পূর্বাঞ্চলের জেলা কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফেনী ও পাশ্ববর্তী অঞ্চলে বন্যার পানি খুব ধীরে ধীরে নিষ্কাশিত হচ্ছে, যা মানুষের জন্য আরও কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান নিবন্ধটি দুটি প্রশ্নের ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করব। ১. কেন বন্যার পানি এত ধীরে ধীরে নিষ্কাশিত হচ্ছে? ২. কীভাবে স্থানীয় জনগণের জন্য কার্যকর বন্যাসতর্কতা তৈরি করা যায়, যাতে ভবিষ্যতে এমন ঘটনার জন্য ভালোভাবে প্রস্তুতি নেওয়া যায়?
আমাদের পূর্বাঞ্চলে বন্যা নিয়ে খুব সামান্য গবেষণা রয়েছে। কারণ, এ এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে বন্যা হয়নি। গোমতী ও ফেনী নদী এবং এর শাখানদী ও উপনদীগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত প্রধান শহরগুলোতে বন্যা প্রতিরোধমূলক বাঁধ রয়েছে, যা খুব ভালোভাবে কাজ করছে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নদী ও সংশ্লিষ্ট পললভূমি এবং পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোর বিভিন্ন স্থানে হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে, যার ফলে নদীর প্রবাহক্ষমতা কমেছে।
এর ফলে তীব্র বৃষ্টির কারণে সৃষ্ট উচ্চ প্রবাহ এই সংকীর্ণ নদীপথ দিয়ে নিষ্কাশিত হতে পারেনি; এর ফলে স্থানীয় পানির স্তর বৃদ্ধি পায়, বাঁধ ভেঙে যাওয়ার ঘটনা ঘটে এবং এই অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা এমন পর্যায়ে বন্যাকবলিত হয়, যার সঙ্গে স্থানীয় মানুষ পরিচিত নন। কোনো পূর্বাভাস ও প্রস্তুতি ছিল না। ফলস্বরূপ বাসিন্দারা অপ্রত্যাশিতভাবে প্রাণহানি ও সম্পত্তির ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।
এ ছাড়া নোয়াখালী, ফেনী ও পাশ্ববর্তী অঞ্চলের বিস্তৃত ভূমি প্রাকৃতিক ডেলটা গঠনের মাধ্যমে ১৯৫০-এর দশক পর্যন্ত জোয়ার–ভাটার মাধ্যমে তৈরি হয়েছে। ১৯৫৭ সাল থেকে বিভিন্ন ক্রস বাঁধ ও ক্লোজার কাঠামো বাস্তবায়ন করা হয়েছে, যা ভূমির গঠনপ্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করেছে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য, যার মধ্যে সাম্প্রতিক রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলগুলো (ইপিজেড) রয়েছে। এই কার্যক্রমের মাধ্যমে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পানিনিষ্কাশন নেটওয়ার্ক বন্ধ হয়ে গেছে।
উন্নয়ন শুরু হয়েছে নতুনভাবে তৈরি ভূমিতে। অনেক আগের ক্রস বাঁধ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অদৃশ্য হয়ে গেছে ভূমি ব্যবহারের পরিবর্তনের কারণে। আবার পুনরুদ্ধার করা জমিতে বন্যাসুরক্ষা বাস্তবায়িত হয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পলিপ্রবাহের অভাবের কারণে এসব এলাকা দেবে গেছে। সে জন্য বাঁধ ভেঙে একবার পানি ভেতরে প্রবেশ করলে বা স্থানীয় বৃষ্টির মাধ্যমে পানি জমলে সাধারণত তা সহজে বের হয় না।
আমাদের সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে দেখা যায় যে ক্রস বাঁধ ব্যবহারের মাধ্যমে নতুন ভূমি তৈরির সুবিধাগুলোর সঙ্গে অনেক সমস্যাও আছে। ছোট ছোট জোয়ার-ভাটার খালের ব্লকেজ নতুনভাবে অন্যত্র সমস্যা সৃষ্টি করে। বর্তমান হাইড্রোলজিক্যাল অবস্থার ওপর এই বিষয়গুলো যত্নসহকারে মোকাবিলা করা প্রয়োজন। সুতরাং উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় শর্ত হলো প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াগুলো যতটা সম্ভব বজায় রাখা এবং নিষ্কাশনের পথগুলোকে কার্যকর রাখতে কম মাত্রায় পরিবর্তন করা। এটি একটি প্রয়োজনীয় শর্ত, যা তীব্র বন্যা ব্যবস্থাপনা এমনকি সাধারণ বন্যা ব্যবস্থাপনার জন্যও দরকার।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভবিষ্যতে তীব্র বৃষ্টির প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে। যদি বাংলাদেশ ও পার্শ্ববর্তী দেশের উন্নয়নের বর্তমান ধারা চলতে থাকে, তাহলে আমাদের আরও বেশি এমন দুর্যোগের সম্মুখীন হতে হবে। ভবিষ্যতে সমান অংশীদারত্বের মাধ্যমে সহযোগিতা আমাদের প্রযুক্তিগত ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ, যাতে পুরো দেশের বন্যা প্রস্তুতি প্রোগ্রাম কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হয়। এটি প্রতিবেশী দেশগুলোতে অনুকরণীয় হতে পারে, যেখানে বাংলাদেশ নেতৃত্বমূলক ভূমিকা পালন করতে পারে।
এটি লক্ষণীয় যে মুসাপুর ক্লোজার ও মুহুরী স্লুইসগেট ফেনী নদী সিস্টেমের একমাত্র স্রোতপ্রবাহের মাধ্যম, যার মাধ্যমে পানি সমুদ্রে নেমে যেতে পারে এবং সাধারণত উচ্চ জোয়ারের সময় বন্ধ থাকে, যা বন্যার পানি নিষ্কাশনে আরও বাধা সৃষ্টি করে।
সাধারণভাবে এই গেটগুলো কেবল ভাটার সময় খুলতে পারে বন্যার পানি নিষ্কাশন করতে এবং উচ্চ জোয়ারের সময় বন্ধ থাকে অভ্যন্তরীণ এলাকা স্যালিনিটি (লবণাক্ততা) থেকে রক্ষার জন্য। উল্লেখ্য এই কাঠামোগুলোর ক্ষতি, এমনকি ব্যর্থতা খুবই স্বাভাবিক। কারণ, এগুলো এত উচ্চ প্রবাহ নিষ্কাশনের জন্য ডিজাইন করা হয়নি।
আমি বিশ্বাস করি, আমরা জলবায়ু পরিবর্তনসম্পর্কিত প্রাকৃতিক ঘটনাগুলো যেমন উচ্চ বৃষ্টিপাত নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না। তবে ভারতের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য–উপাত্ত পাওয়া সম্ভব। আমরা যৌথ নদী কমিশনের মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যেতে পারি। তবে এটির জন্য কেন আমাদের এই তথ্যের প্রয়োজন এবং কীভাবে আমরা এ তথ্য বাংলাদেশের মধ্যে ব্যবহার করতে পরিকল্পনা করছি, তা ব্যাখ্যা করতে হবে।
এটি গুরুত্বপূর্ণ যে ভারতীয় একটি নির্দিষ্ট স্থানের প্রবাহ, গতি ও সময়কাল বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে একই থাকবে না। কারণ, স্থানীয় ভূতাত্ত্বিক অবকাঠামো ও ভূমি ব্যবহারের ধরনের পার্থক্য। অতিরিক্ত তথ্য চাওয়ার আগে স্থানীয় প্রেক্ষাপটে কীভাবে তথ্য ব্যবহার করব, তা নিয়ে যথেষ্ট কাজ করা উচিত।
এই বিষয়ে আমরা বাংলাদেশের বন্যা প্রস্তুতি প্রোগ্রামের (এফপিপি) উদ্যোগকে তুলে ধরতে পারি। যেখানে ডায়নামিক ফ্লাড রিস্ক মডেল (ডিএফআরএম) তৈরি করা হয়েছে। নদীর স্টেশনের জলস্তরের ভিত্তিতে ডিএফআরএম একটি সহজ সতর্কতাসংখ্যা প্রদান করে, যা স্থানীয় জনগণকে জানিয়ে দেয়, কী ঘটবে এবং বন্যা মোকাবিলায় কী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। স্থানীয় মানুষ সহজেই বুঝতে পারেন, তাঁদের কী ঘটবে, কীভাবে ক্ষতি হ্রাস করতে হবে এবং উপকরণগুলোর ওপর নির্ভর করে প্রতিটি অঞ্চলের জন্য পদক্ষেপগুলো আলাদা হবে। এটি শেষ পর্যন্ত বন্যা দুর্যোগের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধি করবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভবিষ্যতে তীব্র বৃষ্টির প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে। যদি বাংলাদেশ ও পার্শ্ববর্তী দেশের উন্নয়নের বর্তমান ধারা চলতে থাকে, তাহলে আমাদের আরও বেশি এমন দুর্যোগের সম্মুখীন হতে হবে। ভবিষ্যতে সমান অংশীদারত্বের মাধ্যমে সহযোগিতা আমাদের প্রযুক্তিগত ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ, যাতে পুরো দেশের বন্যা প্রস্তুতি প্রোগ্রাম কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হয়। এটি প্রতিবেশী দেশগুলোতে অনুকরণীয় হতে পারে, যেখানে বাংলাদেশ নেতৃত্বমূলক ভূমিকা পালন করতে পারে।
সহযোগিতামূলক পন্থার মাধ্যমে বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের বন্যা ব্যবস্থাপনার ক্ষমতা উন্নত করা যেতে পারে, যাতে ভবিষ্যতে মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলা করা যায়। দক্ষিণ এশীয় গবেষণাপ্রতিষ্ঠান (এসএএডিআরআই) একটি প্রতিষ্ঠিত প্ল্যাটফর্ম হিসেবে বিদ্যমান, যেখানে বাংলাদেশের পাশাপাশি অন্যান্য দক্ষিণ এশীয় দেশের বিভিন্ন গবেষণা ও একাডেমিক প্রতিষ্ঠান সদস্য। এসএএডিআরআই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে এতৎসম্পর্কিত গবেষণার ফলাফল সদস্যদেশগুলোতে বন্যা ব্যবস্থাপনায় কার্যকরভাবে ব্যবহার করা সম্ভব হবে। এটি আমাদের সবার জন্য একটি জয় জয় পরিস্থিতি হবে।
মুনসুর রহমান পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়