রাশিয়া–ইউক্রেন শস্যচুক্তি ভেস্তে যাওয়ায় এখন কী হবে

রাশিয়া–ইউক্রেন থেকে খাদ্যশস্য ও সারের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হলে সেটি বৈশ্বিক ক্ষুধা ও খাদ্যের বাজারে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
ছবি : রয়টার্স

গত সোমবার রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ ঘোষণা দেন, ‘কৃষ্ণসাগর শস্যচুক্তি আর কার্যকর নেই।’ গত বছরের ২২ জুলাই ইস্তাম্বুলে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের উপস্থিতিতে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে শস্যচুক্তিটি সম্পাদিত হয়েছিল। 

গুতেরেস সে সময় বলেছিলেন, দুটি কারণে এই উদ্যোগ ‘আশার বাতিঘর’। প্রথমত, যুদ্ধরত দুটি পক্ষ চুক্তিতে পৌঁছেছে, এটা তাৎপর্যপূর্ণ। দ্বিতীয়ত, রাশিয়া ও ইউক্রেন গম, বার্লি, ভুট্টা, রাই শর্ষে ও রাই শর্ষের তেল, সূর্যমুখী ফুল ও সূর্যমুখী ফুলের তেলের প্রধান দুটি উৎপাদক দেশ। এ ছাড়া নাইট্রোজেন, পটাশিয়াম ও ফসফরাস সারেরও প্রধান উৎপাদক তারা।

রাশিয়া–ইউক্রেন থেকে খাদ্যশস্য ও সারের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হলে সেটি বৈশ্বিক ক্ষুধা ও খাদ্যের বাজারে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞার পরিধি বৃদ্ধি পাওয়ায় শস্যচুক্তিটি এমনিতেই ভঙ্গুর হতে শুরু করেছিল।

গত বছরে কয়েকবার চুক্তিটি স্থগিত হয়েছিল। এ বছরের মার্চ মাসে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা রাশিয়ার কৃষির ওপর দেওয়া নিষেধাজ্ঞার প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, শস্যচুক্তির মূল মাপকাঠিটাই এখন আর কার্যকর রইল না।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেছেন, রাশিয়া অব্যাহতভাবে খাদ্যকে অস্ত্রে পরিণত করছে এবং তাতে বিশ্বের নাজুক অবস্থায় থাকা কোটি কোটি মানুষের ক্ষতি হচ্ছে। এটা আমাদের জন্য অনেক পরিতাপের বিষয়। কিন্তু শস্যচুক্তি স্থগিত হওয়ায় বৈশ্বিক ক্ষুধার ক্ষেত্রে কতটা প্রভাব ফেলবে?

পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার পাল্টা হিসেবে রাশিয়া তাদের সার ও কৃষিপণ্য রপ্তানির ওপর বিধিনিষেধ দিয়েছে। নির্দিষ্ট কিছু পণ্য রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা, লাইসেন্সের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ এবং রপ্তানি কর বাড়ানোর মতো পদক্ষেপ নিয়েছে রাশিয়া। পাশাপাশি রাশিয়া তাদের কৃষিপণ্য ভারতের মতো দেশে সরাসরি বিক্রি করতে চলেছে।

‘২০২৩ সালে বিশ্বের খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টি পরিস্থিতি’ নিয়ে জাতিসংঘের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বে প্রতি ১০ জনে ১ জন ক্ষুধায় ধুঁকছে এবং ৩১০ কোটি মানুষ স্বাস্থ্যকর খাবার পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত। এই প্রতিবেদনে খুব কৌতূহলোদ্দীপক একটি বিষয় রয়েছে। জানা যাচ্ছে, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বে ২ কোটি ৩০ লাখ মানুষকে ক্ষুধার সঙ্গে লড়াই করতে হচ্ছে। কোভিড মহামারি ও খাদ্যের বাণিজ্যিকীকরণের কারণে যত মানুষ ক্ষুধার্ত, তার তুলনায় এ সংখ্যা নিতান্তই কম।

কৃষ্ণসাগর শস্যচুক্তি বাতিল হয়ে যাওয়া অবশ্যই পরিতাপ করার মতো একটি বিষয়। কিন্তু বিশ্বে ক্ষুধার বড় কারণ এটি নয়। ইউরোপীয় অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিটিও এ ব্যাপারে একমত যে বিশ্বে ক্ষুধার মূল কারণ হলো খাদ্যের বাজারে চলা ফাটকাবাজি।

কৃষ্ণসাগর শস্যচুক্তি তদারকির জন্য জাতিসংঘ ইস্তাম্বুলে একটি যৌথ সমন্বয় কেন্দ্র গঠন করেছিল। এতে রাশিয়া, তুরস্ক, ইউক্রেন ও জাতিসংঘের প্রতিনিধিরা ছিলেন।

জাহাজীকরণ নিয়ে সমন্বয় কেন্দ্রে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে বেশ কয়েকবার উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল। বিশেষ করে ২০২২ সালের অক্টোবরে ইউক্রেন কৃষ্ণসাগরে রাশিয়ার নৌবহরে হামলা চালানোর পর উত্তেজনা চরমে উঠেছিল। ইউক্রেনের হামলার কবলে পড়া জাহাজগুলোর কয়েকটি ক্রিমিয়ার সেভাস্তোপল বন্দরে খাদ্যশস্য নিয়ে যচ্ছিল। এ ছাড়া পশ্চিমা বিশ্ব নিষেধাজ্ঞার পরিধি বাড়ালে রাশিয়া তাদের কৃষিপণ্য রপ্তানিতে সমস্যায় পড়লে উত্তেজনা আরও বাড়ে।

এ পরিস্থিতিতে রাশিয়া জাতিসংঘের কাছে তিনটি প্রস্তাব রাখে। প্রথমত, রাশিয়ার কৃষি–সম্পর্কিত ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাশিয়ান অ্যাগ্রিকালচার ব্যাংককে আন্তর্জাতিক আর্থিক লেনদেনব্যবস্থা সুইফটের সঙ্গে আবার যুক্ত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, শস্যচুক্তির আলোচনা শুরুর সময় থেকেই রাশিয়া ওদেসা বন্দর দিয়ে অ্যামোনিয়াভিত্তিক সার রপ্তানির দাবি জানিয়েছিল।

এ ক্ষেত্রে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ অ্যামোনিয়া পাইপলাইন (তগলিয়েত্তি-ওদেসা) আবার খুলে দেওয়ার বিষয়ে মূল বিতর্কটা বাধে। বিশ্ববাজারে অ্যামোনিয়া সার বিক্রির জন্য ২০২২ সালের জুলাই মাসে জাতিসংঘের সঙ্গে রাশিয়ার একটি চুক্তি হয়। কিন্তু এ বছরের জুনে ইউক্রেনের সেনারা খারকিভে তগলিয়েত্তি-ওদেসা পাইপলাইনের একটি অংশ উড়িয়ে দিলে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। 

তৃতীয়ত, কৃষি খাতের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আমদানি করতে গিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে রাশিয়া। দেশটির জাহাজগুলো ইনস্যুরেন্স কিনতে পারছে না, বিদেশের অনেক বন্দরে তাদের প্রবেশাধিকারও নেই। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা কৃষি খাত ‘এড়িয়ে’ দেওয়া হলেও রাশিয়ার কোম্পানি ও ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় সেটি অবধারিতভাবে কৃষি খাতের ওপর গিয়ে পড়েছে।

পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার পাল্টা হিসেবে রাশিয়া তাদের সার ও কৃষিপণ্য রপ্তানির ওপর বিধিনিষেধ দিয়েছে। নির্দিষ্ট কিছু পণ্য রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা, লাইসেন্সের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ এবং রপ্তানি কর বাড়ানোর মতো পদক্ষেপ নিয়েছে রাশিয়া। পাশাপাশি রাশিয়া তাদের কৃষিপণ্য ভারতের মতো দেশে সরাসরি বিক্রি করতে চলেছে।

এ মাসের শেষে সেন্ট পিটার্সবার্গে দ্বিতীয় রাশিয়া-আফ্রিকা ইকোনমিক ও হিউম্যানিটারিয়ান ফোরামে নিশ্চিতভাবেই এটি মূল আলোচ্য বিষয় হবে। এ সম্মলনকে সামনে রেখে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামপোসাকে ডেকে আফ্রিকা মহাদেশের খাদ্য ও সার রপ্তানির ক্ষেত্রে রাশিয়া যেসব সমস্যায় পড়েছে তা ব্যাখ্য করেছেন।

পুতিন বলেন, কৃষ্ণসাগর শস্যচুক্তির মূল বিষয় হলো আফ্রিকা মহাদেশসহ বিশ্বের গরিব দেশগুলোতে খাদ্যশস্য সরবরাহ করা; কিন্তু সেটি সম্ভব হচ্ছে না।

সুনির্দিষ্টভাবেই শস্যচুক্তি স্থগিত হওয়ায় বিশ্বের লাখ লাখ মানুষকে ক্ষুধার সঙ্গে লড়াই করতে হবে। কিন্তু বিশ্বে কয়েক শ কোটি মানুষ খাদ্যবাজারে ফাটকাবাজির জন্য নাজুক অবস্থায় আছে—শস্যচুক্তি ভেস্তে যাওয়ার ঘটনা তাদের বর্তমান অবস্থার কোনো হেরফের হবে না।

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

বিজয় প্রসাদ ভারতীয় ইতিহাসবিদ ও সংবাদিক