যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুর দুই দিনের বাংলাদেশ সফরের আগে যে আলোচনার ঝড় উঠেছিল, তা তাঁর সফর শেষ হওয়ার পরও অব্যাহত আছে এবং অনুমান করা যায়, আগামী কিছুদিন তা চলবে। তার কারণ হচ্ছে, এ সফরের পর সরকারের পক্ষ থেকে একধরনের স্বস্তির ভাব দেখানোর চেষ্টা আছে, অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে যে মিস্টার লু যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এত দিন ধরে যা বলা হচ্ছিল, সে কথাগুলোই আবার বলেছেন।
সরকারের স্বস্তির জায়গাটি সম্ভবত এইখানে যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) নিয়ে ২০২১ সালের শেষ থেকে যে টানাপোড়েন ছিল, সে বিষয়ে তিনি কঠোর কোনো কথা বলেননি। বরং হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনের সূত্র ধরে বলেছেন, নিষেধাজ্ঞা জারির পর র্যাবের হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যা হ্রাস পেয়েছে। ‘অসামান্য অগ্রগতির বিষয়টি সেখানে উঠে এসেছে, আমরাও তা দেখছি।’ তাঁর ভাষায়, ‘এটা অসাধারণ কাজ। এটা দেখিয়েছে যে মানবাধিকারের প্রতি সম্মান রেখেও র্যাব সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করতে সক্ষম।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সাংবাদিকদের বলেছেন, আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্র পক্ষ র্যাবের সংস্কারের প্রশ্ন তোলেনি। কিন্তু এই সফরের সময় এবং ২০২২ সালে বাংলাদেশে যত মার্কিন কর্মকর্তা এসেছেন এবং বাংলাদেশের যত কর্মকর্তা যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন, তাঁরা র্যাবের প্রসঙ্গ তুলেছেন; বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যে তিনটি বিষয়কে আলোচনায় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, তা হচ্ছে র্যাবের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, জিএসপি সুবিধা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা সমাধানে সহযোগিতা। ফলে প্রত্যক্ষভাবে সংস্কার নিয়ে আলোচনা না হলেও র্যাব বিষয়ে আলোচনা হয়নি, এমন মনে করার কারণ নেই।
র্যাবের নিষেধাজ্ঞা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র আগে যা বলেছে, তা হচ্ছে র্যাবের সংস্কার না হলে নিষেধাজ্ঞা উঠবে না। এ কারণেই লুর সফরের সময় এ আলোচনাকে কেন্দ্র করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দেওয়া বক্তব্যের পর দূতাবাস এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সোমবার সাংবাদিকদের বলেছিলেন, তিনি (ডোনাল্ড লু) বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করেছেন, একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শিগগিরই র্যাবের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হবে। দূতাবাসের দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়েছে, নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ব্যাপারে ডোনাল্ড লু কোনো রকমের সময়সীমা দেননি।
তা ছাড়া মঙ্গলবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের বক্তব্যে এটা বোঝা যায় যে বাংলাদেশ সরকার তার এত দিনের অস্বীকারের অবস্থান থেকে সরে আসছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘র্যাবের ওপরে নিষেধাজ্ঞা হয়েছে। র্যাবও তো কিছু উল্টাপাল্টা কাজ করেছে। এই বাস্তবতা অস্বীকার করতে পারবেন না তো। এখন অনেক ম্যাচিউরড (র্যাব)। আগে প্রথম দিকে র্যাব অনেক লোকজনকে খামাখা কী করে ফেলেছে, কিন্তু বিষয়গুলো পরিবর্তন হয়েছে। র্যাব জবাবদিহির ক্ষেত্রে অনেক উন্নতি করেছে।’
বাংলাদেশের অবস্থানের এ পরিবর্তনের সঙ্গে ডেইলি স্টার (১৭ জানুয়ারি ২০২৩)–এর সঙ্গে দেওয়া লুর সাক্ষাৎকারের একটি বক্তব্যের কোনো যোগসূত্র আছে কি না, সেটা বিবেচনা করা যেতে পারে। ডিসেম্বর মাসের গোড়ায় বাংলাদেশে শোনা গিয়েছিল যে যুক্তরাষ্ট্রের আরও নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে। এ ধারণার সত্যতা পাওয়া গেছে লুর বক্তব্যে। তিনি বলেছেন, ‘আমরা র্যাবের আরও কিছু ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতাম, কিন্তু আমরা তা করিনি। কেননা ইতিমধ্যে সরকারের পক্ষ এবং র্যাবের পক্ষ থেকে সংস্কারের ক্ষেত্রে যেসব অগ্রগতি হয়েছে, আমরা সেগুলোকে স্বীকৃতি দিতে চাই।’ তার মানে আরও নিষেধাজ্ঞার প্রস্তুতি যুক্তরাষ্ট্রের ছিল বা আছে। সেটা ২০২২ সালে করেনি, কিন্তু ভবিষ্যতে করবে কি না, সেটা সরকারের আচরণের ওপরই নির্ভর করবে।
ডোনাল্ড লুর এ সফরের কারণ কেবল র্যাব-বিষয়ক আলোচনা নয়, বরং র্যাব-বিষয়ক আলোচনার তাগিদ বাংলাদেশের। যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে উদ্বেগের ও আলোচনার বিষয় ছিল দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং আগামী বছরের নির্বাচন। দুই দিনের সফরে তিনি নাগরিক সমাজের সঙ্গে আলোচনায়, মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠকে এবং সংবাদমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সেটা বারবার বলেছেন। এখানে যুক্তরাষ্ট্রের বক্তব্যে কোনো পরিবর্তন বা ভাষাগত তারতম্যও দেখা যায়নি। যুক্তরাষ্ট্র চায় একটি অংশগ্রহণমূলক এবং অবাধ নির্বাচন। দেশের রাজনীতিতে বিরোধীদের দমন-পীড়ন এবং মতপ্রকাশের ব্যাপারে বাধাগুলো নিয়ে উদ্বেগের জায়গাটি যে উল্লিখিত হয়েছে, তা সরকারের মন্ত্রীরাও স্বীকার করেছেন। ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির গণসমাবেশকে তাঁরা বিরোধীদের সভা-সমাবেশের অধিকার ও নির্বাচনের পরিবেশ আছে— এভাবে দেখাতে চেয়েছেন। প্রশ্ন হচ্ছে তাঁদের এই বক্তব্যে লু সন্তুষ্ট হবেন, এমন মনে করার কারণ দেখি না। কেননা এখানে রাষ্ট্রদূত পিটার হাস কী ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করেন এবং কী প্রত্যক্ষ করেন, সেটা দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর গোচরে নেই, এমন মনে করার কারণ নেই।
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিতে অংশীদার হিসেবে চায়, সেটা নতুন কিছু নয়। এ বিষয় আলোচনায় অগ্রগতি হলে নিশ্চয় দুই পক্ষ উৎসাহের সঙ্গেই জানাত। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে লুর বক্তব্য যে এটা কোনো ক্লাব নয়, খুব হালকা উত্তর বলে মনে হলেও এটি যে আলোচনায় ছিল, তারই ইঙ্গিত। এর বাইরে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে দুটি সামরিক চুক্তির প্রস্তাব করেছে দীর্ঘদিন আগেই। জেনারেল সিকিউরিটি অব মিলিটারি ইনফরমেশন অ্যাগ্রিমেন্ট (জিসোময়া) এবং অ্যাকুইজেশন অ্যান্ড ক্রস-সার্ভিসিং অ্যাগ্রিমেন্ট (আকসা)। এগুলোর ব্যাপারে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত ইতিবাচক সাড়া পায়নি যুক্তরাষ্ট্র। এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে কি না, তা জানা যায়নি।
বিস্ময়কর যে বাংলাদেশের সাংবাদিকেরা ডোনাল্ড লু কিংবা এ কে আব্দুল মোমেন কাউকেই এ নিয়ে প্রশ্ন করেছেন বলে গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে আসেনি। ডোনাল্ড লুর এ সফরের আগে গত কয়েক মাসে বেশ কয়েকজন মার্কিন শীর্ষ কর্মকর্তা বাংলাদেশ সফর করেছেন। এগুলো যে বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক ও ভূকৌশলগত গুরুত্বের কারণে ব্যাপকভাবে আলোচিত। এর সাম্প্রতিক উদাহরণ হচ্ছে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের শাহীনবাগে গুমের শিকার বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের বাড়িতে যাওয়া নিয়ে উত্তেজনায় রাশিয়াও যুক্ত হয়েছিল। তা ছাড়া ডোনাল্ড লুর সফরের অব্যবহিত আগে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিন গ্যাংয়ের মধ্যরাতে ঢাকায় স্বল্পকালীন সফর তার আরেকটি প্রমাণ।
বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন যে গুরুত্ব দিয়েই বিচার করছে, তাতে এটাও স্পষ্ট যে দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন এসেছে। আগের মতো কেবল ভারত-পাকিস্তানকেন্দ্রিক বিবেচনার বাইরে এসে এই অঞ্চলের দেশগুলোকে বিবেচনা করা হচ্ছে। নেপালে লুর একাধিক সফরও তার প্রমাণ। কিন্তু এটাও ঠিক যে এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র বলে বিবেচনা করে। বাংলাদেশ বিষয়ে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গির কোনো পরিবর্তন হয়নি এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের একটা বড় ভূমিকা আছে। এই কারণে যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রতি তাদের সমর্থন অকুণ্ঠ। লু বাংলাদেশে আসার আগে ভারত সফর করেছেন, সেখানে বাংলাদেশ বিষয়ে কী আলোচনা হয়েছে এবং তা মার্কিন নীতিতে তা কতটা প্রভাব ফেলবে, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ।
ডোনাল্ড লুর এ সফরের পর হঠাৎ বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটবে, তা নয়। কিন্তু যেসব বিষয়ে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মতপার্থক্য আছে, সেগুলোর ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র আরও কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে, তার কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যাবে বলেই অনুমান করা যায়।
● আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট