সন্ত্রাসী হামলার পর নিরাপত্তা বাহিনীর অবস্থান। মস্কো।
সন্ত্রাসী হামলার পর নিরাপত্তা বাহিনীর অবস্থান। মস্কো।

বিশ্লেষণ

রাশিয়ায় এই সময় কেন আইএস–খোরাসানের হামলা

আপাতদৃষ্টে মস্কোর ক্রোকাস সিটি হলে শুক্রবারের সন্ধ্যাটা ছিল অন্য দিনের মতোই সাধারণ। কিন্তু কনসার্ট চলাকালে হঠাৎ করেই হৃদয়বিদারক আর ভয়াবহ হামলা শুরু হলো আর পুরো অঞ্চলে আতঙ্কের ছায়া নেমে এল। ছদ্মবেশী বন্দুকধারীরা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে সেখানে প্রবেশ করে কনসার্টে সমবেতদের ওপর নির্মমভাবে গুলি বর্ষণ করে।

এই ভয়াবহ হামলায় কমপক্ষে ৬০ জন নিহত হন। আহত হন ১৪৫ জন। কয়েক দশকের মধ্যে রাশিয়ার মাটিতে এটি অন্যতম ভয়াবহ হামলা। এই হামলা ২০০৪ সালের বেসলন স্কুলের ট্র্যাজিক হামলার স্মৃতি জাগায়।

আমাক নিউজের টেলিগ্রাম চ্যানেলের বরাতে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, এই হামলার সঙ্গে ইসলামিক স্টেটের আফগানিস্তান শাখা আইএসআইএস–কে দায় স্বীকার করেছে। এই হামলা আইএসআইএস-কে যে বড় ধরনের হামলা করতে সক্ষম, সেটাই কেবল প্রমাণ হলো না, ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা তৈরির প্রেক্ষাপটও তৈরি হয়েছে।
বিশেষ করে ২০২২ সালে ইউক্রেনে আগ্রাসনের শুরুর পর থেকে পশ্চিমের সঙ্গে রাশিয়ার যে উত্তেজনাকর সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, সেই প্রেক্ষাপট থেকে এই সম্ভাবনা প্রবল।

আইএসআইএস-কে কী এবং এর জন্ম কীভাবে

ইসলামিক স্টেট খোরাসান (আইএসআইএস-কে) বৃহত্তর সশস্ত্র গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের শাখা। ২০১৪ সালে আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলে এর জন্ম। আজকের ইরান, তুর্কমিনিস্তান ও আফগানিস্তান নিয়ে একসময়কার ঐতিহাসিক অঞ্চল খোরাসানের নামের সঙ্গে মিলিয়ে সশস্ত্র গোষ্ঠীটি তাদের নামকরণ করেছে। নৃশংস কৌশল ও চরমপন্থী কর্মকাণ্ডের জন্য তাদের কুখ্যাতি আছে।

যদিও যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী ও তালেবানের সাঁড়াশি আক্রমণের কারণে ২০১৮ সাল থেকে আইএসআইএস-কের শক্তি অনেকটাই কমে যায়। তারপরও গোষ্ঠীটি ওই অঞ্চলের জন্য বড় হুমকি হিসেবে থেকেই গেছে। ২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্র তাদের সেনা প্রত্যাহার করে নেওয়ার পর তাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালানো এবং তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করার সক্ষমতা আমেরিকানদের কমে গেছে।

আইএসআইএস-কের যত আক্রমণ

আইএসআইএস-কে অসংখ্য হামলার জন্য দায়ী। প্রধানত আফগানিস্তান ও আশপাশের অঞ্চলে তারা এসব হামলা চালিয়েছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি মসজিদে বোমা হামলা, কাবুলে রাশিয়ার দূতাবাসে হামলা, ২০২১ সালে কাবুল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে হামলার মতো ঘটনা রয়েছে। এসব হামলায় অসংখ্য সামরিক ও বেসামরিক মানুষ হতাহত হয়েছে। এর মধ্যে আমেরিকান সেনারাও রয়েছে।

আইএসআইএস-কের সন্ত্রাসের ইতিহাস ঘাঁটলে এটা পরিষ্কার যে সতর্ক হয়ে ওঠার লক্ষ্যবস্তুতে হামলা করার এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার ওপর অব্যাহত হুমকি তৈরির সক্ষমতাও তাদের রয়েছে।

রাশিয়াকে কেন লক্ষ্যবস্তু বানাল আইএসআইএস-কে

রাশিয়া ও প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের প্রতি শত্রুতার ইতিহাস বিবেচনায় নিলে মস্কোর কনসার্ট হলে আইএসআইএস-কের হামলাটি মাত্রার দিক থেকে তীব্রতম।

আইএসআইএস-কের হামলার একটা কারণ হতে পারে, মধ্যপ্রাচ্যে, নির্দিষ্ট করে সিরিয়ায়, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সামরিক আগ্রাসন। পুতিন সিরিয়ায় সেনা পাঠিয়ে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখেছেন।

পরিষ্কারভাবে সেখানে আইএসআইএস ও অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রাশিয়ান সেনারা লড়াই করছে। আসাদকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার পাশাপাশি সেখানে রাশিয়ার প্রভাব বজায় রাখার উদ্দেশ্য থেকেই পুতিন সেখানে সেনা পাঠিয়েছেন। এটা সরাসরি আইএসআইএসের উদ্দেশ্যবিরোধী।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আইএসআইএস-কে রাশিয়া মুসলিম নিপীড়ক দেশ বলে মনে করে। এ কারণেই রাশিয়ার সঙ্গে তাদের বিরোধ। এ ছাড়া, আইএসআইএস-কের অনেক সদস্য এসেছে মধ্য এশিয়ার দেশগুলো থেকে। তারা তাদের দুর্দশার ঐতিহাসিক কারণ মনে করে রাশিয়াকে। রাশিয়ার মাটিতে হামলার এটাও একটা কারণ হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে সাড়া দিচ্ছে

মস্কোর কনসার্টে হামলার জন্য আইএসআইএস-কে যে দায় স্বীকার করেছে, যুক্তরাষ্ট্র তাদের গোয়েন্দা সূত্রে নিশ্চিত করেছে। সন্ত্রাসীদের মধ্যে আদান-প্রদান করা বার্তার পাঠ উদ্ধার করে যুক্তরাষ্ট্র আপাতভাবে রাশিয়াকে সতর্ক করে দিয়েছিল যে বড় কোনো গণজমায়েতে বড় ধরনের সন্ত্রাসী হামলা হতে পারে।

মস্কোর কনসার্টে হামলার জন্য আইএসআইএস-কে যে দায় স্বীকার করেছে, যুক্তরাষ্ট্র তাদের গোয়েন্দা সূত্রে নিশ্চিত করেছে। সন্ত্রাসীদের মধ্যে আদান-প্রদান করা বার্তার পাঠ উদ্ধার করে যুক্তরাষ্ট্র আপাতভাবে রাশিয়াকে সতর্ক করে দিয়েছিল যে বড় কোনো গণজমায়েতে বড় ধরনের সন্ত্রাসী হামলা হতে পারে।

রাশিয়াতে অবস্থানরত রাশিয়ানদের চলাচলের ওপর উপদেশমূলক বার্তা দেওয়া এবং রাশিয়ার সরকারকে তথ্য জানোনো সত্ত্বেও এই ট্র্যাজিক হামলাটি ঘটেছে। এ হামলার ঘটনা থেকে বেরিয়ে এল, বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদের হুমকি অব্যাহত রয়েছে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা তথ্যের আদান–প্রদান ও নিরাপত্তা সহযোগিতার ক্ষেত্রটি যে কতটা জটিল, তা-ও বেরিয়ে এল।

টাইমস অব ইন্ডিয়া থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত