যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা কাবুল ছাড়ার আগে পতাকা নামিয়ে নিচ্ছে
যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা কাবুল ছাড়ার আগে পতাকা নামিয়ে নিচ্ছে

তালেবানের কাছে হারের দায় যেভাবে ট্রাম্প-বাইডেন দুজনেরই

যুক্তরাষ্ট্রের হাউস ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির চেয়ার ও রিপাবলিকান পার্টির নেতা মাইকেল ম্যাককল গত সপ্তাহে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন। ওই প্রতিবেদনে ২০২১ সালের আগস্টে আফগানিস্তান থেকে বিপর্যয়করভাবে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের জন্য প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে দায়ী করা হয়েছে। কমিটির ডেমোক্রেটিক প্রতিপক্ষ গ্রেগরি মিকস প্রতিবেদনটিকে ‘পক্ষপাতমূলক গালগল্প’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন।

আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের জড়িত থাকা নিয়ে গত ২০ বছর ধরে যে রাজনৈতিক দোষারোপের খেলা চলছে, এটি তার সর্বশেষ উদাহরণ। আফগানিস্তান থেকে মার্কিন হস্তক্ষেপ সরিয়ে আনার পুরো আয়োজন করেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্পের আয়োজনকে কাজে লাগিয়ে বাইডেন মার্কিন হস্তক্ষেপ পুরোপুরি প্রত্যাহার করে নেন। এরপর থেকেই পাল্টাপাল্টি দোষারোপ চলে আসছে।

ট্রাম্প ২০১৬ সালে তাঁর নির্বাচনী প্রচারের সময় আফগানিস্তানের সঙ্গে তথাকথিত ‘চিরকালের যুদ্ধ’ শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তত দিনে সংঘাত ১৫ বছরে গড়িয়েছিল। ২০১০ ও ২০১২ সালের মধ্যবর্তী সময়টাতে আফগানিস্তানে যুদ্ধ সবচেয়ে তীব্র হয়েছিল। ওই সময়ে সেখানে মার্কিন সেনার সংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। বছরে কয়েক শ মার্কিন সেনা নিহত হচ্ছিল। এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের বছরে ১২ হাজার কোটি, দিনে ৩০ কোটি এবং প্রতি মিনিটে ২ লাখ ৩০ হাজার ডলার খরচ হচ্ছিল।

কিন্তু ২০১৭ সালে ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের সময় এই অবস্থা পাল্টে গিয়েছিল। তখন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে কার্যত যুদ্ধ করছিল না। হতাহতের সংখ্যা অনেক কমে গিয়েছিল। সেখানে মার্কিন সেনার সংখ্যা সব মিলিয়ে ১৮ হাজারে নেমে এসেছিল। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের খরচও বছরে এক হাজার আট শ কোটি ডলারে নেমে এসেছিল। তা সত্ত্বেও ট্রাম্প ‘চিরকালের যুদ্ধ’ শেষ করার মাধ্যমে তাঁর জনতুষ্টিবাদী অভিপ্রায়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছিলেন।

২০১৯ সালে ট্রাম্পের প্রশাসন তালেবানের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা শুরু করে। ২০২০ সালে সে সময়কার আফগান সরকারের কোনো প্রতিনিধির অংশগ্রহণ ছাড়াই যুক্তরাষ্ট্র তালেবানের সঙ্গে গোপন চুক্তি করেছিল। চুক্তিতে বলা হয়েছিল, ২০২১ সালের মে মাসের মধ্যে মার্কিন বাহিনীকে পর্যায়ক্রমে প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। চুক্তিতে ৫ হাজারের বেশি তালেবান বন্দীকে মুক্তি দেওয়ার শর্ত ছিল। বিপরীতে তালেবানের দিক থেকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল, তালেবান আফগানিস্তানকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর আশ্রয়স্থল হতে দেবে না।

এই চুক্তিটি গত এক দশকের সবচেয়ে ফলপ্রসূ পররাষ্ট্রনীতির সিদ্ধান্তের একটি মঞ্চ তৈরি করেছিল।

২০২১ সালের জানুয়ারিতে বাইডেন যখন ক্ষমতা নেন তখন আফগানিস্তানে মাত্র আড়াই হাজার মার্কিন সেনা ছিল। সংখ্যায় অল্প হলেও এই সেনারা স্থিতিশীল শক্তি ছিল। খুব কম লোকই বিশ্বাস করছিল যে, আফগান সরকারকে সুরক্ষা দিতে এবং আফগান সরকারের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করতে এই আড়াই হাজার সেনা যথেষ্ট ছিল। কিন্তু তারপরও সেই সেনারা তালেবান সেনাদের ঠেকিয়ে রাখতে সচেষ্ট ছিল।

বাইডেন বারবার দাবি করছিলেন, ট্রাম্প তালেবানের সঙ্গে যে চুক্তি করেছিলেন, সেই চুক্তির কারণে তাঁর হাত বাঁধা ছিল এবং নিতান্ত বাধ্য হয়েই তিনি আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাহারে সম্মতি দিয়েছিলেন। তবে বাইডেনের এ কথা সত্য নয়। কেননা ট্রাম্পের অন্যান্য অনেক নীতিকে উল্টে দিতে বাইডেনের কোনো সমস্যা হয়নি। এমন কোনো আইনি বা কৌশলগত বাধ্যবাধকতাও ছিল না যা তাঁকে ট্রাম্পের প্রত্যাহারের সময়রেখা মানতে বাধ্য করেছিল।

সত্যটা হলো, বাইডেন দীর্ঘদিন ধরে আফগানিস্তানে মার্কিন মিশনের বিষয়ে সন্দিহান ছিলেন এবং সেখান থেকে আমেরিকাকে সরিয়ে আনার একটা মোক্ষম সুযোগ খুঁজছিলেন। ট্রাম্প সেই সুযোগ তাঁর সামনে রেখে গেছেন দেখে তিনি পরিণতির কথা না ভেবেই সেই সুযোগটাকে গ্রহণ করেছিলেন।

২০১৯ সালে জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ওই সময় ওবামার আফগান কৌশল পর্যালোচনার সময় বাইডেন আফগানিস্তানে সন্ত্রাস দমনে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি সীমিত করার যুক্তি দেখিয়েছিলেন। সে সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন এবং সিআইএর পরিচালক লিওন প্যানেটার মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বাইডেনের বিরোধিতা করেছিলেন। তাঁরা যুক্তি দিয়েছিলেন, ইরাকে জেনারেল ডেভিড পেট্রাউস সেনা বাড়িয়ে সাফল্য পেয়েছিলেন। সেই বিবেচনায় আফগানিস্তানে তাঁরা সেনা বাড়ানোর পক্ষে ছিলেন। সে সময় বাইডেন বিতর্কে হেরে যান।

২০০৯ সালে বাইডেন আফগানিস্তানে মার্কিন সেনার পরিমাণ যে সংখ্যায় কমিয়ে আনতে প্রস্তাব করেছিলেন, ২০২১ সাল নাগাদ তার চেয়ে কম পরিমাণে নেমে এসেছিল। তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকার সময় আফগানিস্তান থেকে সেনা কমানোর পক্ষে ছিলেন, কিন্তু পুরোপুরি সরে আসার পক্ষে ছিলেন না। কিন্তু প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর তিনি আফগানিস্তান থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেন।

বাইডেন মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন এবং জুলাইয়ের মধ্যে মার্কিন বাহিনী আফগান সরকারকে না জানিয়েই বাগরাম বিমান ঘাঁটি পরিত্যাগ করে। এর পরপরই তালেবান প্রাদেশিক রাজধানী দখল করতে শুরু করে এবং কয়েক সপ্তাহের মধ্যে কাবুলের পতন ঘটে। আজকের তালেবান শাসিত আফগানিস্তানে সীমিত পরিসরে মার্কিন সেনা এবং ঠিকাদারদের একটি ছোট দল নিয়োজিত রাখা গেলে সেটি ভালো হতো কিনা তা এখন বলা কঠিন। তবে এটি আন্দাজ করা যায়, এমন একটি বিকল্প বাইডেন বেছে নিতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা করেননি।

ট্রাম্পের এখন সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এলে আফগানিস্তান নিয়ে কী করবেন, তা কেউ কখনই জানবে না। এখন প্রশ্ন হলো, তিনি কি তাঁর আগের অবস্থানে আটকে থাকবেন নাকি সমন্বয় করবেন তা বলা অসম্ভব। আজকে আমরা নাইন ইলেভেন হামলার ২০তম বার্ষিকীতে এসে যা জানতে পারছি, তা হলো, ২০০১ সালের সেই বিপর্যয়কর দিনে তালেবান আফগানিস্তানে যতটুকু অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করছিল, আজ তারা সেখানে তার চেয়ে অনেক বেশি এলাকায় নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। তালেবানের সঙ্গে ট্রাম্পের আলোচনা করাটা বেপরোয়া সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু সেই সিদ্ধান্তকে চূড়ান্ত রূপ দেওয়ার দায় বাইডেনকেও নিতে হবে।

আরব নিউজ থেকে নেওয়া

ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত

লিউক কফি হাডসন ইনস্টিটিউটের একজন সিনিয়র ফেলো।