মতামত

চট্টগ্রামে একে একে হারিয়ে যাওয়া খেলার মাঠগুলো

চট্টগ্রাম নগরের কাজীর দেউড়ি আউটার স্টেডিয়াম
ছবি: প্রথম আলো

চট্টগ্রাম নগরের কাজীর দেউড়ি আউটার স্টেডিয়াম এখন জঞ্জালমুক্ত। চারপাশে অবৈধ বাণিজ্যিক স্থাপনাগুলো তুলে ফেলার পর চোখের সামনে খোলা প্রান্তর দেখে মনে শান্তি আসে।  ১৭ এপ্রিল সোমবার সকাল ১০টায় দেখা গেল এই প্রচণ্ড গরমের মধ্যেও কিছু খেলোয়াড় সেখানে নেট প্র্যাকটিস করছেন। মাঠের পূর্ব দিকে রাস্তার পাশে নুর আহমদ সড়কের ফুটপাতের সঙ্গে লাগানো কংক্রিটের স্থাপনা ভাঙছেন কয়েকজন শ্রমিক। এতে মাঠের পরিসর আরও বাড়বে। মাঠটি দখলমুক্ত করতে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে চট্টগ্রামের সব স্তরের মানুষ।

চট্টগ্রামের এম এ আজিজ স্টেডিয়ামসংলগ্ন এ আউটার স্টেডিয়াম এবং খেলার মাঠগুলো নিয়ে চট্টগ্রামবাসীর আফসোসের সীমা নেই। এগুলোতে সারা বছর বাণিজ্য মেলা, বৃক্ষমেলা, শিল্প মেলা, আমের মেলা, বিজয় মেলা, স্বাধীনতা মেলা, বৈশাখী মেলা, তাঁতবস্ত্রের মেলা, খাদ্যমেলা ইত্যাদি বিভিন্ন মৌসুমি মেলার কারণে খেলাধুলা বন্ধ থাকে।

মাঠে যখন মেলা হয়, তখন ইট বালু আর অস্থায়ী স্থাপনার কারণে মাঠ ক্ষতবিক্ষত হয়। খেলার পরিবেশ থাকে না। যার কারণে নবীন খেলোয়াড়েরা প্রশিক্ষণের সুযোগ পায় না। অথচ আউটার স্টেডিয়ামে অনুশীলন করেই বেড়ে ওঠেছিলেন অনেক তারকা ক্রিকেটার। এখানে অনুশীলন করতেন আকরাম খান, মিনহাজুল আবেদীন, নুরুল আবেদীন নোবেল, আফতাব আহমেদ, তামিম ইকবাল। এখানেই খেলতেন ফুটবলার আশীষ ভদ্র, ইকবাল খান, দিলীপ বড়ুয়া, সুহাস বড়ুয়াসহ আরও অনেকে। দেশের দ্রুততম মানব অ্যাথলেট মোশাররফ হোসেন শামীমও অনুশীলন করতেন আউটার স্টেডিয়ামে।

১৯৯৫ সালে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) মহাপরিকল্পনায় শিশু-কিশোরদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশকে মাথায় রেখে পুরো নগরের ১০ শতাংশ জায়গা উন্মুক্ত রাখার বিধান রাখা হয়েছিল। কিন্তু তখন যতগুলো মাঠ ছিল, এখন তা–ও নেই। গত কয়েক দশকে নগরে জনসংখ্যা বাড়লেও খেলার স্থানগুলো এভাবে হারিয়ে যেতে বসায় চট্টগ্রাম থেকে আগের মতো খেলোয়াড় উঠে আসছে না।

স্বাধীনতাপূর্ব সময়ে আউটার স্টেডিয়ামে অন্তত ৪টি ফুটবল ম্যাচ খেলার পরিসর ছিল। অর্থাৎ, ৮টি দলে ৮৮ জন খেলোয়াড় একত্রে অনুশীলন করতে পারত। পাশাপাশি ক্রিকেটও খেলা হতো। আগেই বললাম, চট্টগ্রাম থেকে অনেক জাতীয় দলের খেলোয়াড়ের জন্ম হয়েছিল এ আউটার স্টেডিয়ামে। অথচ এই আউটার স্টেডিয়ামকে বারবার ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে। একবার করেছে পিডিবি, তাদের পাওয়ার স্টেশন তৈরি করে। এরপর করেছে স্বয়ং চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থা (সিজেকেএস)। তারা প্রথমে দক্ষিণ–পূর্ব কোণে বিশাল এক মার্কেট নির্মাণ করে, এরপর পূর্ব দিকে মার্কেটের কাজ শুরু করে আউটার স্টেডিয়ামকে অবরুদ্ধ করে দেয়। সর্বশেষ এক-তৃতীয়াংশ জায়গায় নির্মিত হয়েছে সুইমিং পুল। চট্টগ্রামবাসীর বিরোধিতার মুখেও সুইমিং পুল নির্মাণ করে আউটার স্টেডিয়ামটি সংকুচিত করা হয়েছে।

চট্টগ্রামের কাজীর দেউড়ির পুরোনো বাসিন্দা কবি প্রাবন্ধিক আবুল মোমেন বলেন, ‘এখন যেখানে স্টেডিয়াম আর আউটার স্টেডিয়াম, দক্ষিণের সুইমিং পুল ও মার্কেট এবং বিদ্যুৎ দপ্তর—সবটা জুড়ে ছিল বিশাল মাঠ, বলা যায় তেপান্তরের মাঠ। ওখানেই চারটি দল অন্তত খেলতে পারত। আর ওদিকে একটু উত্তর-পশ্চিমে রাস্তার পরে এখন যেখানে শিশুপার্ক, সেটিও ছিল খোলা মাঠ, যেখানে অন্তত দুটি দলের খেলা চলত। বর্তমানে জিয়া জাদুঘর, মানে তখনকার সার্কিট হাউসের ভেতরেও একটি মাঠ ছিল, মাঝেমধ্যে ওখানেই আমরা ফুটবল খেলতাম। অন্য মাঠে ফুটবল-ক্রিকেট দুটিই চলত। সার্কিট হাউস আর চট্টগ্রাম ক্লাবের মধ্যে ছিল একটি মাঠ—প্রকৃতি নিজেই দুই পাশের টিলায় গ্যালারি করে দিয়েছিল।’

আবুল মোমেনের স্মৃতিভাষ্যে আমরা এক গৌরবময় ঐতিহ্যের কথা জানতে পারলাম। কিন্তু সেই ঐতিহ্য আমরা হারিয়ে ফেলেছি বাণিজ্য চিন্তায়। একের পর এক মাঠ আমরা হারিয়ে ফেলছি। চট্টগ্রাম শহরে একসময় লালদীঘি মাঠ, কলেজিয়েট স্কুল মাঠ, পলোগ্রাউন্ড, জাম্বুরী মাঠ, আউটার স্টেডিয়াম মাঠ, চট্টগ্রাম সরকারি স্কুলের মাঠ, প্যারেড মাঠ, শহীদ শাহজাহান মাঠ, সেন্ট প্লাসিডস স্কুলের মাঠ, নাসিরাবাদ স্কুল মাঠ, জামিয়াতুল ফালাহ মসজিদ মাঠ, হালিশহর আবাহনী মাঠ খেলাধুলা করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ মাঠ হিসেবে চিহ্নিত ছিল। তা ছাড়া ছোট–বড় আরও অনেক খেলার মাঠ ছিল, যার অনেকগুলোই এখন সংকুচিত হয়ে গেছে বা হারিয়ে গেছে।
জাম্বুরী মাঠ হারিয়ে গেছে পার্কের নিচে। অথচ পার্কের চেয়ে মাঠের প্রয়োজনীয়তা কোনো অংশেই কম নয়। সেন্ট প্লাসিডস স্কুলের মাঠ দেয়ালঘেরা। কার্যত নগরে এখন মাত্র দুটি খেলার মাঠ আছে। একটি চকবাজারের প্যারেড মাঠ, অন্যটি কাজীর দেউড়ির সংকুচিত আউটার স্টেডিয়াম। খেলাধুলার মাঠ ধ্বংস করার এমন অসুস্থ প্রবণতা হয়তো পৃথিবীর কোথাও পাওয়া যাবে না। অথচ ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সঠিক পথে রাখতে, মাদকসহ বিভিন্ন খারাপ অভ্যাস থেকে মুক্ত রাখার জন্য খেলাধুলার কোনো বিকল্প নেই।

তবে সম্প্রতি জেলা প্রশাসনের এ উদ্যোগ আমাদের আশাবাদী করেছে। এই আউটার স্টেডিয়ামে আর কোনো ধরনের মেলা হবে না বলে গত মাসে ঘোষণা দিয়েছেন জেলা প্রশাসক ও চট্টগ্রাম ক্রীড়া সংস্থার সভাপতি আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান। তিনি জানিয়েছেন, সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও সার্ভেয়ার দিয়ে আউটার স্টেডিয়ামের সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছে। লাল খুঁটি দিয়ে সীমানা চিহ্নিত করা হবে। মাঠে কোনো অবৈধ স্থাপনা থাকবে না। ভবিষ্যতেও কোনো স্থাপনা করতে দেওয়া হবে না।

আউটার স্টেডিয়ামের সঙ্গে চট্টগ্রামের ক্রীড়াঙ্গনের ইতিহাস যেন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। চট্টগ্রামের খেলাধুলার ভবিষ্যতও এটির ওপর অনেকটা নির্ভর করে। সেই ভবিষ্যৎকে স্বপ্নময় করতে এ ধরনের সিদ্ধান্ত বা উদ্যোগের খুবই প্রয়োজন ছিল। শুধু আউটার স্টেডিয়াম রক্ষা নয়, পলোগ্রাউন্ড মাঠকেও খেলার উপযোগী করে তোলার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি চট্টগ্রামের ১৫ উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে খেলার মাঠ নির্মাণেরও সিদ্ধান্ত নিয়েছে জেলা প্রশাসন। এ জনবান্ধব সিদ্ধান্ত বা কার্যক্রম চট্টগ্রামবাসীকে আশ্বস্ত করেছে। তবে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা বিবেচনা করে চট্টগ্রাম নগরের পুরোনো মাঠগুলো উদ্ধারের পাশাপাশি প্রতি ওয়ার্ড অন্তত একটি করে খেলার মাঠ তৈরির পরিকল্পনা খুবই জরুরি।

  • ওমর কায়সার প্রথম আলোর চট্টগ্রাম অফিসের বার্তা সম্পাদক