স্বাস্থ্য মানেই চিকিৎসা না

বাংলাদেশে স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা করার অন্যতম অসুবিধা হলো চটজলদি সবাই স্বাস্থ্য আর চিকিৎসাকে একাকার করে ফেলেন আর আলোচনা হয়ে উঠে ডাক্তারকেন্দ্রিক। মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবস্থায় স্বাস্থ্যের সংজ্ঞা হিসেবে যা মুখস্থ করেছিলেন তা বেমালুম ভুলে ডাক্তাররাও একই কাজ করেন।

স্বাস্থ্য মানে রোগ সারিয়ে তোলা নয়, রোগ বা বিকলাঙ্গতার অনুপস্থিতিও নয়; রোগ নিবারণ এবং প্রতিরোধও; স্বাস্থ্য মানে শুধু শারীরিক দিক থেকে ভালো থাকা নয়, শারীরিক, মানসিক এবং আধ্যাত্মিক সুস্থতার একটি ভালো অবস্থা।

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় স্বাস্থ্যসচিব ছিলেন ডাক্তার টি হোসেন। ১৯৭৫ সালের নভেম্বরের পরে, সচিব হিসেবে প্রশাসন ক্যাডারের লোকজন স্বাস্থ্যসচিব হিসেবে নিয়োজিত হন। সেই ধারা এখনো অব্যাহত আছে। স্বাস্থ্য খাতের দেখভালের জন্য বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে স্বাস্থ্য ক্যাডারের বাইরে যেতে দেয়নি।

স্বাস্থ্য খাতের সমস্যাগুলো স্বাস্থ্য খাতে লেখাপড়া করা ও প্রশিক্ষিত একজন যেভাবে বুঝতে পারবেন, প্রশাসনের আরেকজন হঠাৎ করে নাজেল হয়ে তা পারেন না। ফলে সমস্যার সমাধান না হয়ে জঞ্জালের পাহাড় জমতে থাকে। এভাবেই আজ অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে স্বাস্থ্য খাতে সংস্কারের বড় চ্যালেঞ্জ এসেছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ইতিহাসে বেশির ভাগ সময় ডাক্তার নন এমন রাজনৈতিক নেতাই মন্ত্রী হয়েছেন। এমনকি ডাক্তার কাম রাজনৈতিক নেতাও মন্ত্রী হয়েছেন। স্বাস্থ্য খাতের নেতৃত্ব দেওয়ায় কারা বেশি কার্যকর তা বলা মুশকিল। তবে প্রমাণ করা কঠিন হলেও বলা যায় যে ১৯৯১ থেকে যতজন মন্ত্রী এসেছেন, একজনের চেয়ে পরবর্তীজনের দুর্নীতির জনশ্রুতি ও গল্পগাথা পাল্লা দিয়ে ছাড়িয়ে গেছে এবং অব্যবস্থায় খাতটি এখন খাদের কিনারায়।

এমনি অবস্থায় বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের স্বাস্থ্য উপদেষ্টা স্বাস্থ্য খাতের সংস্কারের জন্য একটি কমিটি করে দিয়েছেন এবং তার সংক্ষিপ্ত কার্যপরিধিও ঠিক করে দিয়েছেন। কমিটির সদস্য নিয়ে বেশ শোরগোল শুরু হয়েছে। প্রথমেই যা দৃষ্টিকটু লেগেছে—গড্ডলিকাপ্রবাহে স্বাস্থ্য আর চিকিৎসাকে একাকার করে শুধুমাত্র চিকিৎসকদের দিয়ে কমিটিটি হয়েছে। দেখে মনে হতে পারে, একটি মেডিকেল বোর্ড। বেশির ভাগ সদস্য প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন।

