এ কোন ডাকাতের পাল্লায় পড়ল দেশ

বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্র শার্লক হোমসের স্রষ্টা আর্থার কোনান ডয়েল বলেছিলেন, গল্পের চেয়েও সত্য ঘটনা অনেক বিস্ময়কর হতে পারে। তেমনই এক বিস্ময়কর ও নিষ্ঠুরতম সত্য ঘটনায় গোটা দেশ হতবাক হয়ে গেছে।

গত মঙ্গলবার (২ আগস্ট, ২০২২) রাতে কুষ্টিয়া থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী ‘ঈগল এক্সপ্রেস’ বাসে যে ডাকাতির ঘটনা ঘটল, তা কোনোভাবেই ভোলার মতো নয়।

কোনো নিছক বাস ডাকাতি ছিল না সেটি। ডাকাতেরা যাত্রীদের বেঁধে রেখে ও মারধর করে টাকা, স্বর্ণালংকারসহ সর্বস্ব ছিনিয়ে নিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, এক ভয়াবহ ও নিষ্ঠুরতম কাণ্ডও ঘটিয়েছে। বাসভর্তি মানুষের ভেতরে ছয়জন ডাকাত একের পর এক ধর্ষণ করে গেছে এক তরুণী যাত্রীকে।

ডাকাতি করার সময় ওই তরুণী প্রতিবাদ করেছিলেন, আর এর বিনিময়ে এমন ‘শাস্তি’ দিল তাঁকে ডাকাতেরা। শুধু তাঁকে নয়, আরও এক নারীকেও নির্যাতন করা হয়। চিকিৎসকেরা ওই তরুণীকে ধর্ষণের আলামত পেয়েছেন।

মাঝরাস্তায় যাত্রীবেশে কয়েক দফায় ডাকাতেরা ওই গাড়িতে ওঠে। সংখ্যায় তারা ছিল ১০-১২ জন। একপর্যায়ে গোটা বাসের নিয়ন্ত্রণ নেয় ডাকাত দল। ডাকাতি শুরুর আগে সবার মুঠোফোন কেড়ে নেওয়া হয়। ফলে যাত্রীরা ৯৯৯ নম্বরেও ফোন করতে পারেননি। এক যাত্রী সেই চেষ্টা করলে তাকে ছুরিকাঘাতে রক্তাক্ত করা হয়।

ডাকাতেরা এমন আতঙ্ক তৈরি করে যে বাসের ভেতরে থাকা শিশুরা কেঁদে উঠেছিল। ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল মহাসড়কে ইচ্ছেমতো গাড়ির গতিপথ পরিবর্তন করে তিন ঘণ্টা ধরে কী ‘নির্ভীকভাবে’ এমন অরাজকতা চালিয়ে গেল ডাকাতেরা।

কত গাড়ি ওই বাসের আশপাশ দিয়ে চলল, কেউ বুঝল না। অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, সেই দীর্ঘ সময় ধরে হাইওয়ে পুলিশের কোনো টহলও ওই এলাকায় দেখা যায়নি।

এ জন্যই কি ইতিহাসবিদ ও লেখক যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত (১৮৮৩-১৯৬৫) তাঁর বিখ্যাত ‘বাঙলার ডাকাত’ বইয়ে এমন মন্তব্য করেছেন—‘দেশে শাসন নাই, কেউ কাহাকেও দেখে না, দস্যুদল নির্ভীকভাবে ডাকাতি করে।’

চার খণ্ডে প্রকাশিত বইটিতে ইংরেজ আমলে বাংলা অঞ্চলের ডাকাতির ইতিহাস তুলে এনেছিলেন তিনি। সে সময় নবাবেরা ছিলেন নামেমাত্র শাসক, তাঁদের ক্ষমতা ও শৌর্যবীর্য ক্ষয়িষ্ণু। ফলে ডাকাতদের চরম নৈরাজ্য মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। আর তখনকার বাংলা অঞ্চল মানে নদ-নদী ও বন–জঙ্গলে পরিবেষ্টিত ডাকাতির এক ‘স্বর্গভূমি’। নবাবের পাইক–পেয়াদা বা ইংরেজের পুলিশ ডাকাতদের টিকিটি খুঁজে পেত না।

আগে যারা ডাকাত ধরত, তারাই এখন ডাকাতিতে যুক্ত হয়ে পড়েছে। এখন বহুমুখী আতঙ্কের শেষ নেই। এত সামাজিক অনাচার ও অঘটনের কাছে ডাকাতি যেন তুচ্ছ বিষয়। আর তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষে বদলে গেছে ডাকাতির চেহারাও। ডিজিটাল দুনিয়ায় ডিজিটাল ডাকাতি! আগের ডাকাতেরা পালিয়ে পালিয়ে বেড়াত বা আস্তানা গেড়ে লুকিয়ে থাকত। আর এখনকার ডাকাতেরা ভদ্রবেশী, উপরের তলার মানুষ। ব্যাংক সাফ করে দিয়ে বিদেশে বেগমপাড়া নামক ‘যক্ষপুরীর’ কারিগর বনে যান তাঁরা।

সেই ইংরেজের কাল ফুরিয়েছে দুই শ বছর আগে। দুই দফা দেশ স্বাধীন হয়ে আজকের বাংলাদেশের নাগরিক আমরা। সেই আমলের নদ-নদী বা ঘন বন-জঙ্গলও এখন আর নেই। তবে ডাকাতি ঠিকই থেকে গেছে, তবে তার ‘জৌলুশ’ হারিয়ে গেছে।

সে সময় আতঙ্ক মানে ছিল ডাকাত বা দস্যু দল। শিশুদের ঘুম পাড়ানোও হতো ডাকাতের ভয় দেখিয়ে। এখন সেই ভয় আগের মতো নেই, সেটিকে আরও বড় ভয় এসে গিলে খেয়েছে। আগে যারা ডাকাত ধরত, তারাই এখন ডাকাতিতে যুক্ত হয়ে পড়েছে। ভোট ডাকাতির কথাতো না বললেই নয়।

এখন বহুমুখী আতঙ্কের শেষ নেই। এত সামাজিক অনাচার ও অঘটনের কাছে ডাকাতি যেন তুচ্ছ বিষয়। আর তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষে বদলে গেছে ডাকাতির চেহারাও। ডিজিটাল দুনিয়ায় ডিজিটাল ডাকাতি!

আগের ডাকাতেরা পালিয়ে পালিয়ে বেড়াত বা আস্তানা গেড়ে লুকিয়ে থাকত। আর এখনকার ডাকাতেরা ভদ্রবেশী, উপরের তলার মানুষ। ব্যাংক সাফ করে দিয়ে বিদেশে বেগমপাড়া নামক ‘যক্ষপুরীর’ কারিগর বনে যান তাঁরা। ফলে ঘরবাড়ি বা রাস্তাঘাটে ডাকাতির খবর নিয়ে মাথা ঘামানো মানে সাবেকি আমলে পড়ে থাকা, এখনকার আধুনিক মানুষের স্ট্যাটাসের সঙ্গে যায় না!

সড়কে প্রায় দিনই ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। পত্রপত্রিকা উল্টালে বা গুগলে সার্চ দিলে ডাকাতির ভূরি ভূরি ঘটনা হাজির হবে। কদিন আগেও ক্রসফায়ারে ডাকাত মারার খবর ছিল। যদিও সেই ডাকাত মারা হয়েছিল বিচারবহির্ভূতভাবে।

একসময় দূরপাল্লার বাসে ডাকাতি রোধে বেশ কিছু জোরালো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। এক দশক আগেও চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা আসার পথে মনে পড়ে বাসে ওঠার পরে ভিডিও ক্যামেরায় সব যাত্রীর চেহারা ভিডিও করে রাখা হতো। এমনকি চালকের আসনের পেছন বরাবর একটি লোহার গেট আটকিয়ে যাত্রীদের আলাদা করে ফেলা হতো নিরাপত্তার জন্য। আর নির্দিষ্ট কাউন্টার ছাড়া রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে যাত্রী নেওয়ারও কোনো সুযোগ ছিল না।

মঙ্গলবারের ঘটনার পর হাইওয়ে পুলিশ জানায়, পরিবহনমালিকদের দায়িত্বহীনতা ও উদাসীনতা, চালক-সহকারী ও সুপারভাইজারদের গাফিলতি, দূরপাল্লার নৈশকোচে মাঝরাস্তায় যাত্রী তোলা ও নামানো এবং বাসে যাত্রী তোলার আগে ভিডিও করে রাখার নির্দেশ অমান্য করার কারণেই সড়কে-মহাসড়কে যানবাহনে ডাকাতির মতো ঘটনা ঘটছে।

ডাকাতি ও ধর্ষণ শেষে বাসটি রাস্তার এক পাশে ফেলে পালিয়ে যায় ডাকাতেরা। এর মধ্যে কয়েকজন ডাকাতকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ

হাইওয়ে পুলিশের এ বক্তব্য অবশ্যই যুক্তিসংগত এবং বাস্তবতাও তা-ই বলে। কিন্তু বাস্তবতা এটাও বলে, হাইওয়ে পুলিশের ব্যর্থতাও কি এখানে প্রকাশ পায় না?

নিন্দুকেরা বলে থাকেন, মহাসড়কে কোথায় কী ঘটছে কোনো কিছুই হাইওয়ে পুলিশের অজানা থাকে না। মহাসড়কে যেসব জায়গায় ডাকাতি হয়, সেসব স্থান চিহ্নিতই বলা চলে। হাইওয়ে পুলিশ চাইলেই মহাসড়কক ডাকাতিমুক্ত করতে পারে, কিন্তু সেদিকে তাদের মনোযোগ নেই।

পরিবহনমালিকেরা অভিযোগ করে থাকেন, হাইওয়ে পুলিশের বেশি নজর থাকে ট্রাকের দিকে; কারণ, সেখানেই তাদের লাভ। এখানে এমন প্রশ্নও তৈরি হয়, ডাকাতির ভাগ–বাঁটোয়ারাও তাদের পকেটে যায় কি না। আবার সরকারি অস্ত্র নিয়ে পুলিশের ডাকাতির ঘটনাও এ দেশে ঘটে থাকে।

পুলিশের রেকর্ড বলছে, ওই এলাকায় গত ১৩ বছরে চলন্ত বাস নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ডাকাতির সময় চারজন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। ডাকাতি করতে গিয়ে এভাবে নারী ধর্ষণের বিষয়টি চূড়ান্ত অমানবিকতা। একসময় নিষ্ঠুরতা ও নির্মমতার পাশাপাশি ডাকাতদের মধ্যে ‘মানবিকতাও’ ছিল।

‘বাঙলার ডাকাত’ বইতেই আমরা তেমন ‘দয়াবান’ ডাকাতের দেখা পাই, যারা কিনা পথেঘাটে দলবদ্ধ মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সর্বস্ব লুটে নিতেন; কিন্তু নারী ও শিশুদের ব্যাপারে খুবই সংবেদনশীল ছিলেন।

যেমন বিখ্যাত মনোহর ডাকাত দলবল নিয়ে ডাকাতি করে ফেরার সময় মৃতপ্রায় এক নারী ও তাঁর শিশুকে উদ্ধার করেছিলেন। সেবা–শুশ্রূষা করে ওই নারীকে বাঁচানো না গেলেও ওই শিশুকে কোলেপিঠে মানুষ করে শিক্ষিত করেছিলেন। শেষ বয়সে তো মনোহর ডাকাত তার ডাকাতির সব অর্থ সেই ছেলের হাতেই তুলে দিলেন, যাতে পানির কষ্টে থাকা এলাকাবাসীর জন্য পুকুর খনন করা হয়।

দক্ষিণ কলকাতায় এখনও মনোহর পুকুর রোড বিদ্যমান। তার মতো দুলাল ডাকাত, মানিক ডাকাত, নবীন ডাকাতের মতো অনেক ডাকাত ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে খাবার তুলে দিয়েছেন, কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার কন্যার বিয়ের ব্যবস্থা করেছেন, পুকুর সংস্কার করেছেন, বিদ্যালয় ও হাসপাতাল করে দিয়েছেন। তাঁরা ছিলেন একেকজন রবিনহুড মানে অত্যাচারী বা শোষকের শত্রু আর গরিবের বন্ধু। যাঁদের মধ্যে বিখ্যাত হয়ে আছেন রঘু ডাকাত।

যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত, খগেন্দ্রনাথ মিত্র ও পাঁচকড়ি দেসহ অনেকের লেখায় তাঁর সাহস, দুর্ধর্ষতা ও বীরত্বের কথা উঠে এসেছে। কথিত আছে, অত্যাচারী নীলকরদের সম্পদ লুট করে গরিবদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন তিনি। সেই রঘু ডাকাত কখনো কোনো নারীর ওপর অত্যাচার করেননি। ডাকাতির সময় নাকি হাতজোড় করে অনুনয়ের সঙ্গে নারীদের বলতেন—‘মা, তোমাদের গয়নাগুলো আমাদের দিয়ে দাও।’

বাংলার সেই সময়ের ডাকাতির ইতিহাস তুলে আনা এ কারণে যে তখনকার গ্রামের মানুষ মনে করত—ডাকাত হলেও তারা মানুষ, তাদের মধ্যে মনুষত্ব আছে। কিন্তু টাঙ্গাইলের ডাকাতেরা যা ঘটাল, তাতে চরম মনুষ্যত্বহীনতার পরিচয়ই আমরা পেলাম।

আবার কোনোভাবেই ডাকাতির অপরাধকে ছোটো করে দেখার সুযোগ নেই। কিন্তু সেই অপরাধকে গুরুত্বহীন করেই তোলা হয়েছে। যার জন্য সেটি রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না এবং ডাকাতিকালে দলবদ্ধ ধর্ষণের মতো বর্বরতাও আমাদের দেখতে হচ্ছে। তাদের এমন কর্মকাণ্ডে যোগেন্দ্রনাথের মতো যে কারও মনে হতে পারে, দেশে শাসন নাই। আছে কি?

  • রাফসান গালিব প্রথম আলোর সহ–সম্পাদক। ই–মেইল: galib.mujahid@prothomalo.com