নির্বাচন

নতুন ইসি রাজনৈতিক দলগুলোকে কীভাবে সামলাবেন

নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সঙ্গে বৃহস্পতিবার সংবাদপত্রের সম্পাদক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের মতবিনিময় সভা ছিল। সকালে নির্বাচন কমিশন ভবনে যেতেই রোকেয়া সরণিতে অবরোধের মুখে পড়ি। তিন দিনের মধ্যে ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের ঘোষণায় চালকেরা রাস্তা বন্ধ করে দেন। তাঁদের বক্তব্য, বিকল্প কাজের ব্যবস্থা না করে এভাবে হুট করে যান বন্ধ করে দিলে তো তাঁদের না খেয়ে মরতে হবে। 

সরকার নির্বাচনব্যবস্থাসহ আরও অনেক রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সংস্কারের উদ্যোগ নিলেও এই খেটে খাওয়া ও কাজ হারানো মানুষগুলোর কথা ভাবছে না। একবার সরকার বলছে ব্যাটারিচালিত রিকশা বড় রাস্তায় চলতে পারবে না। অলিগলিতে চলতে পারবে। আবার বলছে কোথাও চলতে পারবে না। ঢাকা শহরে ব্যাটারিচালিত রিকশার সংখ্যা কমপক্ষে ছয় লাখ। অনেকে ঋণের টাকায় এ যান কেনেন। রিকশাই যদি চালাতে না পারেন, তাঁরা সেই ঋণ পরিশোধ কীভাবে করবেন?

টেলিভিশনে শুনলাম একজন কর্মকর্তা বলছেন, ‘আদালতের নির্দেশের পর আমাদের কিছু করার নেই।’ তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, সবকিছুতে আদালতের দোহাই দেবেন না। সরকারি চাকরিতে আওয়ামী লীগ সরকারের কোটা বাতিলের সিদ্ধান্তও অবৈধ ঘোষণা করেছিলেন আদালত। এরপর কী কাণ্ড ঘটেছে, নিশ্চয়ই তাঁর অজানা নয়। কথা হচ্ছে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের আয়ের বিকল্প ব্যবস্থা করার আগে এটি বন্ধ করা যাবে না। মানুষের ক্ষুধার ওপরে কোনো আইন নেই।  

নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার তিন দশক ধরে নির্বাচন নিয়ে কাজ করেন। বিএনপি আমলে তিনি যখন সৎ ও যোগ্য প্রার্থী আন্দোলন করেছিলেন, ক্ষমতাসীনেরা তাঁকে আওয়ামী লীগের দালাল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। আবার আওয়ামী লীগ সরকারের তিনটি জবরদস্তির নির্বাচন নিয়ে যখন তিনি কথা বলেছেন, আওয়ামী লীগের নেতারা তাঁকে ‘গণশত্রু’ আখ্যায়িত করেছেন। এই হলো আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি।

কমিশনের সঙ্গে সাংবাদিকদের আলোচনায় নির্বাচনে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা, নির্বাচিত সরকার ও রাজনৈতিক দলের চরিত্র ইত্যাদি উঠে আসে। ক্ষমতাকামী রাজনীতিকেরা নিজেদের ক্ষমতার বাইরে দেখতে অভ্যস্ত নন। বলা হয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে চারটি নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে (১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮)। কিন্তু পরাজিত দল জনগণের সেই রায় সানন্দে মেনে নেয়নি। তারা এর মধ্যে সূক্ষ্ম ও স্থূল কারচুপি খুঁজেছে। আর গত তিনটি নির্বাচনে তো মানুষ ভোটই দিতে পারেননি। 

সরকারি দল বরাবর সবকিছু দখলে রাখতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছে। অন্যদিকে বিরোধী দল সংসদ বর্জন ও রাজপথের আন্দোলনে মুক্তি খুঁজেছে। ফলে গত ৫৩ বছরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা টেকসই হয়নি। প্রতিটি নির্বাচিত সরকার স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে উঠেছে। কেউ কম, কেউ বেশি। 

অর্থাৎ সমস্যাটি কেবল নির্বাচনের নয়, রাজনৈতিক সংস্কৃতির। কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় সবাই একমত যে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা অবশ্যই ফিরিয়ে আনতে হবে। ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন বর্তমান অন্তর্বতী সরকারের অধীনেই হবে। কিন্তু পরবর্তী নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করতে হলে নতুন করে আইন করতে হবে এবং সেই দায়িত্ব পরবর্তী নির্বাচিত সরকারকে নিতে হবে। 

আলোচনায় উঠে আসে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের বিষয়টিও। শেখ হাসিনার শাসনামলে যে রকম একতরফা নির্বাচন হয়েছে, বিরোধীদের নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে, সে রকম নির্বাচন কেউ দেখতে চায় না। 

কমিশনের সঙ্গে যখন সাংবাদিকদের আলোচনা চলছিল, তখনই নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের খবর এল। কমিশনের প্রধান পদে এসেছেন সাবেক সচিব এ এম এম নাসির উদ্দীন। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি ভোটের অধিকার নিশ্চিত করার ওয়াদা করে বলেছেন, ‘২০১৪ সাল থেকে মানুষ ভোট দিতে পারেনি। গত জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে অনেক মানুষ প্রাণ দিয়েছেন। এই আন্দোলনের মূল বিষয়ই ছিল ভোটের অধিকার নিশ্চিত করা। এত মানুষের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করা সম্ভব নয়।’ 

আলোচকেরা নির্বাচনের সময় স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসনসহ নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়কে নির্বাচন কমিশনের কর্তৃত্বে নিয়ে আসার প্রস্তাব করেছেন। অনেক দেশেই এর উদাহরণ আছে। কাজটি নতুন কমিশন করতে পারবে কি না, সেটাও দেখার বিষয়। আচরণবিধি ভঙ্গকারী দল ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে নির্বাচনের আগেই ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন। প্রয়োজনে প্রার্থিতা বাতিল করতে হবে। নির্বাচনের দায়িত্ব পালনকালে যেসব সরকারি কর্মকর্তা অনিয়ম–দুর্নীতি করবেন, তাঁদের শাস্তিও নিশ্চিত করতে হবে।

২০০৮ সালের নির্বাচনে কমিশন ‘না’ ভোট চালু করেছিল। আওয়ামী লীগ সরকার সেটি বাতিল করে দেয়। বেশির ভাগ সাংবাদিক ও কমিশন সদস্য আবার ‘না’ ভোট চালু করার দাবি জানিয়েছেন। আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবির পাশাপাশি সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরাও যুক্ত ছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকার আইন পরিবর্তন করে তাদের সহায়ক শক্তি হিসেবে রেখেছিল। সেটাও আগের অবস্থায় ফেরত আনা জরুরি। সাংবাদিক প্রতিনিধিরা আরেকটি বিষয় গুরুত্ব দিয়েছেন, কোনো অবস্থায় তঁাদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে বাধা দেওয়া যাবে না। 

কমিশনের সঙ্গে যখন সাংবাদিকদের আলোচনা চলছিল, তখনই নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের খবর এল। কমিশনের প্রধান পদে এসেছেন সাবেক সচিব এ এম এম নাসির উদ্দীন। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি ভোটের অধিকার নিশ্চিত করার ওয়াদা করে বলেছেন, ‘২০১৪ সাল থেকে মানুষ ভোট দিতে পারেনি। গত জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে অনেক মানুষ প্রাণ দিয়েছেন। এই আন্দোলনের মূল বিষয়ই ছিল ভোটের অধিকার নিশ্চিত করা। এত মানুষের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করা সম্ভব নয়।’ 

বর্তমান কমিশনের সামনে যেমন চ্যালেঞ্জ আছে, তেমনি পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাঁরা অনুকূল পরিবেশও পাচ্ছন। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন তাঁদের অনেক কাজ সহজ করে দেবে আশা করা যায়। ২০০৮ সালের পর এই প্রথম নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন হতে যাচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার নিজে ভোট করছে না। সে ক্ষেত্রে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের ওপর তাদের কোনো চাপ থাকবে না।

তবে নতুন কমিশনকে যে চাপের মধ্যে পড়তে হবে, সেটা আসবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী রাজনৈতিক দলগুলো থেকে। সবাই নিজের পক্ষে কমিশনকে রাখতে চাইবে। আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী আন্দোলনে যেসব দল এত দিন পরস্পরের সহযোগী ছিল, নির্বাচনে তারাই প্রতিযোগী হয়ে উঠবে। এতে নির্বাচনী প্রচার–প্রচারণায় একধরনের অস্থিরতা থাকা স্বাভাবিক, যা নির্বাচন কমিশনকে সামাল দিতে হবে দক্ষতার সঙ্গে। 

গত তিনটি নির্বাচনে কমিশন ছিল পুরোপুরি ক্ষমতাসীনদের আজ্ঞাবহ। সরকার যেভাবে নির্বাচন করিয়ে নিতে চেয়েছে, সেভাবেই কমিশন কাজ করেছে। কখনো কখনো কেউ কেউ বিবেক দ্বারা চলতে চাইলেও সেটি শেষ পর্যন্ত পারেননি। যেখানে মানুষ দেখেছে ভোটের মাঠ ফাঁকা, সেখানে ৪০ শতাংশ কিংবা তারও বেশি ভোটের উপস্থিতি দেখানো হয়েছে।

নতুন কমিশনের কাছে ভোটারদের আস্থা ফিরিয়ে আনাও কঠিন কাজ হবে না। একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকার ও নির্বাচন কমিশন একযোগে কাজ করবে আশা করা যায়। কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্ব, প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর নেতা–কর্মীদের আস্থায় নেওয়া এবং তাদের মধ্যে ভারসাম্য রেখে চলা সহজ হবে না। 

জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের প্রবণতা যেদিকে হাওয়া, সেদিকে পাল তুলে দেওয়া। নির্বাচনের আগেই যদি স্পষ্ট হয়ে যায় নির্বাচনে কারা জিতবেন, তাহলে প্রশাসন, পুলিশসহ পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র তাদের পক্ষে কাজ করতে পারে। 

নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলেছেন। কিন্তু আমরা মনে করি, সেটি তখনই সম্ভব যখন নির্বাচনটি হবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও প্রতিযোগিতামূলক। ভোটের অধিকারের পাশাপাশি বাছাইয়ের উন্মুক্ত সুযোগও থাকতে হবে।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

sohrabhassan55@gmail.com