গাজা ও অ্যাসাঞ্জের ভাগ্য যেভাবে একসুতায় বাঁধা

দিন কয়েক আগে ব্রিটেন ও নেদারল্যান্ডসের দুটি আদালতে আমাদের এই সময়ের মৌলিক স্বাধীনতার জন্য বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বেশি হুমকি সৃষ্টিকারী দুটি আইনি মামলার শুনানি আলাদাভাবে শুরু হয়েছে। কিন্তু বিবিসির মতো পশ্চিমের মূলধারার সংবাদমাধ্যমে এ নিয়ে তেমন কোনো সাড়াশব্দ নেই।

এর মধ্যে একটি হলো উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে লন্ডন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দেওয়া (যার মাধ্যমে তাঁকে আমৃত্যু আটকে রাখা যাবে) ঠেকানোর সর্বশেষ চেষ্টায় করা মামলা।

বাইডেন প্রশাসনের মতে, অ্যাসাঞ্জের অপরাধ হলো তিনি এমন কিছু নথি ফাঁস করে দিয়েছেন, যাতে প্রতীয়মান হয়, ইরাক ও আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য পদ্ধতিগত যুদ্ধাপরাধ করেছে। সম্ভবত যুক্তরাজ্য সরকার তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দিতে রাজি হয়েছে।

অন্য মামলাটির শুনানি চলছে হেগের আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে)। আইসিজের বিচারকেরা গাজায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েল গণহত্যা চালাচ্ছে বলে মেনে নেওয়ার কয়েক সপ্তাহ পর ইসরায়েল একটি পৃথক ইস্যুতে কাঠগড়ায় ফিরে এসেছে।

ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইসরায়েলের স্থায়ী দখলদারি এবং ঔপনিবেশিকতাকে বর্ণবাদের শাসন প্রতিষ্ঠা করার সমতুল্য বলা যায় কি না, সে বিষয়ে বিচারকদের মতামত দিতে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।

অন্যদিকে গণহত্যার সমতুল্য প্রাণহানি বন্ধে ইসরায়েল আদালতের আগের আদেশ মেনে কী পদক্ষেপ নিয়েছে, সেই প্রতিবেদন ইসরায়েলকেও আদালতে পেশ করতে হবে।

যদিও অ্যাসাঞ্জ এবং ইসরায়েলের মামলার ক্ষেত্রে খুব কম মিল রয়েছে বলে মনে হতে পারে, কিন্তু বাস্তবে দুটি মামলা ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। দুটি মামলাই পশ্চিমের তথাকথিত ‘নিয়মভিত্তিক ব্যবস্থাকে’ ফাঁকা বুলি হিসেবে উন্মোচিত করছে। এই দুটি মামলার একটি বড় মিল হলো মামলা দুটির সংবাদ-গুরুত্ব অনেক বেশি থাকার পরও এ–সংক্রান্ত খবর অতি সীমিত পরিসরে প্রকাশ করা হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক আদালতে ইসরায়েলের জয় হলে সেটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও হলোকাস্টের পর লিখিত আইনি কাঠামোকে কার্যত ছিঁড়ে ফেলে দেবে এবং দুর্বল ও অরক্ষিতরা যে আন্তর্জাতিক মানবিক আইনকে নিজেদের রক্ষাকবচ বলে মনে করে থাকে, তা তাদের কাছ থেকে হারিয়ে যাবে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো এই দুটি ঘটনাকে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম পাশ কাটিয়ে গেলেও রাশিয়ার পুতিনবিরোধী নেতা আলেক্সি নাভালনির কারারুদ্ধ অবস্থায় মৃত্যুর ঘটনাকে বেশ ফলাও করে প্রচার করেছে।

অ্যাসাঞ্জের মামলার প্রথম দিনের শুনানির খবর বিবিসির প্রধান সান্ধ্য আয়োজনে মাত্র কয়েক সেকেন্ডে শেষ করা হয়েছে। এই মামলার রায় যদি যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে যায়, তাহলে তার মানে দাঁড়াবে, এরপর কোনো প্রকাশক যদি যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় কোনো অপরাধের খবর প্রকাশ করেন, তাহলে তাঁকে আটক করা হবে এবং আইনি প্রক্রিয়ায় তাঁকে ‘নাই’ করে দেওয়া হবে।

অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে গুপ্তচরবৃত্তির কাতারে ফেলে দেওয়ার উদ্দেশ্য হলো সমালোচনামূলক প্রতিবেদন ও বাক্‌স্বাধীনতার টুঁটি চেপে ধরা।

তবে সত্যিকার অর্থে বছরের পর বছর ধরে অ্যাসাঞ্জের ওপর ব্রিটিশ ও মার্কিন কর্তৃপক্ষের করা দুর্ব্যবহারের বিষয়ে প্রায় চুপ হয়ে থাকা অতি বিনীত প্রতিষ্ঠিত সংবাদমাধ্যম এ নিয়ে তেমন কোনো হুমকি বোধ করবে না।

একইভাবে হেগের আদালত যদি ইসরায়েলের পক্ষে রায় দেন, তাহলে ফিলিস্তিনিদের ভূমি চুরি করা এবং সেখানে উপনিবেশ গড়ায় ইসরায়েল আরও বেপরোয়া হবে। ফিলিস্তিনিদের ওপর তারা নিপীড়ন ও জাতিগত নির্মূল অভিযান আরও তীব্র করবে। এতে চলমান আঞ্চলিক অস্থিরতা বৃহত্তর যুদ্ধে মোড় নিতে পারে।

আন্তর্জাতিক আদালতে ইসরায়েলের জয় হলে সেটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও হলোকাস্টের পর লিখিত আইনি কাঠামোকে কার্যত ছিঁড়ে ফেলে দেবে এবং দুর্বল ও অরক্ষিতরা যে আন্তর্জাতিক মানবিক আইনকে নিজেদের রক্ষাকবচ বলে মনে করে থাকে, তা তাদের কাছ থেকে হারিয়ে যাবে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো এই দুটি ঘটনাকে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম পাশ কাটিয়ে গেলেও রাশিয়ার পুতিনবিরোধী নেতা আলেক্সি নাভালনির কারারুদ্ধ অবস্থায় মৃত্যুর ঘটনাকে বেশ ফলাও করে প্রচার করেছে।

নাভালনির মৃত্যুর ইস্যুতে গণতন্ত্র ও বাক্‌স্বাধীনতার পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ব্যক্ত করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সপ্তাহখানেক আগে মস্কোর বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপ করেছে। ঠিক সেই একই সময়ে সেই একই বাইডেন প্রশাসন সেই একই ধরনের ভিন্ন মতাবলম্বনের জন্য অস্ট্রেলীয় সাংবাদিক জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে চিরতরে কারারুদ্ধ রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

অ্যাসাঞ্জ ইস্যুতে সংবাদমাধ্যম যে ভূমিকা নিয়েছে, তাকে ভণ্ডামি ছাড়া কিছু বলা যায় না। ঠিক একইভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযান নিয়ে যতটা সোচ্চার, গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যা নিয়ে ততটাই নীরব ভূমিকা পালন করছে।

অ্যাসাঞ্জ যদি মুক্ত হতেন, তাহলে সারা বিশ্বের বাক্‌স্বাধীনতার অধিকারকর্মীরা সাহস পেতেন; তাহলে শোষক গোষ্ঠী জবাবদিহির আওতায় থাকত এবং গাজার লাখ লাখ মানুষকে বোমায় এবং কৃত্রিম দুর্ভিক্ষে মরতে হতো না।

● জনাথন কুক ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও লেখক

মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত