আমাদের আব্বা মো. মোফাজ্জল হক ছিলেন অত্যন্ত সাদাসিধা আর সব সময় মুখে স্মিত হাসিমাখা এক মানুষ।
আমাদের আব্বা মো. মোফাজ্জল হক  ছিলেন অত্যন্ত সাদাসিধা আর সব সময় মুখে স্মিত হাসিমাখা এক মানুষ।

স্মরণ

আমাদের গভীর এক ভালোবাসার নাম আব্বা

আজ বাবা দিবস। আমাদের হৃদয়ের অত্যন্ত গভীর এক ভালোবাসার নাম আব্বা। আমাদের দুই মা। বড় মায়ের কোনো সন্তান ছিল না; সুতরাং আমরা ডবল মায়ের স্নেহ ভালোবাসা নিয়ে বড় হয়েছি।

 আমরা সব ভাইবোন আমাদের বাবার বেশি বয়সের সন্তান। ছোটকাল থেকেই বাবাকে দেখেছি এক প্রৌঢ় শ্মশ্রুমণ্ডিত অসম্ভব সুন্দর মায়ায় আর নূরের আভায় উদ্ভাসিত এক পুরুষ হিসাবে। আমাদের আব্বা মো. মোফাজ্জল হক ছিলেন অত্যন্ত সাদাসিধা আর সব সময় মুখে স্মিত হাসিমাখা এক মানুষ। তিনি সদা সন্তুষ্ট এক মানুষ। সংসারের কোনো দুঃখ–কষ্ট তাঁকে পরাভূত করতে পারেনি। প্রাইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে শিক্ষকতা করতেন।

শারীরিকভাবে খুব সবল অবস্থায় তাঁকে আমরা পাইনি। অফিসে সব সময় পরে থাকতেন সাদা ধবধবে পায়জামা আর পাঞ্জাবি। আমাদের জীবনে এমন সৌম৵ সুন্দর মানুষ আর আমরা দেখিনি। তিনি ছিলেন আধ্যাত্মিক জগতের মানুষ। সারাক্ষণ বিড়বিড় করে কী যেন বলতেন। একদিন জিজ্ঞেস করলাম আব্বা আপনি আপনার ঠোঁট দুটো কেন সব সময় নড়ে। কী পড়েন আপনি? আব্বা হাসেন। বলেন, সব সময় মহান আল্লাহকে স্মরণ করি। আর কৃতজ্ঞতা জানাই। দেখো না কত সুন্দর ছেলেমেয়ে আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন।

মধ্যবিত্ত পরিবারে আমরা বড় হয়েছি। শিক্ষক বাবা খুব বেশি বেতন পেতেন না। মাসের সাত দিন যেতে না যেতেই সব টাকা শেষ। আব্বা বাজার করতে খুব পছন্দ করতেন। বেতন পেয়েই ছুটতেন রংপুরের মাছের বাজারে। পকেটে তো পুরো মাসের বেতনের টাকা আছে। নজর সবচেয়ে বড় মাছটার দিকে। বাজারের এ–মাথা থেকে ও–মাথা হেঁটে চলেছেন। খুব শখ ওই বড় মাছটার দিকে। কী করা যায়? যা হওয়ার হবে, কিনে ফেললেন সবচেয়ে বড় মাছটা। মনে অনেক আনন্দ। সোজা রিকশা নিয়ে বাসায়।

আম্মাদের বলেন, এই দেখো কত বড় মাছ। বাচ্চাদের ডাকো। দেখুক কত বড় মাছ দিয়ে আমরা আজ রাতের খাবার খাব। আম্মার মুখটা হয় গম্ভীর। মাসের শুরুতেই এতগুলো টাকা শেষ হলে সারা মাস চলবে কী করে? আব্বা বলতেন আম্মাকে—চিন্তা কোরো না দিন চলে যাবে এক ভাবে। আম্মা ছিলেন অত্যন্ত সংসারী। সবকিছু তাঁর হিসাবে। পালতেন হাঁস–মুরগি। আমাদের ছিল দুটো গাই গরু। এগুলোর দুধ ছিল আমাদের মূল পুষ্টির জোগানদার।

 উচ্চমাধ্যমিক পাসের পর আমাকে পাঠানো হলো ঢাকায়। বুয়েটে পড়তে। বড় ভাই ও ছোট বোন দুজনই বোর্ডস্ট্যান্ড। কিন্তু সাধ্যের অভাবে তাদের পড়তে হলো রংপুর মেডিকেলে। খরচের কথা ভেবে আমিও পড়তে চাইলাম রংপুর মেডিকেলে; কিন্তু বড় ভাই বললেন ‘না‘। ওকে ঢাকাতেই পড়তে হবে। বোর্ডে স্ট্যান্ড করার সুবাদে অনেক স্কলারশিপ পেতাম। চলে গেল আমার প্রথম চার বছর স্কলারশিপের টাকাতেই; কিন্তু সেশন জটের কারণে এক বছর বেশি পড়তে হলো।

আব্বার অনেক কষ্ট হতো শেষ বছরে টাকা পাঠাতে। আমি টিউশনি করতে চাইলাম। পরিবারের সবারই প্রতিবাদ—না। লজ্জা পেতাম বাবার কাছ থেকে টাকা নিতে। এখনকার মতো তো তখন মুঠোফোন ছিল না। প্রতি সপ্তাহে আব্বা নিয়মিত চিঠি লিখতেন। দুশ্চিন্তায় থাকতেন আমার স্বাস্থ্য নিয়ে।

অভাবের সংসারে আম্মার মুখটা থাকত সব সময় মলিন। আব্বা আম্মাকে বলতেন তুমি এ পৃথিবীর সবচেয়ে সম্পদশালী। একবার চেয়ে দেখো তোমার ছেলেমেয়েদের দিকে। আদর্শবান, সৎ ও সত্যনিষ্ঠ বাবা মায়ের সন্তানেরা তোমার মুখ উজ্জ্বল করবে। জানি না মা–বাবার প্রত্যাশা আমরা পূরণ করতে পেরেছি কি না! তবে আমার সন্তানদের এবং ছাত্র–ছাত্রীদের সৎ উপদেশ দেওয়ার মতো নৈতিক সাহস আমাদের আছে, যা আমরা আমাদের মা–বাবার কাছ থেকেই পেয়েছি।

অবশেষে এল আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর দিন। প্রায় দিন দশেক আব্বার কোনো চিঠি নেই। আমার চলছিল শেষ বর্ষের  শেষ সেমিস্টারের পরীক্ষা। কোনো দিকে তাকাবার সময় নেই। ১৯৮৬ সালের ১৩ জানুয়ারি। বুয়েটের নজরুল ইসলাম হলের ১১০ নম্বর রুমে হাজির হলেন আমার মেজ মামা। আমি একটু অবাক। কোনো দিন হলে আসেন না। কী ব্যাপার! জিজ্ঞাসা করলেন— আগামীকাল কি কোনো পরীক্ষা আছে?

আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, উনি কাল ট্যুরে রংপুর যাচ্ছেন। তাই এসেছেন আমি যাব কি না? মাথা খারাপ, কাল আমার পরীক্ষা। বললাম, আমার ছোট ভাই মিটুনের সাত দিন বিরতি আছে, নিয়ে যান ওকে। ওনাকে সঙ্গে নিয়ে শহীদ স্মৃতি হলে মিটুনের রুমে পৌঁছে দিয়েই আমি রুমে ফিরে এলাম। হঠাৎ আমার সংবিৎ ফিরে এল। বলা নেই কওয়া নেই মামা কেন আমাদের নিতে এলেন! কী এমন হলো? ও আল্লাহ আব্বার তো চিঠি পাই না কয়েক দিন হলো। নিশ্চয়ই আব্বার কিছু হয়েছে।

ছুটে গেলাম আহসানউল্লাহ হলে বন্ধু মালেকের কাছে। বললাম, নিশ্চয়ই আব্বা আর নেই। ওকে বললাম, মামার বাসায় কল দিতে। হলের কয়েনবক্স থেকে ও কল দিল। টেলিফোনের ওপাশ থেকে কে জানি কী বলল। আমার বন্ধু হাত ধরে হলের দোকানে নিয়ে গিয়ে বললে, মিষ্টি খা। আমার মনে হলো দিই একটা চড়। বললাম বল কী হয়েছে?

 আমাকে জানানো হলো সবচেয়ে নিষ্ঠুর দুঃখজনক সংবাদ। আব্বা আর নেই। সারা দুনিয়া আমার কাছে হয়ে গেলে অন্ধকার। সবচেয়ে নির্ভরতার আশ্রয় হঠাৎ করে নাই হয়ে গেল। আমি মুহূর্তেই হয়ে গেলাম বাক্‌রুদ্ধ। রুমে এসে হাউমাউ করে খানিক কাঁদলাম। তারপর ১০ মিলিগ্রামের দুটি ফ্রিসিয়াম খেয়ে শুয়ে পরলাম। পরের দিন পরীক্ষা।

সকালে উঠে গোসল করে পরীক্ষা দিতে গেলাম এবং বুয়েটের সব সাবজেক্টের ভেতর সব চাইতে বেশি নম্বর পেলাম আমি এটাতে। পরীক্ষার হলে মনে হলো, আব্বা পাশে বসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে সাহস জোগান দিচ্ছেন। এরপর বেশ কয়েক বছর অনেক সকালে আমার ঘুম ভেঙে যেত। মনে হতো, আমার সব চাইতে বড় সম্পদ যেন হারিয়ে গেছে।

শুভ্র শ্মশ্রুমণ্ডিত দরবেশ সাহেব আমাদের বাবা আমাদের মাঝে আর নেই। তাঁর ছাত্ররা তাঁকে দরবেশ সাহেব বলেই ডাকত। তাঁর দাফন–জানাজায় আমি থাকতে পারিনি। এ জন্য তিনি আমার কাছে সব সময় জীবিত। তাঁর কাছে শিখেছি কী করে অল্পতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। আজ আব্বার সন্তানেরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে খ্যাতিমান।

অভাবের সংসারে আম্মার মুখটা থাকত সব সময় মলিন। আব্বা আম্মাকে বলতেন তুমি এ পৃথিবীর সবচেয়ে সম্পদশালী। একবার চেয়ে দেখো তোমার ছেলেমেয়েদের দিকে। আদর্শবান, সৎ ও সত্যনিষ্ঠ বাবা মায়ের সন্তানেরা তোমার মুখ উজ্জ্বল করবে। জানি না মা–বাবার প্রত্যাশা আমরা পূরণ করতে পেরেছি কি না! তবে আমার সন্তানদের এবং ছাত্র–ছাত্রীদের সৎ উপদেশ দেওয়ার মতো নৈতিক সাহস আমাদের আছে, যা আমরা আমাদের মা–বাবার কাছ থেকেই পেয়েছি।

 ড. মো. আশরাফুল হক

 ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির অধ্যাপক