ড. নিয়াজ আসাদুল্লাহ মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরের মোনাশ ইউনিভার্সিটির উন্নয়ন অর্থনীতির অধ্যাপক। বাংলাদেশের নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনারারি প্রফেসরিয়াল ফেলো। এ ছাড়া তিনি গ্লোবাল লেবার অর্গানাইজেশনের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রধান, মালয়েশিয়া সরকারের খাদ্য ও কৃষিনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা, জার্নাল অব হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট, সিঙ্গাপুর ইকোনমিক রিভিউসহ বিভিন্ন একাডেমিক জার্নালের সম্পাদক।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এ কে এম জাকারিয়া
করোনা মহামারি নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বৈশ্বিক জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করা হয়েছে। কিন্তু করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ—সব মিলিয়ে তিন বছর ধরে বিশ্ব অর্থনীতি এক বিশেষ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ এই পরিস্থিতি এ পর্যন্ত যেভাবে সামাল দিল, তাকে কীভাবে দেখছেন। আপনার মূল্যায়ন কী?
নিয়াজ আসাদুল্লাহ: বিশ্ব সম্প্রদায়ের জন্য গত তিন বছর ছিল অভূতপূর্ব। মহামারিতে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে, বহু মানুষ কাজ হারিয়ে দারিদ্র্য ও খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে কিছুটা সৌভাগ্যবান। স্বাস্থ্য খাতে বিশৃঙ্খলা ও অব্যবস্থাপনা সত্ত্বেও আমরা বড় ধরনের জনস্বাস্থ্য-বিপর্যয়ের মুখে পড়িনি। আয় বাড়েনি, কিন্তু জিনিসপত্রের দাম দ্রুত বেড়েছে। তা সত্ত্বেও খাদ্যের অভাবে সহিংসতা ও সামাজিক অসন্তোষ দেখা যায়নি। প্রবাসী আয়প্রবাহে ধীরগতি ও বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ দ্রুত কমলেও সরকারি পরিকল্পনা এবং অর্থনৈতিক পর্যালোচনা খুবই ইতিবাচক। তবে সরকারি তথ্য-উপাত্তের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন ও জনমনে সংশয় ক্রমেই বাড়ছে। এর সঙ্গে আছে অন্য বহু ধরনের অভ্যন্তরীণ সমস্যা; লেনদেনের ক্ষেত্রে ঘাটতি, বিদেশি মুদ্রার সংকট, আমদানির ওপর বিধিনিষেধ, রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়া, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এবং ‘ক্যাপাসিটি চার্জ’-এর ক্রমবর্ধমান বোঝা। আন্তর্জাতিক রেটিং সংস্থা মুডিস এরই মধ্যে আমাদের ব্যাংক-ব্যবস্থার রেটিং অবনমন করেছে, যা নতুন অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে।
করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিশ্চয়ই অর্থনীতিতে বড় চাপ সৃষ্টি করেছে। কিন্তু রিজার্ভ কমে যাওয়া, ডলার-সংকট, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, আমদানিতে সংকোচন, দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়া—এর পেছনে আর কোনো কারণ আছে কি?
নিয়াজ আসাদুল্লাহ: বেশির ভাগ উদীয়মান অর্থনীতি খাদ্য ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে দুর্দশায় পড়েছে। বৈশ্বিক জীবনযাত্রার ব্যয়ের সংকট ভারত, ব্রাজিল, ফিলিপাইন, দক্ষিণ আফ্রিকা ও তিউনিসিয়ার মতো দেশগুলোয় ব্যাপক সামাজিক অসন্তোষ ও সড়কপথে প্রতিবাদের ঘটনা ঘটেছে। যেসব দেশে অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি ও দুর্বল আইনের শাসনের ঐতিহ্য রয়েছে, সেখানে যুদ্ধের প্রভাব বিশেষ করে নেতিবাচক পড়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার তহবিল ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কিত জোড়া সমস্যার মূলে রয়েছে ‘কুইক রেন্টালভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প’। এ সমস্যা দুটি কোভিড-১৯ মহামারি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অনেক আগের সমস্যা। একইভাবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়ে ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়ার একটি অন্যতম কারণ হলো ‘লোভের স্ফীতি’ বা ‘গ্রিডফ্লেশন’, উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির অজুহাতে একচেটিয়া বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সুবিধাবাদী মুষ্টিমেয় ব্যবসায়ীর মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা অর্জন।
যথাযথ অর্থনৈতিক নীতি ও পরিকল্পনার অভাব, অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ, আর্থিক খাতে সুশাসনের অভাব—এগুলো বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অনেক উচ্চারিত বিষয়। বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতির জন্য এসবের দায় কতটুকু?
নিয়াজ আসাদুল্লাহ: আমাদের চলমান সংকট যতটা না বাইরের কারণে, তার চেয়ে অনেক বেশি অভ্যন্তরীণ কারণে। কাঠামোগত ঘাটতি, সমন্বয়হীন পরিকল্পনা, আর্থিক অব্যবস্থাপনা, দুর্বল শাসন, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা এবং গণতান্ত্রিক জবাবদিহির অভাব—এ সবকিছু আমাদের অর্থনীতির ভিত্তিকে ভঙ্গুর করে ফেলেছে। বিষয়টি পুরোপুরি বুঝতে হলে আমাদের বর্তমান সংকটের ধরনটাকে খোলাসা করতে হবে। কিছু ঝুঁকির প্রভাব দৃশ্যত ও বিচ্ছিন্নভাবে খুবই ছোট ও তাৎপর্যহীন মনে হলেও এদের সম্মিলিত ফলাফল হতে পারে ভয়াবহ। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম তাদের গ্লোবাল রিস্ক রিপোর্টে (২০২৩) এককথায় এ বিষয়কে ‘পলিক্রাইসিস’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, অতীত ও বর্তমানের বেশ কিছু অভ্যন্তরীণ ঝুঁকি মিলেমিশে নতুন এক মহাসংকট সৃষ্টি করেছে, যার প্রভাব বহুমুখী। আমি উদ্বিগ্ন এই ভেবে যে আপাতদৃষ্টে বিচ্ছিন্ন এই সংকটগুলো সম্মিলিত এবং ধারাবাহিকভাবে আমাদের পলিক্রাইসিসের দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে।
দুর্নীতি আমাদের অর্থনীতির কতটা ক্ষতি করেছে বা করে যাচ্ছে বলে আপনি মনে করেন?
নিয়াজ আসাদুল্লাহ: সব পুঁজিবাদী সমাজেই কমবেশি দুর্নীতি থাকে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে পার্থক্য হলো এই সমস্যার ধরন ও বিস্তৃতি। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতির ধারণা সূচকে বিশ্বে নিচের দিক থেকে ১২তম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। দুঃখজনক হচ্ছে, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদের অভিজাত গোষ্ঠী নানাভাবে মুনাফা লুণ্ঠন করছে। জনতহবিল নয়ছয় করে, ব্যাংক থেকে টাকা চুরি করে অথবা এমনকি গ্রামাঞ্চলের লাখ লাখ মানুষের প্রবাসে কর্মসংস্থানের স্বপ্নকে পুঁজি করে তারা মুনাফা করছে। আমাদের দুর্নীতি দমন কমিশন নখদন্তহীন বাঘে পরিণত হয়েছে, তাদের গ্রহণযোগ্যতা সামান্যই অবশিষ্ট আছে। এই ক্ষতি দীর্ঘমেয়াদি এবং বহুমাত্রিক, কারণ এটা শুধু আর্থিক ক্ষতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না।
ব্যাংক লুটেরা এবং বিদেশে টাকা পাচারকারীরা এতই ক্ষমতাঘনিষ্ঠ ও প্রভাবশালী যে তাদের কারাগারে পাঠানো যায় না। টাকার রাজনীতি এবং অনৈতিক কর্মকাণ্ড এরই মধ্যে অর্থনৈতিক মেরুকরণ ঘটিয়েছে, সম্পদ কিছু মানুষের হাতে পুঞ্জীভূত হওয়ায় সমাজে চরম বৈষম্য তৈরি হয়েছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক ক্ষোভ চাপা পড়ে আছে ঠিকই, কিন্তু জীবনযাপন নিয়ে মানুষের ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ চাপা থাকছে না। সাম্প্রতিক দুটি বৈশ্বিক সূচক ‘দ্য গ্লোবাল ইমোশনস রিপোর্ট ২০২২’ ও ‘দ্য ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস সূচক ২০২৩’ বিবেচনায় নিলে দেখা যাবে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের সরকারি বয়ান সত্ত্বেও বাংলাদেশ অসুখী দেশের তালিকায় রয়েছে।
অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার আইএমএফের কাছ থেকে ঋণসহায়তা নিয়েছে। এর জন্য নানা ক্ষেত্রে সংস্কারের শর্তও পালন করতে হবে বাংলাদেশকে। এসব শর্ত ও সংস্কার বাংলাদেশের কতটা উপকারে লাগবে বলে মনে করেন? বাংলাদেশের পক্ষে এই শর্তগুলো কতটা পূরণ করা সম্ভব বলে মনে করেন।
নিয়াজ আসাদুল্লাহ: সংস্কার যদি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে তা দীর্ঘ মেয়াদে সুফল দেবে। তবে আইএমএফের শর্ত ও সংস্কার প্যাকেজের চূড়ান্ত প্রভাব বিষয়ে আমার মতামত বিভক্ত। আইএমএফের ঋণ যথাযথভাবে ব্যবহারের জন্য বড় ধরনের রাষ্ট্রীয় সক্ষমতা প্রয়োজন। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে যেভাবে লাগামছাড়া রাজনৈতিকীকরণ করা হয়েছে, তাতে সেগুলোর সক্ষমতা কমে গেছে। আমাদের জাতীয় সংসদও পুরোপুরিভাবে কার্যকর ও সক্রিয় নয়। সংস্কার কর্মসূচি কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের জন্য সংসদে রাজনৈতিক ভারসাম্যের অনুপস্থিতি খুবই উদ্বেগজনক। খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনা বা ট্যাক্স-জিডিপির অনুপাত বাড়ানোর মতো সংস্কার বাস্তবায়নে প্রয়োজন রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাধরদের বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ, যা কিনা বর্তমান প্রেক্ষাপটে অনেকটাই অসম্ভব। একইভাবে অন্যান্য শর্ত, যেমন ভর্তুকি যৌক্তিককরণ করতে প্রয়োজন রাজনৈতিক ক্রোনিদের শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ। হতাশার কারণ হচ্ছে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধের নামে রাজনৈতিক ক্রোনিদের মালিকানাধীন অলস বসে থাকা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে ভর্তুকি দিয়ে যেতে হচ্ছে। এই বাস্তবতায় ভর্তুকি সংস্কারের রাশ ধরে জ্বালানি ও বিদ্যুতের দাম বাড়বে। জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধি এবং দীর্ঘ মেয়াদে আর্থিক ঋণের দুটো বোঝা সাধারণ জনগণের ঘাড়েই চাপবে।
শ্রীলঙ্কা চরম অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে গেছে এবং যাচ্ছে। পাকিস্তানের অবস্থা শোচনীয়। এ দুই দেশের পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে আপনি বাংলাদেশকে কোন কোন ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে বলবেন?
নিয়াজ আসাদুল্লাহ: দুর্নীতি, একচ্ছত্র ক্ষমতা ও জনতুষ্টিবাদ—এ রকম অনেক কারণ সম্মিলিতভাবে শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের অর্থনৈতিক দুর্দশার জন্য দায়ী। দুটি দেশই দৃশ্যমান অবকাঠামো নির্মাণের জন্য মাত্রাতিরিক্ত বিদেশি ঋণের ওপর ঝুঁকে পড়ে। এর মধ্যে এমন কিছু প্রকল্প ছিল, যেগুলো নির্দিষ্ট বিদেশি শক্তি কিংবা রাজনৈতিক ক্রোনিদের তুষ্ট করার জন্য নেওয়া হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা হচ্ছে, ২০০০-এর দশকে শ্রীলঙ্কা উচ্চ প্রবৃদ্ধি নিয়ে যে উচ্ছ্বাস তৈরি হয়েছিল, তাতে ভর করেই এ ধরনের একপক্ষীয় ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিকল্পনার দিকে দেশটি ঝুঁকে পড়ে। বাংলাদেশকে অবশ্যই সেই পথ এড়িয়ে চলতে হবে। সংকটের আগাম লক্ষণ নির্দেশকারী আন্তর্জাতিক রেটিং সংস্থা মুডিসের রেটিং অবনমনের বিষয়টি আমাদের উপেক্ষা করা ঠিক হবে না। দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে, আমাদের সরকার সমালোচনামূলক তথ্য-উপাত্ত উপেক্ষা করে বাংলাদেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক বেশি মোহগ্রস্ত। ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি হবে—এ ধরনের জনপ্রিয় আন্তর্জাতিক প্রচারণা উঁচু প্রবৃদ্ধি নিয়ে স্থায়ী বিভ্রম তৈরি করছে। অনিশ্চয়তার সময়ে এ ধরনের অতি আশাবাদ ঋণের ফাঁদে পড়ার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
অর্থনৈতিক চাপ কাটিয়ে ওঠার জন্য কোন কোন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বাড়তি মনোযোগ বা উদ্যোগ দরকার বলে মনে করেন?
নিয়াজ আসাদুল্লাহ: দুই ক্ষেত্রে নজর বাড়াতে হবে—জিডিপির অনুপাতে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি এবং আর্থিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা। ঋণখেলাপিদের লাগাম টেনে ধরার পাশাপাশি বিদেশে অবৈধ অর্থ পাচার বন্ধ করতে হবে। আইএমএফ আমাদের যে ঋণ দিচ্ছে, তার শর্ত হিসেবে এর অনেকগুলোকেই পূরণ করতে বলেছে। পূর্বসতর্কতামূলক পদক্ষেপ হিসেবে কমপক্ষে এগুলোর পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা উচিত। কিন্তু বাস্তবতা হলো মাঝেমধ্যে মিতব্যয়িতার গালভরা বুলি ছাড়া সরকারি অর্থ ব্যয়ে জবাবদিহি বাড়ানোর কোনো বাস্তব পদক্ষেপ দেখা যায় না। লোভী রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী ক্রোনিদের মধ্যে বিদ্যমান অনৈতিক জোটই প্রয়োজনীয় সংস্কারের পথে মূল বাধা। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে আমাদের চলতি নীতিতে মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে। সমালোচনা ও ভিন্নমতাবলম্বীদের বক্তব্য শুনবে—এমন একটি দায়িত্বশীল ও স্বচ্ছ সরকারব্যবস্থা ছাড়া কার্যকর ও বিশ্বাসযোগ্য অর্থনৈতিক সংস্কার সম্ভব নয়।
আন্তর্জাতিক মন্দার পূর্বাভাস রয়েছে। আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বা এর গতিপ্রকৃতি কী? বাংলাদেশের ওপর তা কতটা প্রভাব ফেলতে পারে?
নিয়াজ আসাদুল্লাহ: আইএমএফের বৈশ্বিক অর্থনীতির পূর্বাভাস অপরিবর্তিত রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টস রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বিশ্ব গত তিন দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম প্রবৃদ্ধি দেখবে। বিশ্বায়নের যুগে উচ্চ আয়ের দেশগুলোয় ধীর প্রবৃদ্ধির বর্তমান ধারা উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য নতুন সংকট সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের মতো সব কটি উদীয়মান অর্থনীতি, যারা উচ্চ আয়ের ওইসিডি দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য করে অতীতে লাভবান হয়েছে, তারা সবাই একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির দুই স্তম্ভ—তৈরি পোশাকশিল্প ও প্রবাসী শ্রমিক—বিশ্ব অর্থনীতির বর্তমান অবস্থায় নাজুক পরিস্থিতিতে আছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এরই মধ্যে দেশভিত্তিক পূর্বাভাসে বাংলাদেশের জন্য তাদের প্রবৃদ্ধি পুনর্নির্ধারণ করেছে।
আপনি মালয়েশিয়ায় কর্মরত। প্রজেক্ট সিন্ডিকেটের এক লেখায় লিখেছিলেন, মালয়েশিয়ায় শ্রমিকের সংকট তৈরি হবে এবং বিদেশি শ্রমিকের চাহিদা বাড়বে। বাংলাদেশ এই সুযোগ কীভাবে কাজে লাগাতে পারে?
নিয়াজ আসাদুল্লাহ: করোনা মহামারি-পরবর্তী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু হওয়ায় বিশ্বে মানবসম্পদের যে প্রকট ঘাটতি দেখা দেয়, তাতে আমাদের জন্য সুযোগের দরজা খুলে দেয়। মালয়েশিয়ার অর্থনীতি দ্রুত পুনরুদ্ধার হচ্ছে; শিল্প খাতের নেতারা অভিবাসনের ওপর থাকা কড়াকড়ি শিথিল করে বিদেশি শ্রমিক নিয়ে আসার দাবি জানাচ্ছেন। একটি সূত্রে জানা যাচ্ছে, মালয়েশিয়ার শ্রম দপ্তর ৩ লাখ ৫০ হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক নিয়োগের অনুমোদন দিয়েছে; এর মধ্যে ১ লাখ ৩০ হাজার শ্রমিক এরই মধ্যে মালয়েশিয়া চলে এসেছেন।
দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে, নতুন চাহিদার এ সুযোগ নিতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার পুনরায় চালু হওয়ার আগেই আমি অভিবাসী শ্রমিকের বাজারের বিদ্যমান ‘লৌহ ত্রিভুজ’ নিয়ে সতর্ক করেছিলাম। আমি বলেছিলাম, আমলা, রাজনীতিবিদ ও জনশক্তি রপ্তানিকারকদের অশুভ সিন্ডিকেট—যারা প্রবাসগামী তরুণদের কাছ থেকে মুনাফা করার সুযোগ খুঁজবে। আমার সেই ভয় সত্যে পরিণত হয়েছে। মধ্যস্বত্বভোগীদের মোটা অঙ্কের ফি দিয়ে তাঁদের মালয়েশিয়া আসতে হচ্ছে এবং চাকরি নিয়ে কেলেঙ্কারির ঘটনাও ঘটছে। আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে চাহিদার সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগাতে হলে আমাদের জনশক্তি রপ্তানি শিল্পে শুদ্ধি অভিযান চালাতে হবে, এই শ্রমবাজারকে মধ্যস্বত্বভোগী বা দালালমুক্ত করতে হবে।
আপনার পরামর্শ কী?
নিয়াজ আসাদুল্লাহ: অভিবাসন ব্যয় সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে আনতে হলে এবং শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষিত রাখতে হলে দেশে ও বিদেশে প্রতিযোগিতামূলক শ্রমবাজার গড়ে তোলা আবশ্যক। আমরা দীর্ঘদিন ধরে জনশক্তি বাণিজ্যে সব ধরনের অনিয়মের জন্য বিদেশিদের দোষারোপ করে আসছি। কিন্তু আমরা আমাদের নিজেদের প্রতিষ্ঠানগুলোকে জবাবদিহির মধ্যে আনতে পারিনি। সিন্ডিকেটের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের যেসব ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান এর সঙ্গে জড়িত, তাদের চিহ্নিত করিনি। মাঝেমধ্যে আমরা মালয়েশিয়া সরকারের বিদেশি শ্রমিক নিয়োগের প্রক্রিয়া আরও বেশি স্বচ্ছ করার দাবি করে গিয়েছি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশের মধ্যস্বত্বভোগীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া মালয়েশিয়ার কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষে শ্রমিক শোষণ অসম্ভব।
মালয়েশিয়ার নতুন সরকার এ ক্ষেত্রে কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে।
নিয়াজ আসাদুল্লাহ: নতুন প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম এ বিষয়ে জনমুখী অবস্থান নিয়েছেন। জনশক্তিশিল্পে একচেটিয়াতন্ত্রের অবসান এবং দুর্নীতি কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে ‘শূন্য সহিষ্ণুতা’ নীতি নিয়েছে তার সরকার। কাজ পাওয়ার জন্য উচ্চ মূল্যের ফি দেওয়ার পরও কেন এত বেশি বাংলাদেশি নিয়োগপত্র ছাড়াই মালয়েশিয়ায় আসেন, সে বিষয়ে তদন্ত চলছে। প্রবাসী শ্রমিকের কোটা পূরণের ক্ষেত্রে যদি কোনো প্রতারণা প্রমাণিত হয়, তাহলে মালয়েশিয়ার দুর্নীতি দমন কমিশন যেকোনো ধরনের কঠোর পদক্ষেপ নিতে দ্বিধা করবে বলে মনে হয় না।
আপনাকে ধন্যবাদ।
নিয়াজ আসাদুল্লাহ: ধন্যবাদ।