বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা কেন আত্মহত্যা করেন?

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের একজন শিক্ষার্থীর ঝুলন্ত লাশ আবাসিক হল থেকে উদ্ধার করা হয়। ওই শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন কি না, সেটা তদন্তের বিষয়। কিন্তু আত্মহত্যাজনিত মৃত্যু প্রায় নিয়মিতভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ঘটছে। এসব অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর পেছনে যেসব কারণ থাকে, সেগুলো পুরোপুরি জানা সম্ভব হয় না। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত অন্তত ৫৩২ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এর মধ্যে স্কুল-কলেজ পর্যায়ের ৪৪৬ জন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৬ জন শিক্ষার্থী রয়েছেন। এই হিসাবে প্রতি মাসে গড়ে ৪৫ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। নিঃসন্দেহে এসব মৃত্যুর প্রধান কারণ মানসিক চাপ। এই মানসিক চাপ আবার তৈরি হয় বিভিন্ন সামাজিক কারণে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-উপদেষ্টা হয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ আর্থিক চাপে থাকেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁরা এমন সব পরিবার থেকে আসেন, যেসব পরিবারের পক্ষে পড়াশোনার ন্যূনতম খরচ চালানো সম্ভব হয় না। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীর প্রতি মাসে প্রাতিষ্ঠানিক খাতে গড়ে এক হাজার টাকার মতো খরচ হয়। খাওয়াসহ অন্যান্য খরচ মিলিয়ে তাঁদের আরও প্রায় পাঁচ হাজার টাকা লাগে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগেই অনেক দরিদ্র পরিবার সন্তানকে আবাসিক হোস্টেলে রেখে ভর্তি কোচিং করান। ফলে তখনই অন্তত অর্ধলাখ টাকার দেনায় পড়েন। পরবর্তী সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করাতে গিয়ে এই দেনা আরও বাড়তে থাকে। শিক্ষার্থীরা এ ক্ষেত্রে দুই ধরনের চাপে পড়েন—একদিকে বাড়ি থেকে টাকা নিতে পারেন না, অন্যদিকে বাড়িতে টাকা পাঠানোর তাগিদ অনুভব করতে থাকেন।

শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপের আরেকটি কারণ—ভবিষ্যৎ জীবনের অনিশ্চয়তা। যে আশা নিয়ে তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন, বছরখানেকের মধ্যে তাঁদের সেই আশা মরতে শুরু করে। চাকরির বাজারের অবস্থা কোনো কোনো শিক্ষার্থীকে প্রবল হতাশায় নিমজ্জিত করে। প্রেম, বিয়ে, শারীরিক সম্পর্ক—এ ধরনের কারণেও শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানসিক চাপ তৈরি হয়। ঘনিষ্ঠ ছবি, ভিডিও ইত্যাদি ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকির কারণে কিংবা ছড়িয়ে দেওয়ার পর অনেকে আত্মহত্যা করেন। নির্যাতনের শিকার হওয়ার পর নিজের প্রতি ঘৃণাবোধ থেকেও অনেকে আত্মহত্যা করেন। কোনো কোনো মেধাবী শিক্ষার্থী ভালো ফল করার চাপ নিতে না পেরে হতাশায় পড়েন। অনেকে পরীক্ষায় কম নম্বর পেয়ে কিংবা অন্য কোনোভাবে শিক্ষকদের দ্বারা লাঞ্ছিত হয়ে আত্মহত্যা করেন। মাদকে আসক্ত হয়েও কিছু শিক্ষার্থী মানসিক শক্তি হারান এবং কোনো একপর্যায়ে আত্মহত্যার কথা ভাবতে শুরু করেন।

অনেক শিক্ষার্থীর জানাও থাকে না, বিশ্ববিদ্যালয়ে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা আছে। কোনো কোনো শিক্ষার্থী জেনেও কাউন্সেলিং নিতে সংকোচ বোধ করেন। যেসব শিক্ষক এ ধরনের কাউন্সেলিং দিয়ে থাকেন, তাঁরা লক্ষ করেছেন, মানসিক চাপে থাকা শিক্ষার্থীরা তাঁদের পরিবার ও নিকটজনের কাছে নিজেদের সমস্যার কথা গোপন রাখেন। প্রথম দিকে এসব শিক্ষার্থী তাঁদের কোনো সহপাঠী বা প্রিয়জনের কাছে সমস্যার কিছু কিছু হয়তো প্রকাশ করেন, কিন্তু পরে কাউকেই আর কিছু জানান না।

সবচেয়ে বড় কথা, আত্মহত্যার প্রবণতা কমিয়ে আনার জন্য কাউন্সেলিং নেওয়ার সুযোগকে সহজ করতে হবে। কারণ, দক্ষ মনোবিদের সহায়তায় একজন শিক্ষার্থী চাপ-ব্যবস্থাপনার কৌশল শিখতে পারেন। এর পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শরীরচর্চা, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ বাড়াতে হবে। এ ধরনের কাজে এবং বিভিন্ন ধরনের সামাজিক কাজে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করতে হবে। তারপরও কোনো শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করলে তা হবে বেদনাদায়ক।

দীর্ঘদিনের হতাশা ও অবসাদ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যা করেন। আবার, কোনো ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াতেও আত্মহত্যাজনিত মৃত্যু ঘটে। একজন শিক্ষার্থীর মৃত্যু কেবল একটি প্রাণের মৃত্যু নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক একজন শিক্ষার্থী এক একটি পরিবারের স্বপ্ন ও আশার প্রতিনিধিত্ব করে। তাকে ঘিরে একটি পরিবারের স্বপ্ন ও আশা তৈরি হয়। ফলে, কোনো শিক্ষার্থীর মৃত্যু তার পরিবারকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে পঙ্গু করে দেয়।

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আত্মহত্যাজনিত মৃত্যু শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। ভর্তির পরপরই প্রতিটি বিভাগের উদ্যোগে পরিচিতিমূলক ক্লাসের আয়োজন করতে হবে। বর্তমানে ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের উদ্যোগে এবং বিভাগগুলোর ব্যবস্থাপনায় নবীনবরণের আয়োজন করা হয়। কিন্তু এগুলো আনুষ্ঠানিকতায় ভরা। শিক্ষার্থীদের জানানোর মতো দরকারি বিষয় সেখানে কমই উঠে আসে। পরিচিতিমূলক ক্লাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের জানানো যায়। কোন ধরনের সমস্যায় কোথায় এবং কার সঙ্গে কথা বলবে, সেটিও তাঁদের বুঝিয়ে দিতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়-পর্বটি শিক্ষার্থীদের কাছে একটি ক্রান্তিকাল হয়ে দেখা দেয়। স্কুল-কলেজে পড়ার সময় শিক্ষার্থীরা অভিভাবকের নিবিড় তত্ত্বাবধানে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় এই তত্ত্বাবধানের ব্যাপারটি শিথিল হয়ে যায়—তাঁরা হঠাৎ করে যেন অভিভাবকশূন্য হয়ে পড়েন। ফলে তৈরি হওয়া নতুন নতুন সমস্যা নিয়ে কথা বলার জন্য শিক্ষার্থীরা যথাযথ ব্যক্তিকে চিহ্নিত করতে পারেন না। এ ক্ষেত্রে বিভাগের শিক্ষকেরা আরও বেশি দায়িত্ব নিয়ে তাঁদের অভিভাবক হয়ে উঠতে পারেন।

তা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা স্কুল-কলেজের মতো নয়। এখানে তাঁরা পড়াশোনা ও ফলাফল নিয়ে সংকট বোধ করেন। কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেওয়া হয়, কীভাবে খাতা মূল্যায়ন করা হয়—এগুলো শুরুতেই জানার অধিকার শিক্ষার্থীদের আছে। এমনকি তাঁদের এটাও বোঝানো দরকার, তাঁদের প্রতি শিক্ষকেরাও যদি কোনো অসংগত ও অনৈতিক আচরণ করেন, তবে তার জন্য শিক্ষকদের শাস্তির ব্যবস্থা আছে।

শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত দক্ষতা ও পারিবারিক অবস্থার তথ্যও বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেটাবেজে সংরক্ষণ করা যেতে পারে। এর ফলে বৃত্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে উপযুক্ত প্রার্থী বাছাই করার কাজটি সহজ হবে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রত্যেক দরিদ্র শিক্ষার্থীর জন্য সুদমুক্ত ঋণ নেওয়ার সুযোগ করে দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে শর্ত থাকবে, চাকরি পাওয়ার পর এই ঋণ তাঁকে শোধ করতে হবে। তা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে খণ্ডকালীন কাজের সুযোগও বাড়াতে হবে।

সবচেয়ে বড় কথা, আত্মহত্যার প্রবণতা কমিয়ে আনার জন্য কাউন্সেলিং নেওয়ার সুযোগকে সহজ করতে হবে। কারণ, দক্ষ মনোবিদের সহায়তায় একজন শিক্ষার্থী চাপ-ব্যবস্থাপনার কৌশল শিখতে পারেন। এর পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শরীরচর্চা, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ বাড়াতে হবে। এ ধরনের কাজে এবং বিভিন্ন ধরনের সামাজিক কাজে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করতে হবে। তারপরও কোনো শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করলে তা হবে বেদনাদায়ক।

তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক