১৯৭২ সালে আহমদ ছফা লিখেছিলেন বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস। ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পর আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোরও নতুন বিন্যাস দরকার। আমরা কেমন মানুষ চাই, তার ওপর দাঁড়াবে এই বিন্যাস। প্লেটোর সাম্যবাদী রাষ্ট্রকল্পনাতেও তা ছিল। তাঁর রাষ্ট্রে শিশুও রাষ্ট্রের সম্পত্তি। বলা হয়, শিশুর ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে দুই ধরনের সম্পর্কের মধ্য দিয়ে। ব্যক্তিকে এ জন্য দ্বিজও বলা হয়। প্রথমটি হলো শারীরিক আর দ্বিতীয়টি হলো চৈতন্যের। আর চৈতন্যের সঙ্গে জড়িত হলো জীবন সম্পর্কে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি গঠন, সক্রিয় ইচ্ছাশক্তি ও চারপাশের বুদ্ধিবৃত্তিক পরিস্থিতির মানের ওপর।
শিশুরা ভালোবাসতে ও ভালোবাসা পেতে চায়। যাদের তারা ভালবাসে, তাদের অনুকরণ করে, হাবভাব গ্রহণ করে। জিনিসপত্র, লোকজন ও ঘটনা সম্পর্কে তাদের মূল্যায়ন ধার করতে চায়। শিশুরা বড়দের জীবনের সঙ্গে পরিচিত হয় নানাভাবে—বড়দের গল্প, কবিতা, রূপকথা শুনে। বন্ধুদের হিরোদের আচরণ থেকে, নিজেদের সেরা বন্ধুদের থেকেও। কে ভালো, কে খারাপ, এটা যখন শিশুর কাছে স্পষ্ট হয়, তখন অনুরূপ সব ক্ষেত্রে নিজেকে সে কেমনভাবে প্রদর্শন করবে, সেই আচরণ ঠিক করে নেয়।
শিশুবিজ্ঞানীরা বলেন, শিশুরা আট থেকে নয় ধরনের বুদ্ধিমত্তার অধিকারী। কেউ প্রকৃতি দেখে শেখে, কেউ তালে তালে শেখে, কেউ গাণিতিকভাবে শেখে, কেউ একা একা শেখে, কেউ দল বেঁধে শেখে, কেউ যৌক্তিকভাবে, কেউ গানে গানে, কেউ ছুঁয়ে ছুঁয়ে শেখে আর কেউ নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে শেখে।
ঢাকা শহরের কার্জন হলের সামনে বিশাল এলাকাব্যাপী শিশু একাডেমি। আর জেলা শহরগুলোয় খুপরির মতো একেকটি শিশু একাডেমির ভবন। রংপুর বা কুড়িগ্রাম কিংবা বরগুনা বা বগুড়া শহরে শিশু একাডেমি কোথায়, তা খুঁজেই পাওয়া যাবে না। কেউ তার ঠিকানাও জানে না। খুপরি খুঁড়ে কে হায় ঠিকানা বের করে? অথচ শিশু একাডেমিগুলো হওয়ার কথা পুরো জেলার সব স্কুল-হাইস্কুল-মাদ্রাসার কেন্দ্রভূমি।
শিশু একাডেমির কাজ সব বুদ্ধিমত্তার শিশুর জন্যই শেখার ব্যবস্থা রাখা। শহরের শিশুকে গ্রামে আর গ্রামের শিশুকে শহরে নিয়ে আসা, বাসযোগে সব শিশুকে নিয়ে একসঙ্গে দর্শনীয় স্থানে ঘুরে বেড়ানো, শিশুদের তৈরি সিনেমা, গল্প, কবিতা, চিত্রপ্রদর্শনী ও প্রকাশের ব্যবস্থা করা।
জেলা শিশু একাডেমিগুলোয় নিয়মিত শিশুমেলা হতে পারত; যেখানে সব জাতির শিশুরা বাংলাদেশের মানচিত্রের নিজ নিজ জেলায় নিজ নিজ জাতির বৈশিষ্ট্য নিয়ে হাজির হতে পারে। হতে পারে ফ্যাশন, খাবারসহ বৈশিষ্ট্যের প্রদর্শন। এতে শিশুরা পরস্পরের সংস্কৃতি ও জীবনের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠবে। শৈশব থেকেই জানবে বাংলাদেশ মানে শুধু তার গ্রাম বা শহর নয়। জানবে বাংলাদেশ বহু জাতি, বহুভাষী ও বহু ধর্মের দেশ। জাতীয় ঐক্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র যদি গড়ে তুলতে হয়, তাহলে এই মেলার বিকল্প নেই।
শিক্ষক-অভিভাবক-শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে জমে উঠত বইমেলা। যেখানে শিশুরা শিখবে ফটোগ্রাফি, সিনেমা কোর্স, গান, গল্প বলা, নৃত্য, আবৃত্তিসহ যা কিছু শেখার সবকিছু। শিল্পকলা একাডেমি যেমন কেবল সব ধরনের শিল্পীদের, শিশু একাডেমি তেমনটা নয়। শিশু একাডেমি কেবল শিশুদের, জেলার সব শিশুর। সেখান থেকে তারা নিজ জেলাটিকে গড়ে তুলবে, ভালোবাসতে শিখবে।
জেলা শিশু একাডেমি এ জন্য দ্বিতল বাস সংগ্রহ করতে পারে। বাসের মধ্যে ছোটখাটো জাদুঘর বানাতে পারে। ওই বাসগুলোয় শিশুরা সারা বছর ঘুরবে। একেক দিন একেক স্কুল, কখনো কয়েকটা স্কুল একসঙ্গে।
একটা শিশু একাডেমিকে জেলার প্রাথমিক ও হাইস্কুল-মাদ্রাসার সব শিশুকে জায়গা দেওয়ার অবকাঠামো ও মানসিকতা রাখতে হবে। শিশু একাডেমির তথ্যভাণ্ডারে জেলার সব শিশুর তথ্য থাকবে। এক ক্লিকে জানবে কোন বিষয়ে জেলার কতগুলো শিশু আগ্রহী এবং তারা কারা। বিষয়ভিত্তিক ক্লাব গড়ে তুলবে। সিনেমা বিষয়ে আগ্রহী শিশুদের নিয়ে সিনেমা ক্লাব। সেই ক্লাবে শিশুরা সিনেমা বিষয়ে জানবে, নিজেরা সিনেমা বানাবে এবং প্রজেক্টরে সেসব সিনেমা জেলাবাসীর সামনে প্রদর্শিত হবে।
সাইক্লিং ক্লাবের সদস্যরা সাইকেল চালানো শিখবে, প্রতিযোগিতা করবে। সাহিত্য ক্লাবের শিশুরা সাহিত্য নিয়ে দেশসেরা লেখকদের কথা শুনবে, একাডেমির সহযোগিতায় প্রকাশিত পত্রিকায় লিখবে। যারা ছবি আঁকবে, তাদের চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন হবে। ফটোগ্রাফির ক্লাবে ফটোপ্রদর্শনী হবে। বিজ্ঞান ক্লাবে বিজ্ঞানমনস্কতার আলোচনা হবে, প্রযুক্তির প্রজেক্ট হবে। বছরের ৩৬৫ দিনই অনুষ্ঠান লেগে থাকবে।
আমাদের নদী হারায়, পানি উন্নয়ন বোর্ডের অফিস আকাশ ছোঁয়। ব্রিজ-কালভার্ট হারিয়ে যায়, এলজিআরডির অফিস তিলোত্তমা হয়। কেরানিগিরি হয় যে ডিসি-এসপি অফিসে, সেগুলোয় বিত্তবৈভব চকচক করে। আর যে হাসপাতালে লাখো মানুষের কাতরানো, সেখানে বিছানা নেই। কয়েক লাখ শিশু নিয়ে কারবার যে শিশু একাডেমির, সেই শিশু একাডেমি এত খুপরির মতো যে কারও চোখেই পড়ে না।
অথচ জেলার সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান হওয়ার কথা শিশু একাডেমির। শিশুদের গড়ে না তুলে আমরা কোথায় ঢালছি টাকা?
নাহিদ হাসান কবি ও সংগঠক