যেকোনো বিষয়কে আমাদের কর্তাব্যক্তিদের উন্নত দেশের সঙ্গে তুলনা দেওয়ার একটা ‘বাতিক’ তৈরি হয়েছে। ইতিবাচক, নেতিবাচক যেকোনো সিদ্ধান্ত বা কর্মকাণ্ডের ঢাল, যুক্তি কিংবা অজুহাত হিসেবে যত্রতত্রই তা ব্যবহৃত হয়। কিন্তু ইন্টারনেটকেন্দ্রিক বিশ্বে কারও মুখ ফসকে কোনো কথা বলার উপায় নেই। কেননা, যোগাযোগ আজ হাতের মুঠোয়। ফলে, পরিকল্পিত লোডশেডিংয়ের সিদ্ধান্ত জানাতে গিয়ে যখন বলা হয়, ‘জাপান-অস্ট্রেলিয়াতেও লোডশেডিং হচ্ছে, তাদের তুলনায় আমরা ভালো অবস্থানে আছি’। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তখনই তথ্যপ্রমাণসহ হাজির হয়ে যায়—এ বক্তব্য কতটা সঠিক কিংবা কতটা বেঠিক। তবু বঙ্গোপসাগরের কোল থেকে বাংলাদেশকে উড়িয়ে কিংবা ভাসিয়ে আটলান্টিক কিংবা প্রশান্ত মহাসাগরের ওপারে মানে ইউরোপ-আমেরিকায় নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টার অন্ত নেই।
উন্নত বিশ্ব তো দূরে থাক, আমাদের নিকট অর্থনীতির কোনো দেশে আমাদের দেশের মতো রেলক্রসিংয়ে দিনের পর দিন দুর্ঘটনা ঘটে কি না এবং তাতে মানুষের মৃত্যু হয় কি না, সে প্রশ্নের উত্তর কি কর্তাব্যক্তিদের কেউ দিতে পারবেন? বাংলাদেশের বাজেটের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে যে ব্যয়, তার সবচেয়ে হিস্যাটা যায় যোগাযোগে। সড়ক ও রেলে। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন নতুন রেল প্রকল্প হচ্ছে। লাখো কোটি টাকা ব্যয়ে বুলেটে ট্রেন চালু করা যায় কি না, তার সম্ভাব্যতা যাচাই চলছে। কিন্তু রেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা ঠেকাতে ক্রসিং নির্মাণ কিংবা লোক নিয়োগ দেওয়ার মতো অর্থের সংকুলান করা যায় না। আমলাতান্ত্রিক অবহেলা ও রাজনৈতিক উপেক্ষার ধ্রুপদি মেলবন্ধনে বাংলাদেশের রেলক্রসিং এখন প্রকৃত অর্থেই মৃত্যুফাঁদ।
প্রশ্ন হলো, আমাদের রাজনীতিক ও আমলাদের যত দিন ঔপনিবেশিক হ্যাংওভার কাটবে না, যত দিন মানুষকে তাঁরা উন্নয়নের কেন্দ্রে আনতে পারবেন না, তত দিন নাগরিকের জীবনকে তুচ্ছ ভাবার এই মনোভাবের কি বদল হবে? সড়ক ও রেল অবকাঠামো ঘিরে হাজার হাজার কোটি টাকার কর্মযজ্ঞ চলে, অথচ নাগরিকের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য রেলক্রসিং নির্মাণ এবং পাহারাদার নিয়োগের মতো অর্থের সংস্থান করা যায় না। নাগরিকের জান-মাল রক্ষায় রেলক্রসিংয়ে নিরাপত্তা না দিতে পারুক, মৃত্যুর দায়টা কেউ অন্তত নিতে শিখুক।
সম্প্রতি গোপালগঞ্জ ও গাজীপুরে দুটি রেলক্রসিংয়ে দুটি দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৯ জন। প্রথম দুর্ঘটনাটা ঘটে তারিখে ২১ জুলাই। গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীতে কাঠামদরস্ত রেলক্রসিংয়ে। নির্মাণাধীন ভবনের ঢালাইকাজ শেষে মিক্সচার মেশিন নিয়ে ১৪ জন শ্রমিক রেললাইন পার হচ্ছিলেন। সে সময় রাজশাহী থেকে ছেড়ে আসা টুঙ্গিপাড়া এক্সপ্রেস ট্রেনটি ধাক্কা দিলে ভটভটিটি পাশের খাদে পড়ে যায়। পাঁচ শ্রমিক নিহত হন।
