জিকে প্রকল্পের পানির ওপর নির্ভরশীল কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও মাগুরার কয়েক লাখ কৃষক বিপদে পড়েছেন, তাঁরা বোরো আবাদের জন্য প্রয়োজনীয় সেচের পানি পাচ্ছেন না।
জিকে প্রকল্পের পানির ওপর নির্ভরশীল কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও মাগুরার কয়েক লাখ কৃষক বিপদে পড়েছেন, তাঁরা বোরো আবাদের জন্য প্রয়োজনীয় সেচের পানি পাচ্ছেন না।

মতামত

যে কারণে কৃষকের সেচ সমস্যার সমাধান করা হয় না

কুষ্টিয়ায় গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জিকে) সেচ প্রকল্পের তিনটি পাম্পই নষ্ট। এ কারণে এতে জিকে প্রকল্পের পানির ওপর নির্ভরশীল কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও মাগুরার কয়েক লাখ কৃষক বিপদে পড়েছেন, তাঁরা বোরো আবাদের জন্য প্রয়োজনীয় সেচের পানি পাচ্ছেন না।

গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প (জিকে প্রজেক্ট) পদ্মা নদীর দক্ষিণ তীরের বিস্তৃত অঞ্চলজুড়ে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক গৃহীত একটি প্রকল্প। ১৯৩ কিলোমিটার প্রধান খাল, ৪৬৭ কিলোমিটার শাখা খাল ও ৯৯৫ কিলোমিটার প্রশাখা খালের মাধ্যমে সেচ প্রকল্পের পানি কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও মাগুরা জেলার ১৩টি উপজেলায় সরবরাহ করা হয়।

বাংলা পিডিয়ার তথ্য অনুসারে, প্রকল্পটিতে পানি সেচের জন্য রয়েছে ১ হাজার ৬৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ বিভিন্ন ধরনের খাল ও নালা, যার মধ্যে প্রধান খাল দুটির দৈর্ঘ্য ১৯৩ কিলোমিটার, মধ্যবর্তী পর্যায়ে পানি বিতরণের খালগুলোর সম্মিলিত দৈর্ঘ্য ৪৬৭ কিলোমিটার এবং কৃষিজমিতে পানি পৌঁছে দেওয়ার জন্য নির্মিত তৃতীয় পর্যায়ের খালগুলোর সম্মিলিত দৈর্ঘ্য ৯৯৫ কিলোমিটার। প্রকল্পের আওতায় সেচযোগ্য জমির পরিমাণ ১ লাখ ৪২ হাজার হেক্টর হলেও বাস্তবে এই পরিমাণ জমিতে সেচ দেওয়া সম্ভব হয় না। (গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প, বাংলাপিডিয়া)

ফারাক্কা বাঁধের কারণে শুষ্ক মৌসুমে পদ্মা থেকে পাম্পের সাহায্যে প্রয়োজনীয় পানি উত্তোলন প্রায়ই সম্ভব হয় না, কেননা পাম্পগুলো পূর্বপরিকল্পনা অনুসারে যে স্থানে বসানো হয়েছিল, সেখানে এখন আর ন্যূনতম প্রয়োজনীয় পানির স্তর থাকছে না। পদ্মায় পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় বেশ কয়েক বছর আগে থেকে বোরো মৌসুমে শুধু কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গায় পানি সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা হয়, মাগুরা ও ঝিনাইদহের খালগুলোয় পানি সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়। তা ছাড়া বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বক্তব্য অনুসারে, রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ না থাকার কারণে প্রকল্পটির ভৌত অবকাঠামোর অবস্থার অবনতি ঘটেছে।

প্রথম আলোর সংবাদ অনুসারে, প্রকল্পের তিনটি পাম্পের মধ্যে ২ ও ৩ নম্বর পাম্প দুটি বেশ কয়েক বছর ধরে বিকল। এ ছাড়া বিকল্প হিসেবে আরও যে ১২টি ছোট পাম্প ছিল, সেগুলোও ২০০১ সাল থেকে বিকল। এ রকম অবস্থায় গত ১৯ ফেব্রুয়ারি একমাত্র সচল পাম্পটি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় সেচের পানি সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। (সব পাম্প অচল, পানি নেই খেতে, প্রথম আলো, ৭ মার্চ ২০২৪)

দেশের রাজনীতিতে ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর এমন আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে দেশের খাদ্যনিরাপত্তা ও কর্মসংস্থানের জন্য কৃষি খুবই গুরুত্বপূর্ণ হলেও নীতিনির্ধারকদের কাছে কৃষকদের স্বার্থ তেমন প্রাধান্য পায় না। কৃষকের সার-বীজের দাম ও প্রাপ্যতা, সেচের পানি কিংবা উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য জাতীয় সমস্যা হিসেবে যতটা মনোযোগের দাবি করে, ততটা গুরুত্ব পেতে দেখা যাচ্ছে না। আর এ কারণেই সেচের পানি নিয়ে বছরের পর বছর ধরে লাখ লাখ কৃষকের ভোগান্তির শেষ হচ্ছে না।

এভাবে সময়মতো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিনিয়োগ না করায় লাখো চাষি বিপদে পড়েছেন। বিকল্প হিসেবে কেউ কেউ শ্যালো মেশিনের সাহায্যে পানি তুলে চাষাবাদ করার চেষ্টা করছেন কিন্তু জিকে প্রকল্পের পানি দিয়ে এক বিঘা আবাদে খরচ যেখানে বছরে ৩০০ টাকা, সেখানে ডিপ টিউবওয়েলের সঙ্গে মাটির নিচ থেকে পানি তুলে চাষাবাদের খরচ প্রায় ৫ হাজার টাকা। ফলে লোকসানের আশঙ্কায় অনেকেই চাষাবাদ শুরু করতে পারছেন না। (বোরো আবাদে বিপাকে চার জেলার কৃষক, সমকাল, ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪)  

জিকের পানি না পাওয়ায় মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে এসেও বহু জমি অনাবাদি পড়ে আছে। ডেইলি স্টার-এর এক সরেজমিন প্রতিবেদন অনুসারে, কুষ্টিয়া সদর উপজেলার টাকিমারা, শিমুলিয়া, বটতৈল, বৃত্তিপাড়া ও স্বর্গপুরে বিস্তীর্ণ ফসলি জমি ফেটে চৌচির হয়ে আছে। এসব জমি নিয়মিত খালের পানি পাওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানি তোলার ব্যবস্থাও নেই। (বোরো আবাদে একরে খরচ বাড়ছে ২০ হাজার টাকা, ডেইলি স্টার অনলাইন বাংলা, ২১ মার্চ ২০২৪)

পদ্মার পানি কমে যাওয়ার কারণে এবং ভূগর্ভ থেকে ডিপ টিউবওয়েল দিয়ে অনিয়ন্ত্রিত পানি উত্তোলনের কারণে বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকেরাও দীর্ঘদিন ধরে সেচের পানির সংকটে ভুগছেন। একদিকে বরেন্দ্র বহুমুখী সেচ প্রকল্পের আওতাধীন গভীর নলকূপগুলো থেকে আগের মতো পানি পাওয়া যাচ্ছে না, অন্যদিকে যেটুকু পানি পাওয়া যাচ্ছে সেটুকুরও ন্যায্য বণ্টন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন কৃষকেরা। বিশেষ করে রাজশাহী, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ২১টি ইউনিয়নে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বেশি নিচে নেমে গেছে। ফলে বাধ্য হয়ে ধানের বদলে অন্য ফসল চাষে ঝুঁকছেন কৃষকেরা।

যেসব পাম্প থেকে পানি পাওয়া যায়, সেগুলোর অপারেটরদের অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে কৃষকেরা সময়মতো পর্যাপ্ত পানি পাচ্ছেন না। বিএমডিএর নির্ধারিত পানির দাম দুই কিউসেক (পানি পরিমাপের একক) পাম্পের জন্য ঘণ্টায় ১২৫ টাকা এবং এক কিউসেক পাম্পের (যে পাম্পে সেকেন্ডে এক ঘনফুট পানি ওঠে) জন্য ঘণ্টায় ১১০ টাকা। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বেশি অর্থ না দিলে কৃষকেরা সেচের পানি পান না।

নলকূপের অপারেটররা রাজনৈতিকভাবে নিয়োগ পাওয়ার কারণে এর কোনো প্রতিকারও পাওয়া যায় না। সময়মতো সেচের পানি না পেয়ে দুই বছর আগে রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে দুই সাঁওতাল কৃষক বিষপানে আত্মহত্যা করেছিলেন। (গভীর নলকূপে পানি নেই, বোরো নিয়ে সংকটে কৃষক, প্রথম আলো, ৭ মার্চ ২০২৪)  

অন্যদিকে আশুগঞ্জ-পলাশ অ্যাগ্রো ইরিগেশন প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় তিন বছর ধরে সেচের পানি পাচ্ছেন না ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ ও নরসিংদীর পলাশ উপজেলার ৫০ সহস্রাধিক কৃষক। এতে ব্যাহত হচ্ছে আশুগঞ্জ-পলাশ অ্যাগ্রো ইরিগেশন প্রকল্পের আওতায় থাকা ১৫ হাজার হেক্টর জমির বোরো আবাদ।

বিদ্যুৎকেন্দ্রের টারবাইন ঠান্ডা রাখতে মেঘনা নদী থেকে যে পানি তোলা হয়, সেই পানিই ব্যবহার শেষে জমি সেচের কাজে লাগানো হতো। ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহার করে সেচের এই প্রকল্পটি পরিচালনা করত বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)। ২০২০ সালের জুনে ‘আশুগঞ্জ-পলাশ অ্যাগ্রো ইরিগেশন প্রকল্প’ নামের এই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় এবং আশুগঞ্জ নৌবন্দর-আখাউড়া স্থলবন্দর মহাসড়ক চার লেন প্রকল্প বাস্তবায়নে সেচ প্রকল্পের প্রায় ১১ কিলোমিটার ড্রেন ও খাল ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কারণে এই সেচ সুবিধা বন্ধ হয়ে যায়।

ভূগর্ভ থেকে পাম্পের মাধ্যমে পানি তুলে সেচ দিলে যেখানে একরপ্রতি ৮-১০ হাজার টাকা খরচ লাগে, সেখানে এই প্রকল্পের পানিতে একরে সেচ খরচ পড়ত মাত্র ২ হাজার টাকা। এতে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ যেমন কমত, তেমনি গড়ে ৭০ শতাংশ জ্বালানি সাশ্রয় হতো। প্রকল্পটি সচল করার প্রস্তাব সাড়ে তিন বছর ধরে ঝুলে আছে, বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। (সেচ বন্ধে ক্ষতির মুখে ৫০ হাজার কৃষক, সমকাল, ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪)

দেখা যাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা অবহেলার কারণে লাখ লাখ চাষি সেচের পানি নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে উন্নয়ন প্রকল্প করতে পারলেও কৃষকের সমস্যার সমাধান করার জন্য সামান্য অর্থটুকুও সময়মতো ব্যয় করছে না।

দেশের রাজনীতিতে ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর এমন আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে দেশের খাদ্যনিরাপত্তা ও কর্মসংস্থানের জন্য কৃষি খুবই গুরুত্বপূর্ণ হলেও নীতিনির্ধারকদের কাছে কৃষকদের স্বার্থ তেমন প্রাধান্য পায় না। কৃষকের সার-বীজের দাম ও প্রাপ্যতা, সেচের পানি কিংবা উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য জাতীয় সমস্যা হিসেবে যতটা মনোযোগের দাবি করে, ততটা গুরুত্ব পেতে দেখা যাচ্ছে না। আর এ কারণেই সেচের পানি নিয়ে বছরের পর বছর ধরে লাখ লাখ কৃষকের ভোগান্তির শেষ হচ্ছে না।

কল্লোল মোস্তফা লেখক ও গবেষক