ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রের ভোট দিতে আসছেন ভোটাররা। ঢাকা–১৩ আসন।
ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রের ভোট দিতে আসছেন ভোটাররা। ঢাকা–১৩ আসন।

ভোটচিত্র

ফাঁকা ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের ‘জামাই আদর’

সকাল আটটায় ভোট গ্রহণ শুরু। প্রথম প্রহরের ভোটচিত্র দেখতে আগেভাগে বাসা থেকে বের হলাম।

মগবাজার থেকে শহীদ তাজউদ্দীন সড়কে নেমে দেখি একেবারে ফাঁকা। মাঝে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দু-একটি গাড়ি ছুটে চলছে দ্রুতগতিতে। ফুটপাত দিয়ে শ্রমজীবী মানুষ হেঁটে চলেছেন। তাঁদের কাছে ভোটের চেয়ে জীবিকা বড়। যেতে যেতে হয়তো মাথার ওপর নির্বাচনী পোস্টারগুলোর দিকে তাকাচ্ছেন, এই পোস্টার, এই ভোট তাদের জীবনে কোনো আনন্দ বয়ে আনতে পারেনি।

মহাখালী মোড়ের আগে সড়কের পশ্চিম পাশে নৌকার একটি নির্বাচনী ক্যাম্প দেখে গাড়ি থামালাম। জিজ্ঞেস করলাম, কাছাকাছি ভোটকেন্দ্র কোথায়? কয়েকজন স্থানীয় কর্মী এগিয়ে এসে বললেন, সড়কের পুব পাশে একটু এগোলেই আমতলী স্টাফ ওয়েলফেয়ার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র। এটি ঢাকা-১৭ আসনের অধীন।

কয়েক মাস আগেও এখানে উপনির্বাচন হয়ে গিয়েছিল। ভোট পড়েছিল ১২ শতাংশের কাছাকাছি। এবার কত পড়বে, সে নিয়ে মানুষের মধ্যে কৌতূহল ছিল।

আমতলী ওয়েলফেয়ার সরকারি বিদ্যালয় কেন্দ্রে মোট ভোটার ১ হাজার ৪৬৮ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৯৬০ ও নারী ৫২৫ জন। নারী ভোটারদের উপস্থিতি তুলনামূলক কম মনে হলো।

আমরা যখন কেন্দ্রে যাই, তখন সকাল ৯টা। এক ঘণ্টায় ভোট পড়েছে কোনো বুথে ৫টি, কোনো বুথে ১০টি। প্রতিটি বুথে দেখি দুজন করে এজেন্ট। নৌকা ও কুলা মার্কার। এ আসনে প্রার্থী সাতজন। নৌকা মার্কার মোহাম্মদ এ আরাফাত ছাড়া কারও পোস্টার বা নির্বাচনী ক্যাম্প চোখে পড়ল না।

মোড় পার হয়ে মহাখালী-গুলশান সড়কে কিছুটা এগোতেই তিতুমীর সরকারি কলেজ। ভেতরে ঢুকতেই একজনের হাতে প্রথম আলো দেখলাম। তিনি সেখানে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত। জিজ্ঞেস করলাম, আজ ভোটের দিন বলেই প্রথম আলো পড়ছেন। তিনি বললেন, ‘আমি নিয়মিত পড়ি। প্রথম আলো পড়তে ভালো লাগে।

ঢাকা-১৭, ঢাকা-১৮, ঢাকা-১৫ ও ঢাকা-১২ আসনের যতগুলো কেন্দ্র ঘুরে দেখেছি, চিত্র মোটামুটি এক। কেন্দ্রের বাইরে বড়সড় জটলা, কর্মীদের ইতস্তত ঘোরাফেরা। আর ভেতরে অনেকটা ফাঁকা। এক-দুজন ভোটার এলে ‘জামাই আদরে’ তাঁদের ভেতরে নিয়ে যান কর্মীরা।

তিতুমীর কলেজে নারী ও পুরুষদের দুটি কেন্দ্র। কিন্তু কলেজের বিপরীতে নৌকার নির্বাচনী ক্যাম্পে বিরাট জটলা। বেশির ভাগই বয়সে তরুণ, তিতুমীর কলেজের ছাত্রও হতে পারেন। সেখানে একাধিক রিকশায় দেখলাম, ব্যানার ঝোলানো—‘নির্বাচনী কাজে নিয়োজিত’। নিচে লেখা—তরিকুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক ‘ক’ ইউনিট। একজন রিকশাচালককে পরামর্শ দিচ্ছেন, ভোটার ছাড়া কাউকে নেবেন না।

তিতুমীর কলেজে সকাল ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত ৬টি বুথে মোট ভোট পড়েছে ৪৬টি। এর মধ্যে একটি বুথে মাত্র ২টি ভোট পড়েছে। এ আসনে মোট ভোটারসংখ্যা ৩ হাজার ১০৭। ফেরার পথে এক নারী ভোটার জানান, তিনি ছেলেকে নিয়ে কেরানীগঞ্জ থেকে এখানে ভোট দিতে এসেছেন। কিন্তু আইডি মিলছে না।

