মতামত

চাই সব মানুষের জন্য সব ভাষার সাহিত্য

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য সাহিত্যের বই ব্রেইলে প্রকাশ করছে ‘স্পর্শ’। বাংলাদেশে পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্যান্য বই পড়ার সুযোগ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের (স্পর্শ যাঁদের দৃষ্টিজয়ী বলে অভিহিত করে) নেই বললেই চলে। তাই স্পর্শের উদ্যোগটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারা প্রায় ১৫০টি বই ব্রেইলে প্রকাশ করেছে।

স্পর্শের প্রধান উদ্যোক্তা নাজিয়া জাবীন জানান, ‘১৬ বছর ধরে আমরা বলে আসছি, প্রতিটা বই ছাপায়, ব্রেইলে ও অডিওতে প্রকাশ করা হোক। কিন্তুর অন্যরা এগিয়ে আসছেন না।’

সংশ্লিষ্ট সবার সদিচ্ছা থাকলে ব্রেইলে সাহিত্যের বইয়ের সংখ্যা আরও অনেক বেশি হতো। ব্রেইলে বই ছাপাতে প্রকাশদের উদ্যোগী হওয়া উচিত। লেখকদেরও তাঁদের লেখা বই ব্রেইলে প্রকাশ করার ব্যাপারে আগ্রহী হতে হবে। সাহিত্যে তো সবার অধিকার আছে, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা সাহিত্য পাঠ থেকে বঞ্চিত হবেন কেন?

যাঁরা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বা অন্য কোনো প্রতিবন্ধিতার শিকার, তাঁদের সাহিত্য, বিনোদন, খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করা প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের দেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাঁরা সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত। বিষয়টি মনে পড়ে গিয়েছিল মেলবোর্নে আন্তর্জাতিক পুষ্প ও বাগান প্রদর্শনীর একটা বাগান দেখে। বাগানটির নাম ‘থ্রু দ্য কি হোল’। নকশা জেমস ডসনের।

বাগানটি ছিল ক্ষীণদৃষ্টিসম্পন্ন, দৃষ্টিহীন ও দৃষ্টি আছে, এমন সব মানুষের জন্য। নকশা এমনভাবে করা হয়েছিল, যাতে যাঁরা কম দেখতে পান বা একেবারেই দেখতে পান না, তাঁরা সহজেই হাঁটতে পারেন। দৃষ্টি ছাড়া অন্য সব ইন্দ্রিয় (ঘ্রাণ, শ্রবণ, স্পর্শ, স্বাদ) ব্যবহারের সুপরিকল্পিত সুযোগ তৈরি করা হয়েছিল। এক অংশে সুতীব্র ঘ্রাণযুক্ত বিভিন্ন ধরনের গুল্ম। শব্দের জন্য ফোয়ারা, স্বাদের জন্য ফল (স্ট্রবেরি) এবং সবজির (ক্যাপসিকাম, মরিচ, ভুট্টা) বাগান। এ ছাড়া ছিল স্পর্শ করা যায় তেমন কাঠামো।

আসলে আমরা যদি সবার জন্য বাসযোগ্য একটি সমাজে বিশ্বাস করি, তাহলে অনেক কিছুই করা সম্ভব—বাগানটির নকশা তার প্রমাণ। বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার মানসিকতা থাকলে ব্রেইলে সাহিত্যের বই প্রকাশ করা হবে সাধারণ ঘটনা।

শুধু যে সব পাঠকের কথা ভাবতে হবে, তা নয়, মনোযোগ দিতে হবে সব ভাষার বইয়ের দিকে। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ‘বাংলাদেশের নানান ভাষা’য় জানিয়েছেন, বাংলাদেশে প্রায় ৩৭টি ভাষাভাষী নাগরিকের বাস। বইটিতে লেখক সেসব ভাষার পরিচয় দিয়েছেন। ককবরক, খাসি, গারো, চাক, চাকমা, তঞ্চঙ্গ্যা, বম, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি, মারমা, ম্রো, রাখাইন, সাঁওতালিসহ নানা ভাষার বর্ণমালা তুলে ধরেছেন। সেসব ভাষায় লেখা কবিতা ও তাঁর বাংলা অনুবাদও আছে। সূচিতে ভাষাগুলোকে সাজানো হয়েছে বর্ণমালার ক্রম অনুসারে। যেমন বাংলার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে বম ভাষার পর। এতে সব ভাষার সমান গুরুত্বটাই প্রকাশিত। লেখকের মতে, ‘একুশে ফেব্রুয়ারি সকল ভাষার কথা বলে—এ বিশ্বাসেই এই গ্রন্থের প্রণোদনা ও স্ফূর্তি।’

কিন্তু আমরা কি সব ভাষা রক্ষা ও প্রসারের ব্যাপারে আন্তরিক? বাংলাদেশে বাংলা ছাড়া অন্যান্য আদিবাসী ভাষার সাহিত্যের বই প্রকাশের অবস্থা কী? সেসব ভাষার সাহিত্য কি বাংলায় অনূদিত হচ্ছে? বাংলাদেশে প্রতিবছর যত সৃজনশীল বই ছাপা হয়, তার মধ্যে এ ধরনের বইয়ের সংখ্যা কত? এর উত্তরে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রংয়ের এক সাক্ষাৎকারে দেওয়া বক্তব্য প্রাসঙ্গিক, ‘ভাষা টিকে থাকে সাহিত্যে। বাংলাদেশে আদিবাসীদের ভাষায় কয়টি সাহিত্যকর্ম এখন রচিত হয়, প্রকাশ হয়, এদিকে লক্ষ করলেই বিষয়টি অনুধাবন করা যাবে। বাংলাদেশের ১৪টি ভাষাকে বিলুপ্তপ্রায় ঘোষণা করা হয়েছে। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে যে দেশের মানুষেরা শহীদ হয়েছেন, সেই দেশে ভাষা হারিয়ে যাবে, ভাষা রক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হবে না, এটা দুঃখজনক।’

কিছুদিন আগে ম্রো ভাষায় রচিত রূপকথা ও এর বাংলায় অনুবাদ একই বইয়ে প্রকাশিত হয়েছে। খুব সহজে বলা গভীর গল্পগুলো পড়তে পড়তে ভাবছিলাম, এ রকম আরও অনেক বই চাই। বাংলাদেশের বিভিন্ন ভাষার সাহিত্যের রস নিতে না পারা পাঠক হিসেবে আমাদের বিরাট ক্ষতি।

বাংলা ভাষাভাষী অনেকে নিজেদের অজ্ঞতার কারণে আদিবাসী মানুষ, তাঁদের ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করেন, যা কোনো কোনো ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক আচরণের জন্ম দেয়। সাহিত্যের আদান-প্রদান আদিবাসী মানুষদের নিয়ে তাঁদের সংবেদনশীলতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে পারে।

বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা ইনস্টিটিউট আছে। সেখানে বিদেশি ভাষার কোর্স করা যায়, কিন্তু বাংলাদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভাষা নিয়ে কোনো বিভাগ নেই।

আমরা অনেকেই বিদেশি সাহিত্য ইংরেজি বা বাংলা অনুবাদে পড়তে অভ্যস্ত। তা ঠিক আছে। কিন্তু আমাদের কি নিজ দেশের অন্যান্য ভাষার সাহিত্য সম্পর্কে আরও আগ্রহী হওয়া উচিত নয়? সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় প্রকাশকদের এ বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিতে পারে। বাংলা একাডেমি ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের উচিত বাংলাদেশের আদিবাসীদের ভাষাগুলোতে সাহিত্য প্রকাশ এবং সেসবের বাংলা অনুবাদে অগ্রণী ভূমিকা পালন করা। প্রকাশকের দায়িত্ব আছে দেশের সব ভাষার বই প্রকাশ করার, পাশাপাশি পাঠকেরাও এতে আগ্রহ দেখালে হয়তো এ ধরনের বইয়ের প্রকাশ বাড়বে।

বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা ইনস্টিটিউট আছে। সেখানে বিদেশি ভাষার কোর্স করা যায়, কিন্তু বাংলাদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভাষা নিয়ে কোনো বিভাগ নেই।

ইউনেসকোর মতে, বর্তমান শতাব্দী শেষ হওয়ার আগেই বিশ্বের তিন হাজার ভাষা হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ২০২২-৩২ সময়কালকে আন্তর্জাতিক আদিবাসী ভাষা দশক হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এর লক্ষ্য বিপন্ন ভাষাগুলোকে টিকিয়ে রাখা, জাতীয়-আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সহযোগিতার মাধ্যমে সবার ভাষিক অধিকার নিশ্চিত করা। দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই আমাদের সক্রিয় হতে হবে, যাতে বাংলাদেশের সব ভাষাকে রক্ষা করা যায়।

‘মানুষ দৃষ্টিহীন বলেই অন্ধ নয়, মানুষ মূলত প্রজ্ঞাহীন বলেই অন্ধ’—স্পর্শের এ স্লোগান খুব তাৎপর্যপূর্ণ। আমরা যখন প্রজ্ঞাবান হয়ে সমাজটাকে সব মানুষের জন্য আরও বাসযোগ্য করে তুলতে পারব, তখন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী, বাংলাদেশের আদিবাসী নাগরিকসহ সবাই সমানভাবে সাহিত্য উপভোগ করতে পারবেন, বইমেলাকে নিজের বলে ভাবতে পারবেন।

‘আমার এ দেশ সব মানুষের’ হতে আর কত দিন?

  • লায়লা খন্দকার উন্নয়নকর্মী