এর তিন দিন পর গাজীপুরের শ্রীপুরে বরমির মাইজপাড়া রেলক্রসিংয়ে পোশাকশ্রমিক বহনকারী একটি বাসে ট্রেনের ধাক্কায় চারজন নিহত হন। বাসে থাকা ২৫ জন শ্রমিকের সবাই কমবেশি আহত হন। আহত শ্রমিকদের ভাষ্য, গতিরোধক নামানো না থাকায় বাসটি রেললাইনে উঠে পড়ে। সে সময়ে ট্রেন এসে পড়ায় এ দুর্ঘটনা।
সর্বশেষ আজ শুক্রবার দুপুরে চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলায় ট্রেনের ধাক্কায় মাইক্রোবাসের ১১ আরোহী নিহত হয়েছেন। নিহতরা সবাই প্রায় তরুণ বয়সী। এতগুলো সম্ভাবনাময় প্রাণ অল্প মুহূর্তেই ঝরে গেল। খৈয়াছড়া ঝরনা নামের পর্যটন স্পট থেকে ফেরার পথে ভয়াবহ এ দুর্ঘটনা ঘটে। ট্রেনটি ধাক্কা দেওয়ার পর মাইক্রোবাসটিকে প্রায় এক কিলোমিটার ঠেলে নিয়ে যায়।
অথচ রেলক্রসিংটিতে কোনো সিগন্যাল বা প্রতিবন্ধক ছিল না। লাইনম্যানও ছিলেন না। যার কারণে এত বড় দুর্ঘটনা ঘটল। রেল কর্তৃপক্ষ বলছে, যদি ওই সময় লাইনম্যান না থাকেন, তবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এমন বক্তব্য নতুন নয়। মৃত্যুটাই আসলে এখানে সহজলভ্য হয়ে গিয়েছে!
বরাবরের মতো দুটি দুর্ঘটনায় তদন্ত কমিটি করা হবে। নির্দিষ্ট সময় শেষে কিংবা সময় বাড়িয়ে একটা প্রতিবেদনও দেবে। আগের প্রতিবেদনগুলো থেকে শুধু স্থান–কাল পাল্টে যাওয়া ছাড়া তাতে কি খুব উনিশ-বিশ কিছু হবে? প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, রেলের হিসাবে ২০১৪-২০ সাল পর্যন্ত রেলে দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ১৭৫ জন। এর মধ্যে ১৪৫ জনের মৃত্যু হয়েছে লেভেল ক্রসিংয়ে। রেলে দুর্ঘটনায় যত মৃত্যু হয়, তার ৮৩ শতাংশই রেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু। (রেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা: মৃত্যুর দায় নেই, শাস্তি হয় না, ৬ ডিসেম্বর, ২০২১)
এর কারণ হচ্ছে, সারা দেশের ৮২ শতাংশ রেলক্রসিংই অরক্ষিত। অর্থাৎ, ট্রেন চলাচলের সময় যানবাহন চলাচলে নিয়ন্ত্রণ নেই। আর বাকি যে ১৮ শতাংশ ‘সুরক্ষিত’ ক্রসিংয়ের বেশির ভাগই চলছে দিনমজুরি ও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের লোক দিয়ে। ফলে সময়মতো প্রতিবন্ধকটি নামানোর দায় খুব বেশি নেই। রেলের পরিসংখ্যানে সারা দেশে রেলক্রসিংয়ের সংখ্যা ২ হাজার ৫৬১। এর মধ্যে অনুমোদিত ক্রসিংয়ের সংখ্যা ১ হাজার ২৪০। অননুমোদিত ক্রসিং ১ হাজার ৩২১।
রেলওয়েতে প্রাণহানির ক্ষেত্রে দায় নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো আইন নেই। রেলওয়ে আইন ১৮৯০-এর ১২৮ ধারায় উল্টো দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের অভিযুক্ত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। কেননা, এই ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি ট্রেন চলাচলে বাধা সৃষ্টি করলে কিংবা বাধা সৃষ্টির চেষ্টা করলে সেটা আইনত দণ্ডনীয়। সে ক্ষেত্রে দোষী ব্যক্তির দুই বছরের জেল হতে পারে।
রেল আইন অনুযায়ী, নতুন রেললাইন তৈরি হওয়ার পর প্রথম ট্রেন চলাচল শুরু হওয়ার দিন থেকে ১০ বছরের মধ্যে এর ওপর দিয়ে কোনো সড়ক গেলে তা সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ব রেলের। এরপর কোনো সড়ক নির্মাণ করা হলে সেই ক্রসিং সুরক্ষিত করার দায়িত্ব সড়ক নির্মাণকারী সংস্থার। স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি), পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ, সিটি করপোরেশন একং সড়ক ও জনপথ বিভাগ এই সড়ক নির্মাণ করে। শুধু রেলওয়ে নয়, রেলক্রসিংয়ে মৃত্যুর দায় এ সংস্থাগুলোর একটিও নেয় না। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের আইনের আশ্রয় নেওয়ারও সুযোগ নেই।
ফলে সংস্থায় সংস্থায় ঠেলাঠেলি, চিঠি–চালাচালি, দোষারোপ, পাল্টা দোষারোপ—সবই চলে। দফায় দফায় সংসদীয় কমিটি বসে করণীয় ঠিকও করে। কিন্তু কোনো সংস্থাই কোনো দায় নেয় না। সমাধানও হয় না। দুর্ঘটনা ও নাগরিকের প্রাণহানি থামে না। রেলক্রসিংয়ে এসব দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর মিছিল রাজনীতিক ও আমলাদের নির্লিপ্ততা আর অবহেলার ফসল নয় কি?
রেলক্রসিংয়ে দিনের পর দিন দুর্ঘটনা ঘটে চলবে আর সেটা বন্ধ করতে কোনো পদক্ষেপ কেউ নেবে না—নাগরিকের সঙ্গে এমন উপহাসের কারণ কী? ট্রেন চলে সরল পথে। যদি কোনো রেলক্রসিংয়ে বেপরোয়া গতিতে অন্য কোনো গাড়ি গতিরোধকটি ভেঙে রেললাইনের ওপর উঠে যায়, তাহলেই কেবল দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তা ছাড়া রেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনার কোনো কারণ নেই।
প্রশ্ন হলো, আমাদের রাজনীতিক ও আমলাদের যত দিন ঔপনিবেশিক হ্যাংওভার কাটবে না, যত দিন মানুষকে তাঁরা উন্নয়নের কেন্দ্রে আনতে পারবেন না, তত দিন নাগরিকের জীবনকে তুচ্ছ ভাবার এই মনোভাবের কি বদল হবে? সড়ক ও রেল অবকাঠামো ঘিরে হাজার হাজার কোটি টাকার কর্মযজ্ঞ চলে, অথচ নাগরিকের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য রেলক্রসিং নির্মাণ এবং পাহারাদার নিয়োগের মতো অর্থের সংস্থান করা যায় না। নাগরিকের জান-মাল রক্ষায় রেলক্রসিংয়ে নিরাপত্তা না দিতে পারুক, মৃত্যুর দায়টা কেউ অন্তত নিতে শিখুক।
গাজীপুরের শ্রীপুরে দুর্ঘটনায় মা–হারা হয়েছে চার বছরের শিশু নূর মাহিম। মা রহিমা খাতুনের কাপড় ছোট্ট শিশুটির জন্য অবর্ণনীয় বেদনার কারণ। মায়ের কাপড়গুলো তাই লুকিয়ে ফেলতে চায় মাহিম। দাদি শামছুন্নাহারকে মাহিম বলেছে, ‘আম্মার কাপড় লুকায়া রাখো দাদু, দেখলে কষ্ট লাগে। আমার কান্না আসে। সব কাপড় লুকায়া রাখো।’
ছোট্ট শিশু মাহিমের এই কান্না, এই কষ্ট, এই দীর্ঘশ্বাস কি কর্তাব্যক্তিদের কাউকে স্পর্শ করতে পারছে?
মনোজ দে প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক।
ই–মেইল: monoj.dey@prothomalo.com