এ কেন্দ্রে নৌকা, কুলা ও একতারা ছাড়া অন্য কোনো প্রার্থীর এজেন্ট ছিলেন না।
ঢাকা-১৭ আসনের নিউ লাইট হাইস্কুল কেন্দ্রে যখন আমরা পৌঁছাই, তখন সকাল ১০টা। সেখানে মোট পুরুষ ভোটার ৪৩২ ও নারী ভোটার ৪২৯। তখন পর্যন্ত নারীদের ভোট পড়েছে ১৫টি, আর পুরুষদের ভোট ২৫টি।

এ আসনে আওয়ামী লীগ নৌকা প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ সদস্য মোহাম্মদ হাবিব হাসানকে বসিয়ে দিয়ে জাতীয় পার্টির শেরিফা কাদেরকে সমর্থন দেয়। আওয়ামী লীগের দুই নেতা মো. খসরু চৌধুরী ও এস এম তোফাজ্জল হোসেন যথাক্রমে ট্রাক ও কেটলি প্রতীকে লড়ছেন।

৪০ নম্বর ও ৪১ নম্বর কেন্দ্রে ঘুরে দেখলাম, ট্রাক ও কেটলির এজেন্ট থাকলেও লাঙ্গলের কোনো এজেন্ট নেই। আবার একটি কেন্দ্রে তৃতীয় একজন এজেন্ট থাকলেও তিনি তাঁর প্রার্থীর নাম বলতে পারলেন না।

স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেল, নির্বাচনী প্রচারেও লাঙ্গলের প্রার্থী শেরিফা কাদের এখানে আসেননি। তবে জাতীয় পার্টির স্থানীয় নেতা জাকির হোসেন এসে লাঙ্গলের পক্ষে ভোট চেয়েছেন।

একজন স্থানীয় বাসিন্দা, যিনি বহু বছর ধরে বিদেশে ছিলেন, ভোটের বিষয়ে ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, ‘এ রকম ভোট নাকি হওয়ার কথা ছিল!’

স্থানীয় লোকজনের ধারণা, এখানে ট্রাক ও কেটলির মধ্যেই মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। কেন্দ্রের বাইরে ট্রাক ও কেটলির বুথ থাকলেও লাঙ্গলের পক্ষে কোনো তৎপরতা নেই।

সকালে সাড়ে ১০টায় পুরুষ কেন্দ্রে ৩৪২টি ভোটের মধ্যে ভোট পড়েছে ১৬টি। আর নারী কেন্দ্রে ৪৩২টির মধ্যে ১৪টি। কেন্দ্রের বাইরে ট্রাক ও কেটলির সমর্থকদের ‘পরোটা-ভাজি’ উৎসব চলছিল।

বেলা ১১টা। ঢাকা-১২ আসনের টেকনিক্যাল টিচার্স ট্রেনিং কলেজ কেন্দ্র। কেন্দ্রের বাইরে অনেক গাড়ি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সতর্ক প্রহরায়। দোতলা, তিনতলা ও চারতলায় ভোট নেওয়া হচ্ছে।

দোতলায় উঠতে এক নারীকে দেখলাম, তাঁর প্রতিবন্ধী মেয়েকে নিয়ে এসেছেন ভোট দেওয়ানোর জন্য। সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা তাঁর ভোট দেওয়ার ব্যাপারে সহায়তা করলেন। তিনি বললেন, তাঁকে গোপন কক্ষে যেতে হবে না। তিনি চেয়ারে বসেই ভোট দিতে পারবেন।

এ কেন্দ্রে মোট ভোটার ২ হাজার ২০৮। বেলা ১১টা পর্যন্ত পড়েছে ৭৯টি ভোট। ভোট পড়ার হার ৩ দশমিক ৫৭। তখন ভোট গ্রহণের সময় তিন ঘণ্টা পার হয়ে গেছে।

ঢাকা-১৭, ঢাকা-১৮, ঢাকা-১৫ ও ঢাকা-১২ আসনের যতগুলো কেন্দ্র ঘুরে দেখেছি, চিত্র মোটামুটি এক। কেন্দ্রের বাইরে বড়সড় জটলা, কর্মীদের ইতস্তত ঘোরাফেরা। আর ভেতরে অনেকটা ফাঁকা। এক-দুজন ভোটার এলে ‘জামাই আদরে’ তাঁদের ভেতরে নিয়ে যান কর্মীরা।

আর নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তারা অলস সময় পার করছেন। মাঝেমধ্যে চা-নাশতা খান, গল্প করেন। বিকেল চারটা পর্যন্ত তো অপেক্ষা করতে হবে।

ফেরার সময় দেখি, নির্বাচন কমিশনের পর্যবেক্ষক কার্ড নিয়ে ঢুকছেন দুই ভদ্রলোক। জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনারা কোন সংস্থা থেকে এসেছেন?’ তিনি বললেন, ‘কেরানীগঞ্জ হিউম্যান রাইটস ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি।’

জানতে চাইলাম, তাঁদের সংস্থার প্রধানের নাম কী? তাঁরা পুরো নাম বলতে পারলেন না। ডাকনাম বললেন। এই প্রথম তাঁরা এ দায়িত্ব নিয়ে এসেছেন। কিন্তু দায়িত্বটি কী, তা তাঁরা জানেন না।

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি।

    ই–মেইল: sohrab.hassan@prothomalo.com