রাগী তরুণের ভালোবাসা

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
ছবি: প্রথম আলো

১৯৮০ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত আমি ঢাকা কলেজে পড়েছি। স্বনামধন্য আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন। কিন্তু আমি তাঁর ক্লাস করতাম না বেশি। ঢাকা কলেজে তিনি যখন ক্লাস নিতেন, অন্য সেকশনের ছাত্ররাও এসে ভিড় করত। স্যার নানা ধরনের গল্প বলতেন, রসিকতা করতেন। তাতে সাহিত্য থাকত, সমাজদর্শন থাকত, থাকত তরুণ বয়েসে মেয়েদের প্রতি ভালো লাগার কথাও।

স্যার কথা বলতেন আর একটু পরপর পুরো ক্লাস হাসির দমকে কেঁপে উঠত। আমি এতই আনস্মার্ট ছিলাম আর মেয়েদের বিষয়ে এতই লাজুক ছিলাম যে এসব রসিকতা ঠিকমতো বুঝতাম না। একধরনের হীনম্মন্যতা থেকেই স্যারের ক্লাস করতাম না।

স্যারের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা অনেক পরে, ২০০১ সালে দেশে ফিরে বিভিন্ন নাগরিক কর্মকাণ্ড আর প্রথম আলোতে লেখা শুরু করার পর। বিএনপি আমলে স্যার সুশাসন ও গণতন্ত্রের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মনে আছে, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে তীব্র আগ্রহ থেকে তিনি এ নিয়ে আমার সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করেছিলেন। স্যার পরে একটি ছোট পুস্তিকা প্রকাশ করেছিলেন এসব বিষয় নিয়ে। আমাকে এর খসড়া দেখে দিতে বলেছিলেন।

স্বাভাবিকভাবে আওয়ামী লীগ আমলে, বিশেষ করে ২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের পর আমি বিভিন্ন উদ্যোগে স্যারের অংশগ্রহণ আশা করতাম। স্যার হয়তো বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের স্বার্থে এ ধরনের আর কিছুতে জড়িত হননি। কিন্তু আমার তা তখন ভালো লাগেনি। আমি মনে করি, সমাজের অতি উচ্চাসনের মানুষদের মধ্যে যাঁরা এক আমলে সরব থাকেন, তাঁদের অন্য আমলেও সরব থাকাটা প্রয়োজন। শাসক ও শোষিত মানুষ না হলে ভিন্ন বার্তা পায়।

স্যারকে প্রশংসা করতে গিয়ে অনেক সময় অযথা অতিরঞ্জনও হয়। তিনি অনেক তরুণকে বই পড়িয়েছেন, আলোর দিকে এনেছেন। তাঁদের মধ্যে কয়জনই-বা সমাজে অন্ধকারের শক্তির বিরুদ্ধে সাহস করে দাঁড়িয়েছেন? কেন্দ্রের সূচনালগ্ন থেকে স্যারের ঘনিষ্ঠ ছিলেন, তাঁরা অনেক বই পড়েছেন ঠিকই, কিন্তু সমাজে নতুন চিন্তা-চেতনার উন্মেষে তাদের ভূমিকা কতটা?

২.

আমি স্যারকে ভালোবাসি, তাঁর কথা প্রচণ্ড মুগ্ধ হয়ে শুনি। আমার জীবনে আমি হুমায়ূন আহমেদ ও শাহাদত চৌধুরী ছাড়া আর কাউকে এত মুগ্ধ হয়ে শুনিনি। স্যার একবার বিএনপি আমলে আমাকে বললেন, এ দেশে তো নেত্রী ক্ষমতায় আসেন না, ক্ষমতায় আসে তাঁর জেলা। এক বাক্যে নৈরাজ্য আর বৈষম্যকে আর কে পারে এভাবে ফুটিয়ে তুলতে! মেয়র আনিসুল হক ভাইয়ের একটা অনুষ্ঠানে সমাজের মাথা ধরনের কিছু মানুষ যখন মেয়রকে তেল মেরে ভাসিয়ে দিচ্ছেন, তখন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার মঞ্চে এসে এই তেল মারার প্রবণতা নিয়েই খোঁচা দেওয়া শুরু করলেন! এটা শুধু স্যারই পারেন অনেক ক্ষেত্রে।

তবে আমি মনে করি, স্যারকে প্রশংসা করতে গিয়ে অনেক সময় অযথা অতিরঞ্জনও হয়। তিনি অনেক তরুণকে বই পড়িয়েছেন, আলোর দিকে এনেছেন। তাঁদের মধ্যে কয়জনই-বা সমাজে অন্ধকারের শক্তির বিরুদ্ধে সাহস করে দাঁড়িয়েছেন? কেন্দ্রের সূচনালগ্ন থেকে স্যারের ঘনিষ্ঠ ছিলেন, তাঁরা অনেক বই পড়েছেন ঠিকই, কিন্তু সমাজে নতুন চিন্তা-চেতনার উন্মেষে তাদের ভূমিকা কতটা?

আবার এও সত্য যে আশি আর নব্বইয়ের দশকে আমরা বই পড়তাম পরিবারের বড়দের দেখে বা বন্ধুদের প্রভাবে। আমার ঢাকা কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া বন্ধুদের অনেকেই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে না গিয়েও আলোর হাতছানি পেয়েছেন।
তবে সায়ীদ স্যার বই পড়াকে অনেক প্রসারিত করেছেন, বই নিয়ে ভাবার চর্চাটা সুশক্ত করেছেন। বই পড়াও হয়তো শিখিয়েছেন, কিন্তু সেটা সম্ভবত কাজী আনোয়ার হোসেন আরও বেশি করেছেন। কিছু মানুষকে তিনি অবশ্যই আলোকিত করেছেন, কিন্তু আমার মতে, তাঁর চেয়ে বেশি তা করেছেন কোনো কোনো সম্পাদক, শিক্ষক বা মানবাধিকারকর্মী।

হ্যাঁ, স্যার একটা বিশাল ইনস্টিটিউশন করেছেন। প্রতিষ্ঠানবিমুখ এ দেশে এটি বিরাট একটি বিষয়। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র মানেই ভালো লাগার একটা অনুভূতিও। আশা করি, ফজলে হাসান আবেদের মতো স্যারও ওনার অবর্তমানেও বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র যাতে নিজ চরিত্র বজায় রাখে, তা নিশ্চিত করে যাবেন।

৩.

ব্যক্তিগতভাবে আমি স্যারের কাছে নানা কারণে কৃতজ্ঞ। তিনি আমাকে কমপক্ষে চারবার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ দিয়েছেন, খুব কম হলেও লেখা পড়ে ফোন করেছেন, আমার উত্তেজনা দেখে আদর করে বাংলাদেশের সবচেয়ে রাগী তরুণ (স্যারের কাছে ছাত্ররা সব সময় তরুণ) বলেছেন। তবে এ জন্য নয়, আমি কৃতজ্ঞ এ জন্য, যেসব মানুষকে দেখলেই তাঁর মুখ স্নেহময় হাসিতে ভরে ওঠে, আমি তার একজন। হয়তো অযোগ্যই একজন!

গতকাল সোমবার ছিল স্যারের জন্মদিন। জন্মদিনের বিলম্বিত ভালোবাসা স্যার। সুস্থ শরীরে ঘরকাঁপানো হাসি নিয়ে অন্তত শত বছর বাঁচুন।
আপনাকে ভালোবাসি।

  • আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক