তেহরানে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ও ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির বৈঠক
তেহরানে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ও ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির বৈঠক

খাদে পড়া রাশিয়াকে কতটা টেনে তুলবে ইরান

গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান অভিযোগ করেন, ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য ইরান থেকে শত শত ক্ষেপণাস্ত্র কেনার চেষ্টা করছে রাশিয়া। তাঁর এ দাবি বিশ্বাসযোগ্য মনে হতে পারে। কেননা, রাশিয়ার সেনাবাহিনীর হাতে নিজেদের তৈরি ড্রোন থাকলেও সেগুলো পশ্চিমাদের অগ্রসর প্রযুক্তির ড্রোন থেকে অনেক পিছিয়ে। ফলে রাশিয়া আকাশযুদ্ধে ইউক্রেনের সঙ্গে পেরে উঠছে না। এ যুক্তিতে মস্কো বিদেশ থেকে ড্রোন কিনতে চাইছে, এমন দাবির ভিত্তি আছে। তবে এতে একমাত্র সমস্যা হচ্ছে রাশিয়ার ডাকে সাড়া দেবে এমন ‘প্রণোদনা’ ইরানের কাছে খুব অল্পই আছে।

ইরানের সঙ্গে রাশিয়ার যে মৈত্রীর সম্পর্ক, সেটাকে পশ্চিমা শক্তি, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নিজেদের উদ্দেশ্য সাধনে ব্যবহার করার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে মস্কোর। ইউক্রেনে রাশিয়ার চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধের ফলে দাবার চাল পাল্টে দেওয়ার সুযোগ এসেছে তেহরানের সামনেও। সুলিভানের বিবৃতির প্রতিক্রিয়ায় ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আবদুল্লাহিয়ান বলেছেন, ‘ইরান যদিও রাশিয়ার সঙ্গে নানা ক্ষেত্রে সহযোগিতার সম্পর্ক বজায় রেখেছে, এর মধ্যে প্রতিরক্ষাও রয়েছে। ...কিন্তু আমরা ইউক্রেন সংঘাতে যুক্ত কোনো পক্ষকেই সহযোগিতা করব না।’ তিনি আরও বলেন, ‘সংঘাতে তীব্রতা বাড়তে পারে, এমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করছি আমরা।’

ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ বক্তব্য জোরালো কোনো অস্বীকৃতি নয়। এরপরও রাশিয়া যদি ইরানের কাছে ড্রোন সহযোগিতা চায় সেটি প্রত্যাখ্যান করার কারণ আছে তেহরানের। ২০১৯ সালে ইরান রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেনার প্রস্তাব দিয়েছিল। সে সময় ক্রেমলিন আজ তেহরান যে বক্তব্য দিচ্ছে, ঠিক সেই বক্তব্যই দিয়েছিল। এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বিক্রি করলে ‘মধ্যেপ্রাচ্যে আরও বেশি উত্তেজনা বাড়বে’, এমন যুক্তি দেখিয়েছিল মস্কো।

এখন ইরান ভয় পাচ্ছে, ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যবহার করা হবে এমন কোনো সামরিক সহায়তা মস্কোকে দিতে গেলে পশ্চিমাদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আরও তিক্ত হবে। সে কারণেই ‘একঘরে’ একটি রাষ্ট্রের সঙ্গে ড্রোন বাণিজ্যে যেতে চায় না তেহরান।

আবার কিছু বিশেষজ্ঞের মত, সুলিভানের এই বক্তব্যের পেছনে ভিন্ন উদ্দেশ্যও রয়েছে। সেটা হলো, যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যের আরেক শক্তি সৌদি আরবকে এই বার্তা দিতে চায় যে ওয়াশিংটন ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক সহজ করতে কিংবা নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে মোটেই আগ্রহী নয়। যাতে ওয়াশিংটনের এখনকার চাওয়া অনুসারে সৌদি আরব এবং উপসাগরীয় দেশগুলো তেল উৎপাদন বাড়ায়। সম্ভবত, সৌদি আরবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট সম্প্রতি যে সফর করে গেলেন, সেখানে এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।

২০০৭ সালে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ইরানের কাছে প্রথাগত অস্ত্র বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা হয়েছিল। ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে এ নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। কিন্তু ইরানের দিক থেকে তীব্র চাওয়া সত্ত্বেও ক্রেমলিন এখন পর্যন্ত তেহরানের কাছে এসইউ-৩৫ যুদ্ধবিমান, ইয়াক-১৩০ প্রশিক্ষণ বিমান, টি-৯০ ট্যাংকস, ভূমি থেকে আকাশ পর্যন্ত অগ্রসর প্রযুক্তির এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এবং উপকূলীয় ভ্রাম্যমাণ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা কে-৩০০পি ব্যাসন-পি বিক্রি করেনি।

অন্যদিকে ইরান সম্ভবত পশ্চিমের সঙ্গে দর–কষাকষির অস্ত্র হিসেবে রাশিয়াকে ব্যবহার করার চেষ্টা চালাতে পারে। মস্কোর প্রাথমিক প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ার বিনিময়ে তেহরান পশ্চিমের কাছে তাদের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার দাবি করতে পারে। তেহরানে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ও ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির বৈঠক হয়েছে। ইরানের পরিষ্কার মনোভাব শিগগিরই জানা যাবে।

এর আগে, ২০১৯ সালের মে মাসে ভ্লাদিমির পুতিন বলেছিলেন, রাশিয়া ফায়ার ব্রিগেড নয়...মস্কো সবাইকে সবকিছু থেকে উদ্ধার করতে পারবে না। ক্রেমলিন কেন ইরানকে পারমাণবিক চুক্তি থেকে উদ্ধার করতে পারবে না, সে প্রসঙ্গে এ উদাহরণ দিয়েছিলেন পুতিন। তাহলে কেন এখন ইউক্রেনে খাদে পড়া মস্কোকে উদ্ধারে ‘ফায়ার ব্রিগেড’–এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে ইরান?

২০০৬ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘে ইরানের বিরুদ্ধে ছয়টি প্রস্তাব পাস হয়েছিল। সে সময় রাশিয়া ইরানের বিরুদ্ধে ভোট দিতে কোনো সংকোচ করেনি। সিরিয়ায় ইরানের সেনারা কিংবা তাদের সমর্থনপুষ্ট সেনারা যখন ইসরায়েলের বিমান হামলার শিকার হয়, তখন তাদের কেন রক্ষা করতে এগিয়ে আসে না, এটিও তেহরানের কাছে একটা বড় বিবেচ্য বিষয়।

২০০৭ সালে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ইরানের কাছে প্রথাগত অস্ত্র বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা হয়েছিল। ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে এ নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। কিন্তু ইরানের দিক থেকে তীব্র চাওয়া সত্ত্বেও ক্রেমলিন এখন পর্যন্ত তেহরানের কাছে এসইউ-৩৫ যুদ্ধবিমান, ইয়াক-১৩০ প্রশিক্ষণ বিমান, টি-৯০ ট্যাংকস, ভূমি থেকে আকাশ পর্যন্ত অগ্রসর প্রযুক্তির এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এবং উপকূলীয় ভ্রাম্যমাণ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা কে-৩০০পি ব্যাসন-পি বিক্রি করেনি।

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরু করে। এর কয়েক দিন আগেই, ইরান মস্কোকে এক হাজার কোটি ডলারের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি করার জন্য তাগিদ দিয়েছিল। রাশিয়ার প্রাধান্যে থাকা ইউরেশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়নে যুক্ত হতেও চেয়েছিল ইরান, যাতে করে ক্রেমলিনের সঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক বন্ধন শক্তিশালী করা যায়।

ইরানের এসব স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আগ্রহ দেখায়নি রাশিয়া। সুতরাং, বিশ্বদরবারে মস্কোর অবস্থানের যখন উল্লেখযোগ্য অবনমন হয়েছে, সে সময় তেহরান রাশিয়াকে বড় কোনো সহযোগিতা করতে ছুটবে, এমনটা ভাবা ঠিক হবে না। তবে তার মানে এই নয় যে ইরান ও রাশিয়া দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট অনেক বিষয়ে পরস্পরকে সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে না। গত মে মাসে রাশিয়ার উপপ্রধানমন্ত্রী আলেকজান্ডার নোভাক তেহরান সফরে এসেছিলেন। সে সময় দুই দেশের জাতীয় লেনদেনব্যবস্থাকে একই সংযোগে (যাতে করে ব্যাংকিং লেনদেন সহজ হয়) নিয়ে আসার ব্যাপারে আলোচনা হয়। এরপর জুন মাসের প্রথম দিকে ফোনে পুতিন ও রাইসি ইরান পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে আলোচনা করেন। জুন মাসের শেষ ভাগে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ তেহরান সফরে আসেন এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিষয়ে আলোচনা করেন।

সম্প্রতি রাশিয়া ও ইরান তাদের নামমাত্র সম্পর্কটির খানিকটা উন্নয়ন শুরু করেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যেমনটা দাবি করা হয়েছে, রাশিয়া–ইরানের সম্পর্কটা কোনোভাবেই সে পর্যায়ে পৌঁছায়নি।

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে

নিকোলাই মিকোভিচ রাশিয়া, বেলারুশ ও ইউক্রেনের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে সার্বীয় বিশ্লেষক