ঠানিক কৌশলগত ফোরাম যুক্তরাষ্ট্রের উৎসাহের কারণে ২০১৮ সাল থেকে বিশেষভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বক্তব্য অনুযায়ী এ দুই উদ্যোগের লক্ষ্য হচ্ছে, এই দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সহযোগিতা বাড়ানো।

আইপিএসের একটি লক্ষ্য হচ্ছে, এ অঞ্চলে চীনের প্রভাব কমানো। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভসহ (বিআরআই) নানা উদ্যোগের কারণে সারা বিশ্বেই চীনের প্রভাব বাড়ছে। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগর এলাকার অর্থনৈতিক এবং ভূকৌশলগত গুরুত্ব বাড়ায় যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে চীনের প্রভাব নিয়ন্ত্রণে এ অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা বাড়াতে চায়। এই বিবেচনা থেকেই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে আইপিএসে যুক্ত হওয়ার অনুরোধ জানিয়ে আসছে। কেউ কেউ মনে করেন যে যুক্তরাষ্ট্র এই নিয়ে চাপও প্রয়োগ করেছে। বাংলাদেশ একদিকে দীর্ঘদিন ধরে এ বিষয়ে একধরনের ‘দেখি, দেখছি’, মনোভাব দেখিয়ে এসেছে। অন্যদিকে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ করেছে।

চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কেবল অর্থনৈতিক সহযোগিতার বলে সরকার ও সরকার–সমর্থক বিশ্লেষকেরা যে ভাষ্য দিয়ে আসছেন, তা যে সঠিক নয়, তার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ হচ্ছে এ কে আব্দুল মোমেনের ওয়াশিংটন সফরের ঠিক আগে ৬ এপ্রিল অত্যন্ত গোপনীয়তা বজায় রেখে চীনা দূত দেং শিজুনের আকস্মিক ঢাকা সফর।

এরপরই আবার বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন চীন সফরে যান। এর আগে গত ৯ জানুয়ারি চীনের নবনিযুক্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিন গ্যাং অকস্মাৎ মধ্যরাতে ঢাকায় যাত্রাবিরতি করেন এবং বিমানবন্দরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন। সেই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা উপর্যুপরি বাংলাদেশ সফর করছিলেন।

তা ছাড়া দেখা যাচ্ছে, হঠাৎ করেই রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা সমাধানে চীন আবার উদ্যোগী হয়ে উঠেছে। এমনকি প্রত্যাবাসনের একটি কথিত ‘পাইলট প্রকল্প’-এর ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারকে রাজি করিয়েছে চীন। রোহিঙ্গা সমস্যার আন্তর্জাতিকীকরণ বন্ধ করা বা পশ্চিমাদের সংশ্লিষ্টতা হ্রাস করাই এর অন্যতম লক্ষ্য। একই সঙ্গে এর মাধ্যমে চীন মিয়ানমারে জান্তাকে আন্তর্জাতিক বৈধতা দেওয়ার পরিস্থিতি তৈরি করতে চায়। চীন কোনোভাবেই চায় না, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কোনো উদ্যোগে যোগ দিক। বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের দূত ২০২১ সালের মে মাসে ঢাকায় কোনো রাখঢাক ছাড়াই এ নিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন।

বাংলাদেশের ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখা ঘোষণার সময় এবং প্রেক্ষাপট বলে দেয়, এর একটি উদ্দেশ্য হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনের অবসান ঘটানো বা অন্তত হ্রাস করা। এই রূপরেখায় ‘উন্মুক্ত, স্বচ্ছ এবং নিয়মভিত্তিক (রুল বেজড)’ ব্যবস্থাগুলো সুসংহত করার যে কথা বলা হয়েছে, তার সঙ্গে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে হোয়াইট হাউসের প্রকাশিত কৌশলপত্রের একধরনের প্রতিধ্বনি শোনা যায়।

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের মতপার্থক্যের জায়গাগুলো শুধু বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক নয়, অভ্যন্তরীণ শাসনকাঠামোও বটে। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ব্যাপক ক্ষয়, মতপ্রকাশের অধিকারের কার্যত অবসান এবং আসন্ন নির্বাচনকে গণতান্ত্রিক মাপকাঠিতে গ্রহণযোগ্য করার বিষয়ে সংশয়ের কথাও যুক্তরাষ্ট্র বলে আসছে।

বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনেরা সম্ভবত আশা করছেন যে এই ‘রূপরেখা’ ওই সব বিষয় থেকে মনোযোগ সরিয়ে নিতে সক্ষম হবে। এ ধরনের পদক্ষেপ যে তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক স্বার্থপ্রণোদিত, তা ওয়াশিংটনের নীতিনির্ধারকেরা বুঝতে পারবেন কি না, সেটা ভবিষ্যতে বোঝা যাবে। কিন্তু এই পদক্ষেপের ইতিবাচক দিক থাকলেও তা দীর্ঘ মেয়াদে জাতীয় স্বার্থ বিবেচনা করে নেওয়া হয়েছে কি না, সেটি বাংলাদেশের নাগরিকদের বোঝা দরকার।

তা ছাড়া এ ধরনের রূপরেখা তৈরি, প্রকাশ ও আলোচনাকে পশ্চিমা দেশগুলোকে আপাতত সন্তুষ্ট করে যেনতেন প্রকারে আগামী নির্বাচনের বৈতরণি পার হওয়ার চেষ্টা বলে মনে করার পক্ষে যথেষ্ট কারণ আছে। এমন বিবেচনা থেকে নেওয়া পদক্ষেপ দীর্ঘ মেয়াদে দেশের জন্য ইতিবাচক হবে না। কারণ, আগামী নির্বাচনের পরও বাংলাদেশকে বৈশ্বিক পরিসরে যুক্ত থাকতে হবে। সরকারের আচরণের এসব দিক সুস্পষ্ট না হওয়া পর্যন্ত এই রূপরেখাকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তনের ইঙ্গিত ধরে নিলে তা সিদ্ধান্ত হিসেবে অপরিপক্ব বলেই বিবেচিত হবে।

বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যে ‘রূপরেখা’ প্রকাশ করা হয়েছে, তা আর যেকোনো রূপরেখার মতোই মোটাদাগে সরকারের অবস্থানের প্রকাশ। এই দৃষ্টিভঙ্গি কতটা নীতিতে পরিণত হচ্ছে, কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার কথা প্রকাশ্যে বলা হচ্ছে বা এই রূপরেখার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিষয়গুলোতে সরকার কী পদক্ষেপ নেবে, তার ওপরই সবকিছু নির্ভর করছে। এই রূপরেখা ‘রুল বেজড’ ব্যবস্থাগুলো সংহত করা কথা বলা হয়েছে, কিন্তু এ অঞ্চলে চীনের আচরণকে বিরাজমান বিশ্বব্যবস্থা বা প্রচলিত নিয়মের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ বলে মনে না করার কারণ আছে।

তা ছাড়া আন্তর্জাতিক সম্পর্ক-বিষয়ক বিশেষজ্ঞদের অনেকের মতে, চীন মনে করে, বিরাজমান বিশ্বব্যবস্থার কাঠামো পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের অনুকূলে এবং তা ভেঙে ফেলে নতুন কাঠামো গড়ে তোলা দরকার। চীনের প্রস্তাবিত এ ধরনের নতুন বৈশ্বিক কাঠামোর একটি অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দিক আছে, আর তা হচ্ছে গণতান্ত্রিক শাসনের বদলে একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থা। এই প্রশ্নে বাংলাদেশের নীতিগত অবস্থান এবং বাস্তব অবস্থা বলে যে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনেরা চীনের মডেলকেই গ্রহণযোগ্য মনে করছে।

বাংলাদেশের ঘোষিত ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখা আমাদের মনোযোগ দাবি করে। এ নিয়ে আলোচনা করা দরকার, কিন্তু এমন পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনায় এ কথা বিস্মৃত হওয়ার সুযোগ নেই যে এ ধরনের রূপরেখা এবং নীতি গ্রহণের জন্য একটি সরকারের যে ম্যান্ডেট থাকা দরকার, তার অনুপস্থিতিতে এমন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।

  • আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং সুইডেনের গথেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যারাইটিজ অব ডেমোক্রেসি ইনস্টিটিউটের ভিজিটিং রিসার্চার