এই কমিটি হোক জনস্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের নিয়ে যেখানে চিকিৎসকদের চেয়ে স্বাস্থ্য খাতের পরীক্ষিত জনবল বিশেষ করে তরুণ ও নারীদের প্রাধান্য থাকে। আর উভয় কমিটির কার্যপরিধিতে খাতসংশ্লিষ্ট অন্যান্য অংশীজনের সঙ্গে সংলাপ করার নির্দেশনাও যেন থাকে। তাহলে, স্বাস্থ্য উপদেষ্টা স্বাস্থ্য খাতের সংস্কারের কার্যকর রূপরেখা পেতে পারেন।

কাউকে কাউকে যদি গ্রাম থেকে রাজধানী পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার মানব সম্পদ বা গঠন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়, তাহলে বলতে পারবেন কি না সন্দেহ। দু-তিনজন ছাড়া সবাই অবসরপ্রাপ্ত; যে আন্দোলনের প্রেক্ষিতে আজ স্বাস্থ্য খাতের সংস্কারের প্রশ্ন এসেছে, সেই তরুণ প্রজন্মের কেউ তো নেইই, তরুণ প্রজন্মের ধারে কাছেও কেউ নেই। আর নারীর অংশগ্রহণ দৃষ্টিকটুভাবে অপ্রতুল।

স্বাস্থ্য উপদেষ্টাকে বুঝতে হবে যে, তিনি যেমন চিকিৎসক না হয়েও স্বাস্থ্য খাতকে নেতৃত্ব দিতে পারেন, তেমনি স্বাস্থ্য খাতের সংস্কারে ডাক্তার নন এমন জনস্বাস্থ্য, স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ, তরুণ প্রজন্মসহ নানা পেশার, বয়সের ও ধর্মের মানুষকে কমিটিতে থাকতে হবে।

প্রথম আলোর সঙ্গে সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও অন্যদের প্রণীত ওষুধনীতি ও স্বাস্থ্যনীতির প্রশংসা করে তার আলোকে স্বাস্থ্য খাতের সংস্কারের ইঙ্গিত দিয়েছেন। অথচ এই কমিটিতে তার কোনো প্রতিফলন নেই।

বিএসএমএমইউয়ের উপাচার্য ছাড়া আর কজন সদস্য সেই স্বাস্থ্যনীতি দেখেছেন বা সমর্থন করেছেন সে প্রশ্ন না তুলেও একটি প্রস্তাবনা করছি। যে কমিটি হয়ে গেছে, সেই সদস্যদের জন্য অস্বস্তিকর কিছু না করে এই কমিটিকে কার্যপরিধির অংশবিশেষের অর্থাৎ মেডিকেল শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতের জনপ্রতিষ্ঠান যেমন বিএমডিসি, বিএমআরসি, এসবের সংস্কার এবং নানা স্তরে চিকিৎসা সংক্রান্ত জনবল ও যন্ত্রপাতি নিয়ে প্রস্তাব করার দায়িত্ব দেওয়া হোক।

আরেকটি কমিটি করে কার্যপরিধির বাকি অংশ অর্থাৎ স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিষয়ভিত্তিক সংস্কার (ওষুধ খাতসহ), নগর, গ্রাম, প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বাস্থ্য সেবা এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কাঠামো শক্তিশালী করার প্রস্তাব করার দায়িত্ব দেওয়া হোক।

এই কমিটি হোক জনস্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের নিয়ে যেখানে চিকিৎসকদের চেয়ে স্বাস্থ্য খাতের পরীক্ষিত জনবল বিশেষ করে তরুণ ও নারীদের প্রাধান্য থাকে। আর উভয় কমিটির কার্যপরিধিতে খাতসংশ্লিষ্ট অন্যান্য অংশীজনের সঙ্গে সংলাপ করার নির্দেশনাও যেন থাকে। তাহলে, স্বাস্থ্য উপদেষ্টা স্বাস্থ্য খাতের সংস্কারের কার্যকর রূপরেখা পেতে পারেন।

  • খায়রুল ইসলাম জনস্বাস্থ্য পেশাজীবী