শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস

বৌদ্ধিক সমাজের আকাঙ্ক্ষা ও বুদ্ধিজীবীদের দায়

আজ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে পালিত হলেও পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদররা ১৯৭১ সালে বুদ্ধিজীবী হত্যা শুরু করেছিল অনেক আগে থেকে। প্রথম দফায় ২৫ মার্চ রাতে অনেক বুদ্ধিজীবী নিহত হয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের একেবারে চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে পাকিস্তানি বাহিনী যখন বুঝতে পারে তাদের পরাজয় অনিবার্য, তখন তারা তালিকা করে বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞ চালায়। সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন, নিজামুদ্দীন আহমদ, আ ন ম গোলাম মোস্তফাকে হত্যা করা হয়েছিল ১৪ ডিসেম্বরের আগেই। সেন্ট্রাল রোডের বাসা থেকে মুনীর চৌধুরীকে ও আত্মীয়ের বাসা থেকে মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকে তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়। অধ্যাপক গোবিন্দ চন্দ্র দেব, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, রাশীদুল হাসান, আবুল খায়ের, আনোয়ার পাশা, শহীদুল্লা কায়সার, আলতাফ মাহমুদ, গিয়াসউদ্দিন আহমদ, ডা. ফজলে রাব্বী, ডা. আলীম চৌধুরী, সেলিনা পারভীনসহ অন্যদের বাসা থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করে ঘাতকেরা। এর বাইরেও মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানি বাহিনী সারা দেশে অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে।

বুদ্ধিজীবী কথাটা ১৯৬০-এর দশকে প্রথম আমাদের সামনে আসে। তার আগে কলকাতায় কিংবা ঢাকায় কারও লেখায় এই শব্দ পাওয়া যায় কি না, তা খুঁজে দেখা যেতে পারে। ১৯৬০-এর দশকে বুদ্ধিজীবী সম্পর্কে একাধিক ধারণা পাওয়া যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, চিন্তক, গবেষক, সাহিত্যিক ও শিল্পীরা অভিহিত হয়েছেন বুদ্ধিজীবী বলে। ধারণা করা হয়েছে যে বুদ্ধিজীবীরা নতুন ধারণা নিয়ে জনসাধারণকে উন্নত চিন্তায় ও কর্মে উদ্দীপ্ত করেন। তাঁরা কাজ করেন সর্বজনীন কল্যাণে, পরিচালিত হন অন্তরের তাগিদে, ব্যক্তিগত ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে। সরকারের কিংবা সমাজপতিদের ভয়ে কিংবা কোনো প্রলোভনে তাঁরা তাঁদের অন্তরের নির্দেশকে অমান্য করে কিছু করেন না।

আমাদের দেশ যখন পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত ছিল, তখন পাকিস্তানবাদীরা রাজনীতির ক্ষেত্রে মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম, জামায়াতে ইসলামী প্রভৃতি দলের নেতা-কর্মীরা ও তাদের সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ প্রচারে তৎপর ছিলেন। তাঁদের চেষ্টা ছিল জবরদস্তিমূলক। পাকিস্তানের রাষ্ট্রকাঠামোতে পূর্ব বাংলার গবেষক-চিন্তকেরা, শিল্পী-সাহিত্যিকেরা এবং ছাত্র-তরুণেরা পাকিস্তান জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করে নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্য অবলম্বন করে বিকশিত করেন ‘পূর্ব বাংলার বাঙালি জাতীয়তাবাদ’। এর জন্য অনেক সাধনা, অনেক সংগ্রাম ও ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে।

বাংলাদেশের যে বুদ্ধিজীবীরা আগে ‘বুদ্ধিজীবী’ বলে নিজেদের পরিচয় লেখেন, তাঁরা এখন ‘বিশিষ্ট নাগরিক’ বলে পরিচয় দেন। কেন এই পরিবর্তন, তা তলিয়ে দেখা দরকার। ২০০ বছর আগে দার্শনিক হেগেল লিখেছিলেন, ‘ইতিহাসের শিক্ষা এই যে ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না।’ কথাটি কি তিনি ঠিক বলেছেন? গত ২০০ বছরে এ ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন কি ঘটেনি? আমার তো মনে হয় যে নেতারা যুগান্তকারী কাজ করেছেন তাঁরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমানকে ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে বুঝতে চেয়েছেন এবং জনসাধারণকে নিয়ে মহত্তর সম্ভাবনাকে বাস্তবায়নের জন্য সংগ্রাম করেছেন।

শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের ছয় দফা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। এই সংগ্রামের ধারায় নেতৃত্বে ছিলেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখ। বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এই ধারায় যাঁরা নেতৃত্বে ছিলেন, তাঁদের মধ্যে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌, ড. কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল ফজল, অধ্যাপক মুহম্মদ আবদুল হাই, আবদুল হক, ডাক্তার মুহম্মদ মর্তুজা, বদরুদ্দীন উমর প্রমুখের নাম স্মরণীয়। ঘটনাপ্রবাহ সরলরৈখিক গতিতে চলেনি, আঁকাবাঁকা পথ ধরে, চড়াই-উতরাই অতিক্রম করে সামনে চলতে হয়েছে। এক দিকে ছিল রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং অপর দিকে ছিল সর্বস্তরের জনগণ। যারা বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছে, শেষ পর্যায়ে তাদের সংখ্যা ও শক্তি ছিল নিতান্ত কম।

পাকিস্তানকালে বুদ্ধিজীবীদের কার্যকলাপের সমালোচনা হয়েছে। সেনাপতি আইয়ুব খানের শাসনামলে বিএনআর (ব্যুরো অব ন্যাশনাল রিকনস্ট্রাকশন), পাকিস্তান কাউন্সিল ফর ন্যাশনাল ইন্টিগ্রিটি, পাকিস্তান লেখক সংঘ গড়ে তোলা হয়েছিল পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে। কিন্তু সে প্রয়াস সফল হয়নি। পূর্ব বাংলার যে লেখক-বুদ্ধিজীবীরা ওই সময় ওই সব সংস্থার দ্বারা পরিচালিত কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেছেন, তাঁরা নানাভাবে নিন্দিত হয়েছেন। নিন্দিত ব্যক্তিদের সংখ্যা অনেক ছিল। সরকার তাঁদের সহায়তা করেছে। বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও প্রগতিশীল ধারায় যাঁরা ছিলেন, তাঁদের এগোতে হয়েছে বাধাবিপত্তি মোকাবিলা করে। উল্লেখ্য, পাকিস্তানকালে আওয়ামী লীগের ধারায় তখন বুদ্ধিজীবী প্রায় ছিলেন না। বুদ্ধিজীবী প্রধানত ছিলেন বামপন্থী ধারায়। ১৯৭২ সাল থেকে তাঁদের অনেকেই আওয়ামী লীগের সমর্থক হয়ে যান। এখন আওয়ামী লীগের সমর্থক বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা অনেক বেশি।

পাকিস্তানকালে ও স্বাধীন বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবীরা কী করেছেন এবং তাঁদের কাজের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য কী ছিল, প্রগতির প্রয়োজনে তা বিচার করে দেখা দরকার। মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধুর শাসনকালে বুদ্ধিজীবীদের একাংশ আওয়ামী লীগ সরকারের সমর্থক হয়ে যান। অনেকেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হন। কোনো নীতিগত বা আদর্শগত কারণে নয়, কেবল ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের জন্য এই বুদ্ধিজীবীরা তৎপর ছিলেন। এতে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

তখন অধ্যাপক আহমদ শরীফ, অধ্যাপক আবু মাহমুদ, বদরুদ্দীন উমর, সরদার ফজলুল করিম প্রমুখের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে বুদ্ধিজীবীদের আরেকটি ধারা। এ ধারার বুদ্ধিজীবীরা আওয়ামী লীগ সরকারের ভুলত্রুটির কঠোর সমালোচনা করেন। বুদ্ধিজীবীদের এই ধারা বঙ্গবন্ধু সরকারের পর বাস্তবসম্মত, যুক্তিসংগত কোনো ধারা অবলম্বন করে অগ্রসর হতে পারেনি। সামরিক শাসক জিয়া ও এরশাদের শাসনামলে আওয়ামী লীগ ও বামপন্থী দলগুলো কেবল সরকার উৎখাতের জন্য আন্দোলন করে। জাতীয় সংসদ ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ব্যাপারগুলো তখন প্রহসনে পরিণত হয়। এসবের বিরুদ্ধে পরিচালিত আন্দোলনকে অভিহিত করা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন হিসেবে। রাজনৈতিক বিচারের আন্দোলন তখন অন্তঃসারশূন্য নগ্ন ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে পরিণত হয়।

এটা ঠিক যে এরশাদের আমলে আওয়ামী লীগ ও বামপন্থী ধারার বুদ্ধিজীবীরা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে অত্যন্ত সক্রিয় ছিলেন। তাঁরা কেবল স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন করেছেন। কোনো উন্নত রাজনৈতিক চিন্তা বা কর্মসূচি অবলম্বন করেননি। বিরাজনীতিকরণ কথাটা তখন থেকে চলছে। গণতন্ত্র বলতে বোঝানো হচ্ছে কেবল নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন। রাজনীতিকে পরিণত করা হয়েছে ক্ষমতায় যাওয়ার হাতিয়ারে।

বাংলাদেশের রাজনীতি অবশ্যই নিম্নগামী। যে বুদ্ধিজীবীরা সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশনগুলোতে থেকে জাতীয় রাজনীতির গতি ও প্রকৃতি নির্ধারণ করে চলছেন, তাঁদের ভূমিকা দ্বারা রাজনীতির নিম্নগামিতাই অব্যাহত আছে। আমার এসব কথা আমাদের রাজনীতির গুণগত মান উন্নয়ন ও বৌদ্ধিক সমাজ নির্মাণের জন্য। বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা বিচারে গেলে এসব ঘটনার তথ্যাদি ও ভূমিকা গভীরভাবে বিচার করে দেখার প্রয়োজন আছে। সবার কল্যাণে রাজনীতির উন্নতি কাম্য।

বাংলাদেশের যে বুদ্ধিজীবীরা আগে ‘বুদ্ধিজীবী’ বলে নিজেদের পরিচয় লেখেন, তাঁরা এখন ‘বিশিষ্ট নাগরিক’ বলে পরিচয় দেন। কেন এই পরিবর্তন, তা তলিয়ে দেখা দরকার। ২০০ বছর আগে দার্শনিক হেগেল লিখেছিলেন, ‘ইতিহাসের শিক্ষা এই যে ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না।’ কথাটি কি তিনি ঠিক বলেছেন? গত ২০০ বছরে এ ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন কি ঘটেনি? আমার তো মনে হয় যে নেতারা যুগান্তকারী কাজ করেছেন তাঁরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমানকে ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে বুঝতে চেয়েছেন এবং জনসাধারণকে নিয়ে মহত্তর সম্ভাবনাকে বাস্তবায়নের জন্য সংগ্রাম করেছেন। ভবিষ্যতে ইতিহাসের শিক্ষাকে, অভিজ্ঞতাকে, কাজে লাগানোর চেষ্টা বাড়বে। অতীতের ভুলের পুনরাবৃত্তি যাতে না হয়, তার জন্য চেষ্টা করতে হবে।

বাংলাদেশের বৌদ্ধিক চরিত্র সম্পর্কে সচেতনতা দরকার। কোনো রাজনৈতিক আমলে বুদ্ধিজীবীদের সংখ্যা বাড়লেই যে সেই দল উন্নততর, রাজনৈতিক চরিত্র লাভ করবে, তা নয়। বৌদ্ধিক চরিত্রের উন্নতি দরকার। বৌদ্ধিক চরিত্রের উন্নতি ছাড়া বাংলাদেশের রাজনীতির উন্নতি হবে না। বাংলাদেশে জাতি গঠন, রাষ্ট্র গঠন ও জনজীবনের উন্নতির জন্য বৌদ্ধিক চরিত্রের উন্নতি অপরিহার্য।

একাত্তরে যেই বুদ্ধিজীবীদের আমরা হারিয়েছি, তঁাদের স্মরণেই শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসটি পালন করা হয়। কিন্তু এই দিবসটি পালন তখনই সার্থক হবে, যখন যেই মানবতাবাদী বৌদ্ধিক ও যুক্তিবাদী সমাজের স্বপ্ন তাঁরা দেখেছিলেন, সেটি বাস্তবায়িত হবে।

  • অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে আহমদ শরীফ অধ্যাপক চেয়ার