পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে ভারত তৎপর, বাংলাদেশ কী করছে

ভারতের বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহ ও দাম স্বাভাবিক রাখতে পণ্যটির রপ্তানির ওপর ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার।

পেঁয়াজ রপ্তানিতে ভারতীয় নিষেধাজ্ঞার এই খবর পাওয়ার আগে বাংলাদেশের বাজারে ৮ ডিসেম্বর শুক্রবার সকাল ১০টা পর্যন্তও ভারতীয় পেঁয়াজ ১১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছিল।

নিষেধাজ্ঞার খবর আসার পর থেকে দফায় দফায় পেঁয়াজের দাম বাড়তে থাকে। শনিবার নাগাদ বেশির ভাগ বাজারে দেশি পেঁয়াজ ১৮০ থেকে ২০০ টাকায় আর আমদানি করা পেঁয়াজের দাম মানভেদে ১৬০ থেকে ১৯০ টাকায় উঠে যায়।  

দেশের বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহ এক দিনে এত কমে যাওয়ার কোনো কারণ নেই যে বাজারে সংকট দেখা যাবে। অতিরিক্ত মুনাফার লোভে বড় ব্যবসায়ীরা তাঁদের হাতে থাকা পেঁয়াজ বাজারে বিক্রি না করে মজুত করছেন বলেই বাজারে পেঁয়াজের কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়েছে এবং রাতারাতি মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে।

ভারত ইতিপূর্বে আগস্ট মাসে যখন প্রথম পেঁয়াজ রপ্তানির ওপর ৪০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে, তখনো ব্যবসায়ীরা রাতারাতি পেঁয়াজের দাম ৫৫ থেকে ৭০ টাকা করে ফেলেন। এর পর থেকে পেঁয়াজের বাজারের অস্থিরতা শুধু বেড়েছে।

অক্টোবরের শেষের দিকে ভারত পেঁয়াজের রপ্তানি মূল্য টনপ্রতি ন্যূনতম ৮০০ ডলার নির্ধারণ করে দেওয়ার পর আরেক দফা মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে দেশি পেঁয়াজ ১২০-১৪০ টাকা এবং ভারতীয় পেঁয়াজের দাম ১০০-১১০ টাকা হয়ে গিয়েছিল।

ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার শুল্ক আরোপ করা থেকে শুরু করে রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা দিয়ে ভারতের বাজারে পেঁয়াজের মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইছে। কারণ, পেঁয়াজ ভারতের ভোটের রাজনীতিতে খুবই স্পর্শকাতর একটি ভোগ্যপণ্য। একাধারে মসলা, সবজি ও সালাদ হিসেবে ব্যবহৃত পণ্যটির মূল্য নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারার কারণে ভারতে একাধিকবার সরকার পতনের ইতিহাস রয়েছে।

বলা হয়, ১৯৮০ সালের সাধারণ নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধীর বিজয়ের কারণ ছিল ক্ষমতাসীন সরকারের পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা। এ জন্য ইন্দিরা নিজেই এই নির্বাচনকে ‘অনিয়ন ইলেকশন’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।

শুধু তা-ই নয়, ১৯৯৮ সালে পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধি পেয়ে ৪০-৫০ রুপি হওয়ার ঘটনাটি দিল্লি ও রাজস্থানে বিধান সভা নির্বাচনে বিজেপির পরাজয়ের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক ছিল। এই কারণেই ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার ২০২৪ সালের আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের আগে যেকোনো মূল্যে ভারতীয় বাজারে পেঁয়াজের মূল্য নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে চাইছে।

ভারত সরকারের মতো বাজার নিয়ন্ত্রণে পেঁয়াজের নিজস্ব মজুত গড়ে তোলা তো দূরের কথা, অনুমতি পাওয়ার পর ব্যবসায়ীরা সময়মতো পেঁয়াজ আমদানি করছেন কি না এবং আমদানি করা পেঁয়াজ সঠিক দামে বাজারে বিক্রি করছেন কি না, এ বিষয়ে কোনো তদারকি করেনি আমাদের সরকার। ফলে এ বছর ভারত থেকে কম দামে আমদানি করা পেঁয়াজ দেশের বাজারে তিন গুণ দামে বিক্রির ঘটনাও ঘটেছে।

পেঁয়াজের মূল্য নিয়ন্ত্রণে ভারত সরকার শুল্ক আরোপ বা রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা আরোপ ছাড়াও অন্য আরও যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করে তার মধ্যে অন্যতম হলো, বিপুল পরিমাণ পেঁয়াজ মজুত করে রাখা এবং সংকটের সময় কম দামে পেঁয়াজ বিক্রি করা। এ জন্য প্রাইস স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ড (পিএসএফ) নামের একটি তহবিল আছে ভারত সরকারের।

এই তহবিলের আওতায় সাধারণত প্রতিবছর কৃষকদের কাছ থেকে ন্যায্যমূল্যে ক্রয় করে ৩ লাখ টন পেঁয়াজ মজুত করে রাখা হয়। এ বছর পেঁয়াজ উৎপাদন কম হওয়ার কারণে ভারত সরকার অতিরিক্ত ২ লাখ টন পেঁয়াজ মজুত করেছে এবং মজুত পেঁয়াজ থেকে কেজিপ্রতি ২৫ রুপি দরে বিক্রি করে চলেছে।

বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকারকে পেঁয়াজের মূল্য নিয়ন্ত্রণে ভারত সরকারের মতো তৎপর হতে দেখা যায় না। মজুতদারির কারণে পেঁয়াজের দাম বেড়ে যাওয়ার পর সরকারি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর অভিযানে নেমে বিভিন্ন সময় ব্যবসায়ীদের জরিমানা করলেও তাতে তেমন কোনো কাজ হয় না।

পেঁয়াজের উৎপাদন কম হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ভারত সরকার যখন রপ্তানি নিয়ন্ত্রণে একের পর এক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, বাংলাদেশ সরকার তখন ব্যবসায়ীদের পেঁয়াজ আমদানির অনুমোদন দিয়েই দায় সেরেছে।

ভারত সরকারের মতো বাজার নিয়ন্ত্রণে পেঁয়াজের নিজস্ব মজুত গড়ে তোলা তো দূরের কথা, অনুমতি পাওয়ার পর ব্যবসায়ীরা সময়মতো পেঁয়াজ আমদানি করছেন কি না এবং আমদানি করা পেঁয়াজ সঠিক দামে বাজারে বিক্রি করছেন কি না, এ বিষয়ে কোনো তদারকি করেনি। ফলে এ বছর ভারত থেকে কম দামে আমদানি করা পেঁয়াজ দেশের বাজারে তিন গুণ দামে বিক্রির ঘটনাও ঘটেছে।

সরকার জুন মাসে ব্যবসায়ীদের ১৩ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমোদন দিলেও আগস্ট পর্যন্ত আমদানি হয় মাত্র ৩ লাখ টন। এ বিষয়ে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘দেশের কৃষকের কাছে এখনো তুলনামূলক পেঁয়াজের মজুত আছে। কাজেই ভারত পেঁয়াজ রপ্তানিতে ৪০ শতাংশ শুল্কারোপ করলেও দেশে পেঁয়াজের দামে তেমন প্রভাব পড়বে না। শুল্কারোপের ঘোষণায় এখন দাম কিছুটা বাড়লেও কয়েক দিন পর কমে আসবে। তুরস্ক, মিসর ও চায়না থেকেও পেঁয়াজ আমদানির চেষ্টা করা হবে।’

এভাবে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন ও মজুতকে যথেষ্ট হিসেবে দেখিয়ে সময়মতো আমদানি না করা এবং সংকট ঘনীভূত হওয়ার পর আমদানি করেও ফল না পাওয়ার ঘটনা নতুন নয়।

ক্ষমতাসীন সরকারের মন্ত্রীরা প্রায়ই বলে থাকেন, দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে গেছে। অথচ দেখা যায়, প্রতিবেশী দেশ চাল, চিনি, পেঁয়াজ ইত্যাদি পণ্য রপ্তানি বন্ধ করলেই দেশে এসব পণ্যের সংকট তৈরি হয়ে যায়।

এর আগে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। তখনো পেঁয়াজের দাম বাড়তে বাড়তে কেজি ৩০০ টাকার কাছাকাছি হয়। এর পরের বছরও ২০০ টাকা ছাড়ায়।

আসলে দেশে পেঁয়াজের চাহিদা ও উৎপাদনের পরিমাণের নিয়ে একধরনের অস্পষ্টতা রয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছর দেশে পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়েছে ৩৪ লাখ টনের বেশি। দেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা ২৬ থেকে ২৮ লাখ টন। চাহিদার চেয়ে এ রকম বাড়তি উৎপাদন হলে তো দেশে পেঁয়াজের যথেষ্ট মজুত থাকার কথা।

কৃষিমন্ত্রী এবং বাণিজ্যমন্ত্রীও বলেছেন, দেশে পেঁয়াজের কোনো ঘাটতি নেই। তাঁদের বক্তব্য সঠিক হলে তো দেশে পেঁয়াজ আমদানির প্রয়োজন হওয়ার কথা নয়। তাহলে সরকার পেঁয়াজ আমদানির অনুমোদন কেন দিল?

প্রকৃতপক্ষে দেশে প্রতিবছর কী পরিমাণ পেঁয়াজের প্রয়োজন, তার কত অংশ দেশীয় উৎপাদনের মাধ্যমে মেটানো সম্ভব এবং কত অংশ আমদানির মাধ্যমে পূরণ করতে হবে, এ বিষয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য না থাকায় মজুতদারেরা তার সুযোগ গ্রহণ করেন এবং সুযোগ পেলেই কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়িয়ে দেন।

এ বিষয়ে আজ থেকে ১০ বছর আগে খাদ্যনীতি ও গবেষণাবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (ইফপ্রি) যে গবেষণা রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল, তা এখনো সমানভাবে প্রযোজ্য।

ইফপ্রির সেই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, কেবল ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি কমার কারণেই যে বাংলাদেশের বাজারে পেঁয়াজের সংকট তৈরি হয়েছে তা নয়, এর জন্য আরও যে বিষয়টি দায়ী তা হলো, পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে অতি মুনাফা করার জন্য ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত পেঁয়াজ মজুত করা।

এই সমস্যা এড়ানোর জন্য ইফপ্রি যেসব সুপারিশ করেছিল তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, পেঁয়াজ আমদানির জন্য ভারতের ওপর একক নির্ভরশীলতা হ্রাস করে চীন, মিসর, মিয়ানমার, পাকিস্তান, তুরস্ক, ভিয়েতনাম ইত্যাদি দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানির উদ্যোগ নেওয়া; বাংলাদেশে, বিশেষত সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে পেঁয়াজের সংকট বেশি হয় বলে এই সময়ে পেঁয়াজের মজুতদারি বিষয়ে তদারকি বৃদ্ধি; সরকার কর্তৃক সময়মতো ও পরিমাণমতো পেঁয়াজ আমদানির উদ্যোগ; পেঁয়াজের উৎপাদন ও চাহিদার বিষয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যের অসামঞ্জস্যতা দূরীকরণ এবং দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন আরও বাড়িয়ে আমদানি নির্ভরতা হ্রাস।

সুতরাং সরকার যদি দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন নিয়ে বিভ্রমে আটকে না থেকে উৎপাদন আরও বাড়ানোর উদ্যোগ নিত, যদি কৃষকদের কাছ থেকে ন্যায্যমূল্যে পেঁয়াজ কিনে মজুত করে রেখে সংকটের সময় ন্যায্যমূল্যে বিক্রির ব্যবস্থা করত, যদি পেঁয়াজ আমদানির জন্য ভারতের বিকল্প অনুসন্ধান করত এবং সময়মতো আমদানির উদ্যোগ নিত, তাহলে আজ পেঁয়াজের দাম নিয়ে এই অরাজকতা চলতে পারত না।

এমনকি আগস্ট মাসে ভারত পেঁয়াজ রপ্তানির ওপর শুল্ক নির্ধারণের সঙ্গে সঙ্গে যখন বাজারে অস্থিরতা বেড়ে গেল, তখনো সরকার বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহ বৃদ্ধি এবং ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়ার জন্য কোনো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেনি, যা জনগণের পকেট কাটায় সিন্ডিকেটকে পৃষ্ঠপোষকতা করারই নামান্তর।

  • কল্লোল মোস্তফা বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবেশ ও উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক লেখক
    kallol_mustafa@yahoo.com