মতামত

‘অবাজি রাজনীতির খেলা বুঝন বউত হস্ট’

১৭ ডিসেম্বর, বেলা তিনটা। পটিয়ার মুন্সেফ বাজারে বাজার করতে এসেছিলেন সুচক্রদণ্ডী গ্রামের মুন্সী মিয়া। আসন্ন নির্বাচন নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি চোখেমুখে বিরক্তির ভাব দেখিয়ে বললেন, ‘নারে ভাই, আঁ-ই কিছু হইত ফাইত্তাম নঅ। অবাজি রাজনীতির খেলা বুঝন বউত হস্ট।’ (আমি কিছু বলতে পারব না। দেখো বাবা, রাজনীতির খেলা বোঝা বড় কষ্ট।)

নির্বাচন নিয়ে পটিয়ায় যাঁদের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছি, তাঁরা কৌশলে এড়িয়ে গেছেন। মুন্সী মিয়া পঞ্চাশোর্ধ্ব। দেখে মনে হলো, তাঁর কাছে হয়তো জবাব পাব। কিন্তু তিনিও কিছু বলতে অস্বীকার করলেন। আমি তাঁকে চট্টগ্রামের ভাষাতেই বললাম, ‘আপনি এত কঠিন করে কেন দেখছেন? আমি শুধু ৭ জানুয়ারির নির্বাচন সম্পর্কে কিছু ভাবছেন কি না, জানতে চাইছি।’

এবার মুন্সী মিয়া আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে মুখ থেকে পানের পিকটা ফেলে কিছুটা রাগত স্বরে বললেন, ‘ওবা ইয়ান হন হথা অইল না? ইতারা ইতারা ফেডর ভাই। ইতারা ইতারা খেলা হার। এক্কই ফার্টি, এক্কই দল, এক্কই আসন। আরা জীবন এক ওঁয়ারে রাজনীতি গইজ্জি। এক ওঁয়ারে বক্তৃতা দিইয়ি। এহন দেখিদ্দি তারা তারা ফাডাফাডি চলের। এতাল্লাই হইদ্দি আঁই নবুঝি।’ (এটা কোনো কথা হলো? তারা তারা ভাই। তারা নিজেরা নিজেরা খেলছে। একই পার্টি, একই দল, একই আসন। সারা জীবন একসঙ্গে রাজনীতি করেছেন, একসঙ্গে বক্তৃতা দিয়েছেন। এখন দেখছি, তাদের মধ্যে লড়াই। এ জন্যই বলছি, আমি বুঝি না)।

মুন্সী মিয়া কথাগুলো কেন বলছেন, সেটা পটিয়াবাসীর কাছে স্পষ্ট। দ্বাদশ সংসদীয় নির্বাচনে চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী এবং বর্তমান সংসদ সদস্য হুইপ স্বতন্ত্র প্রার্থী ঈগল প্রতীকের সামশুল হক চৌধুরীকে গত পাঁচ বছরে প্রায় সময় জনসমক্ষে একসঙ্গেই দেখা যেত। যেকোনো দিবসে, যেকোনো উদ্‌যাপনে তাঁরা একই মঞ্চে ছিলেন। তাঁরা একই আদর্শের। কিন্তু নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। মুন্সী মিয়ার কথায় সে জন্যই বিস্ময় ফুটে ওঠে। শুধু পটিয়া নয়, মুন্সী মিয়ার কথায় আসন্ন নির্বাচন সামনে রেখে চট্টগ্রামের পুরো পরিস্থিতিটা ফুটে উঠেছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন মানে, আওয়ামী লীগের নিজেদের মধ্যে নিজেদের লড়াই।

চট্টগ্রাম-১ (মীরসরাই) আসনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী মাহবুব উর রহমানের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন আরেক উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের নেতা মিরসরাই উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান ঈগল প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দীন। চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী খাদিজাতুল আনোয়ার সনির বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী তরমুজ প্রতীক নিয়ে লড়ছেন ফটিকছড়ির সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান হোসাইন মো. আবু তৈয়ব। তিনিও আওয়ামী লীগের। এখানে আরেকজন স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ শাহজাহান লড়ছেন ঈগল প্রতীক নিয়ে। চট্টগ্রাম-৩ (সন্দ্বীপ) আসনেও ৮ জন প্রার্থী।

তবে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মাহফুজুর রহমানের সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থী স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) নেতা ঈগল প্রতীকের মো. জামাল উদ্দিন চৌধুরীর মধ্যেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলবে বলে স্থানীয় ব্যক্তিরা অনুমান করছেন।

চট্টগ্রাম-৮ (চান্দগাঁও-বোয়ালখালী) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী মহানগর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ ও সিডিএর সাবেক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম কেটলি প্রতীক নিয়ে লড়ছেন। অবশ্য এই আসনে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের প্রার্থী নোমান আল মাহমুদ আসন ভাগাভাগির কারণে জাতীয় পার্টির সোলাইমান আলম শেঠের সমর্থনে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।

চট্টগ্রাম-১০ (ডবলমুরিং) আসনে ফুলকপি প্রতীকে লড়ছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক মেয়র মনজুর আলম। এখানে বর্তমান সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের মহিউদ্দিন বাচ্চুর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী ফরিদ মাহমুদ। তিনিও আওয়ামী লীগের। চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর-পতেঙ্গা) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী কেটলি প্রতীকের জিয়াউল হক সুমন আওয়ামী প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য এম এ লতিফের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া) আসনে ঈগল প্রতীক নিয়ে লড়ছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান এম এ মোতালেব। এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী রয়েছেন আবু রেজা মোহাম্মদ নেজামউদ্দিন নদভী। চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ঈগল প্রতীকের মুজিবুর রহমানের, ট্রাক প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুল্লাহ কবির লিটন এবং বেঞ্চ প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. খালেকুজ্জামান।

দলীয় প্রার্থীর মধ্যে বিরুদ্ধে ভোটে দাঁড়াতে আওয়ামী লীগ এবার নিরুৎসাহিত করছে না। নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রতি দলের এই নমনীয় ভাব শেষ পর্যন্ত দলের মধ্যে স্থায়ী বিরোধ সৃষ্টি করতে পারে। পটিয়া আসনের দুই প্রার্থীর সখ্য যে রকম এখন বিরোধপূর্ণ অবস্থায় দাঁড়িয়েছে, অন্যান্য আসনেও তা-ই হয়েছে। ভোট-পরবর্তী সময়েও তার প্রভাব থাকবে বলে অনেকেই অনুমান করছেন।

পটিয়ার একজন ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ভোটের লড়াই তো হয় আদর্শের লড়াই। একেকটা দলের আদর্শ একেক রকম। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে তারা দেশ চালাবে তাদের আদর্শের ভিত্তিতে। সেই আদর্শ অন্য দলের পছন্দ হবে না।

কারণ, তারা অন্য আদর্শে বিশ্বাসী। তারা দেশ চালাতে চাইবে তাদের আদর্শে। তাই তারা ভোটে দাঁড়ায় নিজেরা। ভোটে সেই আদর্শের লড়াই হবে না। এখানে একই আদর্শের লোক প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। একই আদর্শ তাতে কী? ক্ষমতায় তো থাকতে হবে আমাকেই। এই আত্মকেন্দ্রিক নির্বাচন দলকে ভবিষ্যতে খণ্ডিত করবে, গণতন্ত্রকেও খর্ব করবে।’

  • ওমর কায়সার প্রথম আলোর চট্টগ্রাম অফিসের বার্তা সম্পাদক