মতামত

ভারতের নীরব উত্থান হচ্ছে যেভাবে

ভারতের চন্দ্রযান-৩-এর উৎক্ষেপণ। গত ২৩ আগস্ট এটি চাঁদের মাটিতে সফলভাবে অবতরণ করে
ভারতের চন্দ্রযান-৩-এর উৎক্ষেপণ। গত ২৩ আগস্ট এটি চাঁদের মাটিতে সফলভাবে অবতরণ করে

চীনের তীব্র অর্থনৈতিক মন্দা বিশ্বজুড়ে শঙ্কার ঘণ্টাধ্বনি বাজিয়ে দিয়েছে। তবে চীনের সেই মন্দাভাব তার পড়শি দেশ ভারতের (যেটি কিনা জনসংখ্যাগত দিক থেকে একটি ‘পাওয়ার হাউস’) উত্থানের ক্ষেত্রে স্বস্তি এনে দিয়েছে।

ভারত চলতি ২০২৩ সালের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে এবং দেশটি সম্প্রতি চাঁদের সম্ভাব্য পানিসমৃদ্ধ দক্ষিণ মেরুতে একটি মহাকাশযানের সফল অবতরণ ঘটিয়েছে। লক্ষ্য করার বিষয় হলো, ভারতের এই উত্থান চীনের মতো করে ক্রমবর্ধমান আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতি ও বিদেশের ভূখণ্ড দখলের লালসাকে আঁকড়ে ধরে অর্জিত হয়নি। ভারতের ভূরাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলেও ক্রমবর্ধমানভাবে তার পদচারণ বাড়ছে।

চীনের এই ‘পতন’ (কেউ কেউ যেটিকে চীনের চার দশকের অর্থনৈতিক উত্থানের উপসংহার বলে অভিহিত করা শুরু করেছেন) ভারতীয় অর্থনীতি এবং অন্যান্য উন্নয়নশীল ও উদীয়মান দেশগুলোর সামনে নতুন সুযোগ উন্মুক্ত করেছে।

এই বছরের শুরুর দিকে জনসংখ্যার দিক থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারত ৩০০ বছরের বেশি সময় ধরে স্বীকৃত বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ চীনকে ছাড়িয়ে আরেকটি মাইলফলক ছুঁয়েছে। চীনের সংকোচনমুখী ও দ্রুত বার্ধক্যবহুল হতে থাকা জনসংখ্যা অচিরেই তার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে এবং এটি বেইজিংয়ের ভূরাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের রাশ টেনে ধরতে পারে।

অন্যদিকে বিশ্বের সবচেয়ে কম বয়সী দেশগুলোর একটি দেশ ভারতের বিশাল জনসংখ্যার এই মুহূর্তে গড় বয়স ২৮ দশমিক ২ বছর। এই বিপুল কর্মক্ষম জনসংখ্যার সুবিধা ভারত কাজে লাগাতে পারবে। তবে একটি প্রধান বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে ভারতের উত্থানের পেছনের প্রধান চালিকা শক্তি হলো তার ক্ষিপ্রগতিসম্পন্ন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি।

ভারতের জিডিপি এখনো অবশ্য চীনের তুলনায় আকারে ছোট। তবে বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল হয়ে উঠেছে ভারতীয় অর্থনীতি। আগামী পাঁচ বছরে ভারত ১২ দশমিক ৯ শতাংশ বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। আর সেটি অর্জিত হলে বৈশ্বিক অর্থনীতির শেয়ারের দিক থেকে ভারত যুক্তরাষ্ট্রকে (বর্তমানে বিশ্ব অর্থনীতির ১১ দশমিক ৩ শতাংশ শেয়ার যুক্তরাষ্ট্রের) ছাড়িয়ে যাবে।

ভারতে ভোক্তার খরচ করার ক্ষমতা বেড়েছে। পাশাপাশি সেখানকার তরুণ জনগোষ্ঠী উদ্ভাবনের দিকে ঝুঁকেছে, যা দেশটির বিশ্বমানের তথ্য-অর্থনীতি এবং সাম্প্রতিক চাঁদে অবতরণের ঘটনার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র তার মহাকাশ অভিযানগুলোতে যে অর্থ খরচ করে থাকে, তার মাত্র ৬ শতাংশ পরিমাণ অর্থ ভারত তার জাতীয় মহাকাশ গবেষণা খাতে ব্যয় করে চন্দ্রজয়ের মতো সাফল্য ঘরে তুলেছে।

ভারত ইতিমধ্যে তার সাবেক ঔপনিবেশিক শাসক দেশ যুক্তরাজ্যকে জিডিপি অর্জনের দৌড়ে পেছনে ফেলে দিয়েছে এবং আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ ভারত জাপান ও জার্মানিকে পেছনে ফেলে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পরে থেকে বিশ্বের তৃতীয় বড় অর্থনীতির দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে যাচ্ছে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র চীনের ক্রমবর্ধমান অস্থির আচরণের সুবাদে ভারতকে প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়াতে হয়েছে এবং এতে মোটেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে ভারতের প্রতিরক্ষা বাজেট এখন বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অবস্থায় আছে।

ভারত তার সীমান্ত লাগোয়া দুটি পরমাণু শক্তিধর ও সম্প্রসারণবাদী রাষ্ট্র চীন ও পাকিস্তানের সম্পর্ক গভীর হওয়াকে সংগত কারণেই সতর্কতার সঙ্গে দেখছে। এ ছাড়া তিন বছর ধরে হিমালয় সীমান্তে ভারত ও চীনের উত্তেজনাপূর্ণ সামরিক অচলাবস্থা চলছে। বিতর্কিত তিব্বত-লাদাখ সীমান্ত এলাকায় মাঝেমধ্যে ছোটখাটো সংঘর্ষ হওয়ায় ভারত ও চীনের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে তলানিতে এসে ঠেকেছে।

সর্বাত্মক যুদ্ধ লেগে যাওয়ার ঝুঁকি থাকার পরও ভারত চীনকে সামরিকভাবে মোকাবিলা করে যাচ্ছে। চলতি শতকে ক্ষমতাধর ও আগ্রাসী চীনকে ভারত ছাড়া অন্য কোনো দেশ এইভাবে প্রতিহত করার সাহস দেখাতে পারেনি।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পশ্চিমের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক অপেক্ষাকৃতভাবে ঘনিষ্ঠতার দিকে গেলেও পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে দিল্লি আনুষ্ঠানিকভাবে সামরিক জোট গড়ার বিষয়ে দ্বিধান্বিত রয়েছে। এর জন্য অবশ্য পশ্চিমা শক্তিগুলো আংশিকভাবে দায়ী। চীন-ভারত সামরিক অচলাবস্থার বিষয়ে মন্তব্য করায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের স্পষ্ট মন্তব্য না আসায়; আরও স্পষ্ট করে বললে, এই ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের পক্ষ না নেওয়ায় ভারতের কাছে যে বার্তাটি স্পষ্ট হয়েছে, তা হলো ভারতকে তার নিজের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হবে।

এ কারণেই বহিঃশত্রুদের ঠেকাতে ভারতকে তার সামরিক বাহিনীকে আধুনিক করে তুলতে হচ্ছে এবং এর অংশ হিসেবে পরমাণু অস্ত্রের মজুত অবধারিতভাবেই বাড়াতে হবে। তবে চীন ও ভারতের এই ক্রমবর্ধমান ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা বৈশ্বিক দক্ষিণাঞ্চলকে ঐক্যবদ্ধ করার এবং ব্রিকস গ্রুপকে পশ্চিমাদের নেতৃত্বাধীন জি-২০ ও জি-৭ এর বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প গ্রুপে রূপান্তরিত করার প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।

ভারত তার বর্তমান ঊর্ধ্বমুখী গতিপথ বজায় রাখতে পারবে কি না, তা তার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক নিরাপত্তা এবং একটি দূরদর্শী পররাষ্ট্রনীতি বজায় রাখার ক্ষমতার ওপর নির্ভর করবে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

● ব্রহ্ম চেলানি নয়াদিল্লিভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের অধ্যাপক