প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক নুরুল ইসলাম গত সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে মারা গেছেন। স্বাধীনতার পর প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি।
আজকে দিনের শুরু হলো একটা দুঃসংবাদ দিয়ে—এই খবরের জন্য একবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। একধরনের অপরাধবোধও জেগে উঠল। অধ্যাপক নুরুল ইসলাম আর নেই; এই খবরটা দেখে কোনো একদিন দিনের শুরু করতে হবে, এমন কথা কখনোই ভাবিনি। কিন্তু দুঃসংবাদ আমাদের প্রস্তুতির জন্য অপেক্ষা করে না, কিংবা আসলে আমরা কখনোই কোনো দুঃসংবাদের জন্য প্রস্তুত হতে পারি না। নুরুল ইসলাম স্যারের ক্ষেত্রে তা আরও বেশি এই কারণে যে তিনি ছিলেন অভাবনীয়ভাবে সক্রিয় এবং প্রাণবন্ত মানুষ।
নুরুল ইসলাম স্যারের সঙ্গে আমার যোগাযোগের সূচনা হয়েছিল ২০১৩ সালে, আমি তখন উড্রো উইলসন সেন্টারে কয়েক মাসের জন্য যুক্ত হয়ে ওয়াশিংটনে থাকি।
আখতার মাহমুদের সূত্রেই স্যারের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ। তাঁর লেখা এবং তাঁর কাজের সঙ্গে দীর্ঘ পরিচয় সত্ত্বেও এর আগে তাঁকে কাছে থেকে দেখার, কথা বলার সুযোগ হয়নি। এরপর গত এক দশকে স্যারের সঙ্গে দেখা হয়েছে বহুবার, তার চেয়ে বেশি কথা হয়েছে ফোনে। স্যারের সঙ্গে ফোনের আলাপগুলো কখনোই স্বল্প সময়ের নয়, এগুলোর অধিকাংশই বাংলাদেশের ইতিহাস-রাজনীতি-অর্থনীতি নিয়ে, যার প্রেক্ষাপট হচ্ছে বিশ্বের ঘটনাপ্রবাহ।
আমাদের কথোপকথনের সূচনা যেভাবেই হোক, এর মধ্যে একপর্যায়ে স্যারের প্রশ্নগুলোই হয়ে উঠত প্রধান বিষয়। অধিকাংশ আলোচনার সূত্রপাত হতো, তা দেখা হলে বা ফোনে, আমি কী লিখেছি, কী নিয়ে কাজ করছি, সেই সব বিষয়ে। কিন্তু আমাদের এসব কথাবার্তায় স্যারের প্রশ্নগুলোই ছিল মুখ্য এই কারণে যে এগুলোকে কেন্দ্র করেই আমরা কথা বলতাম। আমি বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করেছি, যেকোনো প্রপঞ্চকে ভিন্নভাবে প্রশ্ন করার এক অভাবনীয় ক্ষমতা ছিল তাঁর। তাঁর সঙ্গে কথা বলা মানে ছিল মাথার ভেতরে নতুন নতুন প্রশ্ন ঢুকে পড়া। ফলে স্যারের সঙ্গে কথা বলা শেষ হওয়ার অর্থ ফোন রাখা নয় কিংবা ওয়াশিংটন থেকে বাড়ি ফেরা নয়। ওয়াশিংটনে আমাদের দেখা হওয়ার জায়গা ছিল একটি কফির দোকান। স্যার সেখানে নিয়মিতভাবে যেতেন। ফলে আমি ওয়াশিংটনে গেলে সেখানেই যেতে বলতেন। সাধারণত সেটা সপ্তাহান্তে। আড্ডায় এই বয়সে তিনি ছিলেন প্রাণবন্ত এবং কৌতূহলী। কিন্তু তার চেয়েও বড় বিষয় ছিল যে তিনি প্রচলিত চিন্তাগুলোকে বারবার প্রশ্ন করতেন। অন্যদের চিন্তাকে যেমন, তেমনি তাঁর নিজের চিন্তাকেও। ফলে তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়া বা কথা বলার ফল হতো একধরনের আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি হওয়া। তাঁর প্রশংসা ছিল প্রাপ্তি, কিন্তু তার চেয়েও বেশি ছিল অনুপ্রেরণা। ফলে স্যারের সঙ্গে দেখা করার একটা আশু লাভও ছিল আমার জন্য।
একটা বিস্ময়কর বিষয় ছিল তাঁর স্মরণশক্তি। কেবল বাংলাদেশের ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহই যে তাঁর স্মরণে থাকত তা নয়। ২০১৫ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (বিডিআই) তাদের সম্মেলনে আজীবন সম্মাননা প্রদান করে। অনুষ্ঠানটি হয়েছে ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলেতে। সেখানে তাঁর দেওয়া বক্তৃতার পরে—অনুষ্ঠানে এবং অনানুষ্ঠানিক কথাবার্তায় তাঁকে কিছু প্রশ্ন করার সুযোগ হয়। এর কিছু উত্তর তিনি দেন। এর প্রায় তিন মাস পরে আমার সঙ্গে ওয়াশিংটনে কথাবার্তায় তিনি স্মরণ করিয়ে দেন যে সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়া হয়নি। আমি রসিকতা করে বলেছিলাম, প্রশ্নগুলোই তো আমার মনে নেই। এ ধরনের ঘটনা এর পরে অনেকবার ঘটেছে, আমাদের অসমাপ্ত আলোচনার সূত্রপাত তিনিই ঘটিয়েছেন; আমাকে বলেছেন এই বিষয়ে আর কোথায় আমি আরও বেশি জানতে পারব।
এবার অপরাধবোধের কথা বলি। ২০১৩ থেকে ২০২০ পর্যন্ত ওয়াশিংটনে মুখোমুখি দেখাসাক্ষাৎ ঘটার পাশাপাশি টেলিফোনেও কথা হয়েছে। কোভিড অতিমারির কারণে যাতায়াত হ্রাস পায়, কিন্তু কথাবার্তায় ছেদ পড়েনি। কিন্তু এই বছরের গোড়া থেকে স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে পড়েছিল। ইতিমধ্যে আমি তিন মাস দেশের বাইরে থাকায় কথা হয়নি, স্যারের খোঁজ নেওয়া হয়নি। এপ্রিলের শেষে বাড়ি ফিরে ভেবেছি একটু গুছিয়ে নিয়েই স্যারে সঙ্গে যোগাযোগ করব। সম্ভবত আগামীবার ওয়াশিংটনে গেলে স্যারের সঙ্গে সাক্ষাৎও করা হবে। এখন অপরাধ বোধ করছি এই ভেবে যে সুইডেন থেকে কিংবা এসেই যোগাযোগ করলাম না কেন।
নুরুল ইসলাম স্যারের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত এই সব স্মৃতি আমার জন্য অমূল্য সম্পদ। কিন্তু অধ্যাপক নুরুল ইসলামকে আমাদের বিবেচনা করতে হবে বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের ইতিহাসের অংশ হিসেবে। তাঁর এই ভূমিকার কথা তিনি আন্তরিকভাবেই বর্ণনা করেছেন তাঁর দুটি আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে—অ্যান অডিসি: দ্য জার্নি অব মাই লাইফ (প্রথমা, ২০১৭) এবং মেকিং অব আ নেশন—বাংলাদেশ: অ্যান ইকোনমিস্টস টেল (ইউপিএল, ২০০৩)। এই দুই বইয়ে অধ্যাপক নুরুল ইসলাম কেবল তাঁর কর্মজীবনের কথা বলেননি, তিনি স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পটভূমি তুলে ধরেছেন। তাঁর দীর্ঘ এবং সফল কর্মজীবনের ইতিহাস আমাদের অবশ্যই আকর্ষণ করে। কেননা তাঁর কাজের পরিধি বিশাল, তিনি আন্তর্জাতিক পরিসরে নীতিনির্ধারণী প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। তাঁর এসব অভিজ্ঞতা আমাদের সমৃদ্ধ করে। কিন্তু তাঁর এই দুই বইয়েই আছে বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের উপপ্রধান হিসেবে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা—কী করে অর্থনীতির দিকনির্দেশনা তৈরি হয়েছিল, তাঁর অনুপুঙ্খ আলোচনা এবং বিশ্লেষণ। বাংলাদেশের ইতিহাসের এই পর্যায় নিয়ে এখন আলোচনা অনেকটাই সীমিত হয়ে এসেছে। সে কারণেও অধ্যাপক নুরুল ইসলামের এই দুই বই আমাদের মনোযোগ দাবি করে, বাংলাদেশকে বোঝার জন্য অবশ্যপাঠ্য বইয়ের তালিকায় যুক্ত হয়।
এই দুটি বই নিয়ে আলোচনায় ২০১৮ সালে যা লিখেছিলাম, তা পুনরায় উল্লেখ করতে চাই, অধ্যাপক নুরুল ইসলামের জীবনের যে অধ্যায় সবচেয়ে বেশি জ্ঞাত ও আলোচিত, তার সময়কাল স্বল্প কিন্তু গুরুত্ব অপরিসীম। তা হচ্ছে, বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের উপপ্রধান হিসেবে তাঁর এবং কমিশনের ভূমিকা। বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের প্রাতিষ্ঠানিক পর্বের সূচনা বলেই আমরা সেই সময়কে বিবেচনা করতে পারি। তাঁর মেকিং অব আ নেশন গ্রন্থের দ্বিতীয় অংশের আটটি অধ্যায়ের সাতটিই এই বিষয়ে; অ্যান অডিসি গ্রন্থের সবচেয়ে দীর্ঘ অধ্যায় হচ্ছে পঞ্চম অধ্যায়, যা তাঁর ওই সময়ের অভিজ্ঞতার অনুপুঙ্খ এবং গুরুত্বপূর্ণ বর্ণনা। এসব অধ্যায়ে বিবৃত বিভিন্ন অভিজ্ঞতার সারাংশ সংক্ষেপে তুলে ধরা একাদিক্রমে অসম্ভব এবং অনুচিত, কেননা এই কথাগুলো অধ্যাপক নুরুল ইসলামের বয়ানেই শোনা জরুরি (‘এক দীর্ঘ জীবনের আন্তরিক বয়ান’, প্রথম আলো, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৮)।
সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রের গঠন এবং পরিবর্তনে ভূমিকা রাখেন, এমন চিন্তাশীল মানুষের জীবনাবসান তাঁদের ভূমিকার অবসান ঘটায় না। তাঁরা আমাদের চিন্তাকে আলোড়িত করে আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি করে যেতে থাকেন। অধ্যাপক নুরুল ইসলাম এভাবেই আমাদের মাঝে থাকবেন—আমাদের ব্যক্তিগত স্মৃতি এবং তাঁর কাজের মধ্য দিয়ে।
* আলী রীয়াজ : যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট।