জুলাই-আগস্টে দেশে যা ঘটে গেল, তা এখনো স্বপ্নের মতোই। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে দ্বিধাহীন গণ-অংশগ্রহণ ও আত্মত্যাগ, পরিবর্তনের অবিচল অঙ্গীকার ও প্রবল আশাবাদ ছাড়া ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন সম্ভব ছিল না।
১৫ বছর ধরে জনগণের বুকের ওপর চড়ে থাকা শেখ হাসিনা নামক স্বৈরাচারের জগদ্দল পাথর এত শিগগির নেমে যাবে, তা আগের দিনও ভাবতে পারেননি অনেকেই।
তরুণদের নেতৃত্বে সফল হওয়া এই শতাব্দীর বিপ্লব-পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ধারণ করার জুতসই সময়ও পাওয়া যায়নি ।
হঠাৎ দায়িত্ব পাওয়া প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন উপদেষ্টা পরিষদের প্রাথমিক কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রশাসন ও সামাজিক আগুন নেভানো বা ‘ফায়ারফাইটিং’।
যেহেতু তাঁরা বিপ্লবী বা রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে আসেননি এবং একটি দল হিসেবেও কাজ করেননি, সেহেতু একটি দীর্ঘ দুঃশাসনে বিধ্বস্ত এবং বিপ্লবে অবিন্যস্ত রাষ্ট্রযন্ত্রকে ঠিক পথে আনতে একটু বেগ পেতে হচ্ছে। অর্থনীতি ও অন্যান্য খাতের চ্যালেঞ্জ তো আগে থেকেই রয়ে গেছে।
ছাত্রদের কোটাবিরোধী ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন সরকারের ফ্যাসিবাদী আচরণ ও গণহত্যার বিপরীতে দাঁড়িয়ে যাওয়ার পর একসময় তা গণবিস্ফোরণে পরিণত হয় এবং বিএনপিসহ প্রকৃত বিরোধী দলগুলো তিন সপ্তাহের চূড়ান্ত সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে।
তারুণ্য এবং রাজনৈতিক মতাদর্শের শক্তিকে ক্ষুদ্র জ্ঞান করায় শেখ হাসিনা ও তাঁর দেশি–বিদেশি পরামর্শকেরা এই আন্দোলন যে বিপ্লবে রূপ নিচ্ছে, তা বুঝে উঠতে ব্যর্থ হন। তাঁদের চোখে বিপ্লবী দল, অংশীজনের সাধারণ এজেন্ডা কিংবা সংক্ষুব্ধ মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা কিছুই ধরা পড়েনি।
আবু সাঈদের জীবন দিয়ে লেখা এক মুহূর্তের কবিতা, শহীদ কিশোর ফারহান ও তার মায়ের ঘাড় হেলানো মুখচ্ছবি, পানি লাগবে বলে মুগ্ধর মুগ্ধতা অকাতরে বিলিয়ে দেওয়া, সৈকতের দুই বোনের ভাই হারানোর হৃদয় যন্ত্রণা দিয়ে লেখা পোস্ট এবং আরও সহস্র মানবিক গল্প বিপ্লবের উপাখ্যান তৈরি করে দেয়।
কিন্তু বিপ্লবের সম্মিলিত রূপকল্প এবং কোটি কোটি ব্যক্তি মানুষের ঐকতানের স্বপ্ন এখনো অলিখিত এবং কিছুটা অনুচ্চারিত।
আমেরিকার আদলে বললে, আজকের নতুন আঙ্গিকে ‘বাংলাদেশের স্বপ্ন’টা কী জিনিস?
ধরে নিচ্ছি আমাদের সন্তানদের জন্য মুক্ত, সুস্থ পরিবেশে জীবন গঠনের সুযোগ ও স্বাধীনতা অধিকাংশ মানুষের আগামী বাংলাদেশের স্বপ্ন।
তাহলে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের কাঠামো তৈরি করে দেবে কোন রাষ্ট্র? নিশ্চয়ই বহুত্ববাদী গণতান্ত্রিক, কল্যাণমুখী, ন্যায়বিচারভিত্তিক, স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ইত্যাদি বিশেষণ সমৃদ্ধ রাষ্ট্র।
সেই স্বপ্ন এবং তা অর্জনের উপায় নিয়ে যেমন একটি প্রতিনিধিত্বমূলক দলিল লাগবে, তেমনি দরকার হবে বিপ্লবের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ এবং রাজনৈতিক মালিকানা ঠিক করা।
সোজা কথা হচ্ছে, এই বিপ্লবকে রাজনৈতিক দলের ইশতেহারে সংযুক্ত করে ভবিষ্যতেও জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
তারই অংশ হিসেবে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে বিপ্লবকে সংজ্ঞায়িত এবং এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে ধারণ করার চেষ্টা করা এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার কার্যক্রম হাতে নেওয়া।
এখানে নিরপেক্ষতার সুযোগ নেই। কারণ ফ্যাসিজমের প্রতি সদয় হতে জীবন বাজি রেখে ছাত্র–জনতা আন্দোলন করেনি। যদিও অন্তর্বর্তী প্রশাসন হচ্ছে বিপ্লবের ফলে এবং এর চেতনা বাস্তবায়নের প্রাথমিক কাজ সম্পন্ন করার উদ্দেশ্য অবিপ্লবী সরকার গঠন।
তবে নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী বিশ্বব্যাপী নন্দিত ইউনূস সাহেবের নেতৃত্বের প্রতি যে জনগণের আস্থা রয়েছে, তা বোঝা যায় শুধু পতিত আওয়ামী লীগ সুবিধাভোগীরা বাদে নানা গোষ্ঠীর প্রতিক্রিয়ায়।
বাংলাদেশের নতুন স্বপ্নযাত্রায় প্রথম নেতা তিনি।
এখন এই বিপ্লবকে পরবর্তী ধাপে নিতে এবং এর ফসল সর্বসাধারণের ঘরে তুলতে সৃজনশীল পদক্ষেপ অপরিহার্য।
বিপ্লবোত্তর বাংলাদেশে জাতীয় সমঝোতা ও ঐকমত্য জোরদার এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর জনগণের অন্যতম প্রত্যাশা।
বিপ্লবের একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্রতিবিপ্লবীদের ষড়যন্ত্র ও প্রচেষ্টায় বিপ্লব ব্যর্থ হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। যে দলটি একসময় দেশের এক-তৃতীয়াংশ ভোটারের সমর্থন পেত এবং ক্ষমতায় থেকে সব রকম অন্যায় লাভ পকেটে ভরেছে, তার এজেন্টদের অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতার সামর্থ্য কম নয়।
তাই আন্দোলনে মানুষের ত্যাগের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা রেখে নতুন প্রজন্মের জন্য তাদের ভবিষ্যৎ উপযোগী বাংলাদেশ গড়া সহজসাধ্য ব্যাপার হবে না।
সে জন্য দূরদর্শী নেতৃত্বের পাশাপাশি প্রয়োজন পরিণত প্রজন্মের ত্যাগ স্বীকার। বিপ্লবের প্রহরীদের আরও কিছু কাল জেগে থাকার দরকার হবে। রাস্তায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এবং নয়া বয়ান তৈরির প্রক্রিয়ায় তাদের সরব থাকতে হবে।
বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বাংলাদেশিদের স্বপ্ন রচনা ও তার সুষ্ঠু রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি তৈরি করা জনগণের পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব।
রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব হবে বিপ্লবের চেতনার ভিত্তিতে রচিত ইশতেহার এবং পুনর্গঠিত নেতৃত্বের প্যানেল নিয়ে জনগণের সামনে হাজির হওয়া এবং ম্যান্ডেট পেলে গণ–আস্থার প্রতিদান দেওয়া।
আমাদের অনুধাবন করা দরকার যে বিপ্লব ফি বছর বা প্রতি দশকে সংঘটিত হয় না। একে কাজে লাগাতে হয় দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে, প্রজন্মের পর প্রজন্মের মুক্তির সমাজ নির্মাণে।
খাজা মাঈন উদ্দিন, সাংবাদিক