দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিয়ে সরকারের ভারি গর্ব ছিল এই কিছুদিন আগেও। অবিশ্বাস্য ব্যয়ে কিছু ভৌত অবকাঠামো তৈরি, ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে জিডিপির আকার, প্রবৃদ্ধি আর মাথাপিছু আয় দেখানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল সরকারি উন্নয়নের বয়ান। অথচ বর্তমান বাংলাদেশে একমাত্র রপ্তানি ছাড়া মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, রেমিট্যান্স, চলতি হিসাবের ভারসাম্য, রাজস্ব আয়ের অবস্থা, ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যের মতো সামষ্টিক অর্থনীতির বাকি সব সূচক নিম্নমুখী।
মুখে যা-ই বলুক, সরকারের আচরণ বলছে, দেশের অর্থনীতি খুব বড় সংকটের মধ্যে আছে। আইএমএফের কাছে ঋণ চাওয়া, বিলাসী পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিতকরণ, উন্নয়ন প্রকল্পগুলোকে গুরুত্ব অনুযায়ী শ্রেণিবদ্ধ করে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া বা বাতিল করা, নানাভাবে সরকারের ব্যয় সংকোচন এবং সর্বোপরি দেশে বিদ্যুৎ রেশনিং চালুর মতো নানা পদক্ষেপ চলমান সংকটের তীব্রতাকে স্বীকার করার প্রমাণ।
সরকারের মতে, এ সংকটের কারণ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এখন প্রশ্ন হলো, এটি কতটা যৌক্তিক? আর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সংকটটি কি সাময়িক, নাকি ভুগতে হবে লম্বা সময়? ১৮ জুলাই প্রথম আলোয় প্রকাশিত ‘বাংলাদেশসহ এশীয় দেশগুলোর জন্য শ্রীলঙ্কা এক সতর্কবার্তা’ শিরোনামের সংবাদে আমরা জানতে পারি, শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতিকে সামনে এনে আইএমএফ প্রধান বলেছেন, যেসব দেশে ঋণের মাত্রা উচ্চ এবং নীতিমালার পরিসর সীমিত, তারা অতিরিক্ত চাপের মুখে পড়বে। আইএমএফ প্রধানের বক্তব্যের সূত্র ধরে বিবিসির করা ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় আছে বাংলাদেশের নাম।
এটা ঠিক, ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার আগ্রাসনের প্রভাব সারা বিশ্বের সব দেশের অর্থনীতির ওপরেই কমবেশি পড়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ইউক্রেন আগ্রাসনই যদি সব দেশের চরম অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি করে থাকে, তাহলে সরকারের হিসাবে বাংলাদেশের চেয়ে কম মাথাপিছু আয়ের গরিব দেশ ভারত, নেপাল, এমনকি আফ্রিকার অনেক দরিদ্র দেশকে বিবিসি কেন শ্রীলঙ্কা হওয়ার ঝুঁকির তালিকায় রাখেনি?
বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটটি মোটেও হঠাৎ করে আসেনি এবং এটা সাময়িকও নয়। দীর্ঘ সময়ের ভয়ংকর লুটপাট দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির ভিত্তিটি একেবারে নষ্ট করে দিয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কেবল এগিয়ে এনেছে বিপর্যয়ের সময়টিকে। যে দেশে অলিগার্কদের স্বার্থে রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারিত কিংবা আইন প্রণীত হয়, সেখানে এটাই অনিবার্য পরিণতি।
আসলে গত এক যুগ দেশে যে মাত্রায় লুটপাট চলেছে, তার অনিবার্য পরিণতি এটাই হওয়ার কথা ছিল। আজকে যখন অর্থনীতি চরম সংকটে পড়েছে, তখন অনেক অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষক বলছেন, দেশের অর্থনীতি সরকারের ভুল নীতির মাশুল দিচ্ছে। বিষয়টি কি আসলেই তা-ই?
২০০৯ সালে এ সরকার ক্ষমতায় আসার পরই পরিকল্পনা করে রেখেছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে দিয়ে কীভাবে ক্ষমতায় থেকে যাবে। জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া ক্ষমতায় থাকতে গেলে একটা সরকার একনায়কতান্ত্রিক গোষ্ঠীতন্ত্রে (অলিগার্কি) পরিণত হতে বাধ্য। তাই স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশে এখন দেখতে পাই জনগণের স্বার্থকে ধ্বংস করে, অলিগার্কদের স্বার্থে একের পর এক রাষ্ট্রীয় নীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। এগুলো কোনোটাই ভুলক্রমে হয়নি, করা হয়েছে সুচিন্তিতভাবে পরিকল্পনা করে।
ব্যাংক খালি করে ফেলেছে সরকারের সঙ্গে সংযুক্ত অলিগার্করা, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেটি করা হয়েছে আইনের মধ্যে থেকেই। লুটপাটের সুযোগ দেওয়ার জন্য সরকার বাংলাদেশ ব্যাংককে ব্যাংকমালিকদের সংগঠনের (বিএবি) আজ্ঞাবহ বানিয়ে ছেড়েছে। একের পর এক আইন ও বিধি বদল করার মাধ্যমে অলিগার্কদের পরিবারের সদস্যদের আরও বেশি সংখ্যায় এবং বেশি সময়ের জন্য ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে থাকা নিশ্চিত করা হয়েছে। সর্বোপরি একেবারে তুচ্ছ পরিমাণ টাকা পরিশোধ করে ইচ্ছাকৃত হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণখেলাপিদের ঋণ পুনঃ তফসিল করে নতুন ঋণ পাওয়ার ব্যবস্থাও করে দেওয়া হয়েছে।
সাম্প্রতিক বিদ্যুৎ-সংকটের মূল যে ভাড়াভিত্তিক (কুইক রেন্টাল) তরল জ্বালানিনির্ভর কেন্দ্র থেকে অকল্পনীয় বেশি দামে বিদ্যুৎ কেনা, সেটা এখন জানে এ দেশের সাধারণ মানুষ। এসব কেন্দ্র থেকে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কেনার সঙ্গে তাদের দিতে হয় নির্দিষ্ট ভাড়া (ক্যাপাসিটি চার্জ)। এ ভাড়া দিতে হয় এমনকি কেন্দ্র বিদ্যুৎ উৎপাদন না করলেও। দুই বছরের কথা বলে আইনটি করা হলেও এই আইনের মেয়াদ দফায় দফায় বেড়েছে। অথচ দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা সর্বোচ্চ চাহিদার প্রায় দ্বিগুণ হয়েছিল বেশ আগেই।
ওদিকে সিন্ডিকেটের স্বার্থে একটির পর একটি কেন্দ্র স্থাপিত হলেও বিদ্যুৎকে মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়ার সঞ্চালন ও বিতরণ অবকাঠামো তৈরি করা হয়নি চাহিদা মোতাবেক। তাই পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের সর্বোচ্চ সক্ষমতায় উৎপাদনে যাওয়ার ক্ষমতা থাকলেও সেটা করা যাচ্ছে না সঞ্চালন ও বিতরণ অবকাঠামোর অভাবে। একই পরিস্থিতি হচ্ছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রেও।
স্পট মার্কেটে এলএনজির দাম অনেক বেশি বেড়ে যাওয়াকে সরকার সাম্প্রতিক লোডশেডিংয়ের কারণ হিসেবে দেখিয়েছে। গোড়াতেই প্রশ্ন রাখি, বাংলাদেশের আদৌ কি গ্যাস আমদানি করার প্রয়োজন ছিল? যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসজিএস, নরওয়ের জাতীয় তেল ও গ্যাস কোম্পানি এনডিপি, ডেনমার্কের গ্যাস পরামর্শ জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশের এখনো অনাবিষ্কৃত গ্যাস রিজার্ভের পরিমাণ ৩২ থেকে ৪২ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ)। দেশের ভবিষ্যতের বর্ধিত চাহিদা বিবেচনায় নিলে এই গ্যাস ২৫ থেকে ৩০ বছরের প্রয়োজন মেটাত আমাদের। অথচ নিজের দেশের গ্যাস উত্তোলন না করে এলএনজি আমদানির পথে গেছে সরকার। শুধু সেটাই নয়, দেশের এলএনজি চাহিদার পুরোটা দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে আমদানির সিদ্ধান্ত না নিয়ে স্পট মার্কেট থেকে কিনতে গেছে। এলএনজি খালাস এবং গ্যাসে রূপান্তরের টার্মিনাল, আমদানি—সবকিছুতেই আছে অলিগার্কদের সরাসরি স্বার্থ।
পদ্মা সেতুর অযৌক্তিক বিরাট ব্যয়ের ডামাডোল মিলিয়ে যেতেই হিন্দুস্তান টাইমসে অবিনাশ পালিওয়ালের কলাম আমাদের জানাল, বাংলাদেশের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যয় ভারতের তামিলনাড়ুর কুদানকুলামে তৈরি একই মানের এবং একই সক্ষমতার একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যয়ের চেয়ে অনেক বেশি। এটা সত্য বাংলাদেশের প্রতিটি অবকাঠামো প্রকল্পের ক্ষেত্রেও।
দেশে এভাবে নানা ক্ষেত্র থেকে অলিগার্করা যে অবিশ্বাস্য অঙ্কের টাকা লুট করে, তার গন্তব্য থাকে বিদেশ। গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটি দেখাচ্ছে, নির্বাচনকে সামনে রেখে পাচার বাড়ে কয়েক গুণ। গত অর্থবছরের ৯০ বিলিয়ন ডলার আমদানির কোনো ব্যাখ্যা থাকতে পারে না ব্যাংকিং চ্যানেলে (ওভার ইনভয়েসিং) টাকা পাচার হওয়া ছাড়া। এমনকি গত অর্থবছরে যে ৫০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি নিয়ে খুব উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা হচ্ছে, সেটাও সঠিক অঙ্ক নয়, কারণ রপ্তানির মাধ্যমেও বড় অঙ্কের টাকা পাচার হয় আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে।
বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটটি মোটেও হঠাৎ করে আসেনি এবং এটা সাময়িকও নয়। দীর্ঘ সময়ের ভয়ংকর লুটপাট দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির ভিত্তিটি একেবারে নষ্ট করে দিয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কেবল এগিয়ে এনেছে বিপর্যয়ের সময়টিকে। যে দেশে অলিগার্কদের স্বার্থে রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারিত কিংবা আইন প্রণীত হয়, সেখানে এটাই অনিবার্য পরিণতি।
রুমিন ফারহানা বিএনপির সংসদ সদস্য ও হুইপ এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী