পরিবহনশ্রমিকদের ‘অমানবিক’ করে তোলার প্রক্রিয়া কবে বন্ধ হবে

পরিবহনশ্রমিক মানেই যাত্রীর সঙ্গে ঝগড়া–বিবাদ, নিত্য ক্যাচাল। গরমে, ভিড়ে, ঘামে, গাদাগাদিতে, দূষিত বায়ুর নিশ্বাসে, কানফাটা উচ্চশব্দে, টয়লেট চাপিয়ে রাখা একদল অমানুষ!
ছবি: প্রথম আলো

বাস কন্ডাকটরদের জীবন দুঃসহ। কর্মসুরক্ষা নেই, সম্মান নেই, বরং এটা এমন পেশা যেখানে স্বাস্থ্যঝুঁকি চরম। অসহ্য গরম আর ভিড় ও গাদাগাদিতে সারা দিন দূষিত বায়ুতে নিশ্বাস নেন তাঁরা, এমনকি টয়লেট সুবিধাটাও নেই। অসুস্থতা, কাশি তাঁদের নিত্যসঙ্গী। অধিকাংশ কন্ডাকটর অল্প বয়সেই কিডনির সমস্যা এবং হাড় ক্ষয়ের রোগে ভোগেন। পরিবহনশ্রমিকদের নিয়ে ভাবা দরকার। পরিবহনশ্রমে সুরক্ষা ফেরানো দরকার।

পরিবহনমালিকেরা দেশের শীর্ষ ধনী, তাঁরা বড়লোক। মন্ত্রী–প্রধানমন্ত্রীদের খুব কাছের এবং ক্ষমতার রাজনীতিতে ‘দরকারি’ ভিআইপি! বিপরীতে তাঁদের শ্রমিকেরা সমাজে নিকৃষ্ট হিসেবে বিবেচিত। মালিকপক্ষ পরিবহনশ্রমিকদের কাজের চুক্তিপত্র দেন না, ফলে দীর্ঘ কর্মঘণ্টা ও ছুটিহীন জীবন তাঁদের নিত্যদিনের। কাজ না করলে আয় নেই।
বিরোধী রাজনৈতিক কর্মসূচি থাকলে কিংবা সরকারি হরতালেও তাঁদের থাকতে হয় কর্মহীন। ভাড়া তুলতেও তাঁদের গালি শুনতে হয়, পুলিশকে কম দিলেও হয়রানিতে পড়তে হয়। রাজনৈতিক নেতাদের নিযুক্ত লাইনম্যানকে চাঁদা কম দিলে খেতে হয় মাইর। লাইনম্যানের সঙ্গে পরিবহনশ্রমিকদের সম্পর্ক যেন ইঁদুর–বিড়াল খেলা।

অভিযোগ আছে, ঢাকার প্রতিটি যানবাহনকে প্রতিদিন ট্রাফিক পুলিশকে একটি নির্দিষ্ট বখরা দিতে হয়। এটা মালিকপক্ষ নির্ধারণ করে না, বরং শ্রমিকদের নিজের আয়ের থেকেও মাঝেমধ্যে দিতে হয়, যা শ্রমিকদের জন্য খুবই বেদনাদায়ক। ত্রিমুখী, চতুর্মুখী নিপীড়নে তাঁদের জীবন অতিষ্ঠ। এর ভেতর আবার আছে অপরাধে জড়িয়ে পড়ার, মাদকাসক্ত হওয়ার, মাদক পাচারের কালো পাকে ঢুকে যাওয়ার নিত্যসম্ভাবনা। পরিবহনশ্রমিক তাঁর মালিকের অবৈধ আয়েরও মেঠোকর্মী। পরিবহনশ্রমিকদের তাঁরা রাজনৈতিক কর্মসূচির ভাড়াটে লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করেন।

জ্বালানির দাম বাড়ার আগে–পরে, প্রায় প্রত্যেক যাত্রীর সঙ্গে হেল্পার অর্থাৎ কন্ডাকটরের কথা–কাটাকাটি হয়। কথা–কাটাকাটি, গালাগালি, মারামারি, চড়–থাপ্পড় হয় স্বাভাবিক সময়েও। সরকার জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায়, মালিক ভাড়া বাড়ান, সেটা আদায় করতে হয় শ্রমিকদের! সরকার নিরাপদ, মালিকও নিরাপদ; মাঝখানে বর্ধিত ভাড়া আদায় করতে গিয়ে বিপাকে পড়েন শ্রমিক। এসব পেশাগত ঝুঁকি ও নানা গঞ্জনা মানসিক স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের কারণও বটে। এদিকে যানজটের ক্ষতি পোষাতে রাতদিন ট্রিপ দিতে হয়। মালিকের বেশি আয় মানেই তাঁর কিছুটা বেশি আয় নয়।

পরিবহনশ্রমিক মানেই যাত্রীর সঙ্গে ঝগড়া–বিবাদ, নিত্য ক্যাচাল। গরমে, ভিড়ে, ঘামে, গাদাগাদিতে, দূষিত বায়ুর নিশ্বাসে, কানফাটা উচ্চশব্দে, টয়লেট চাপিয়ে রাখা একদল অমানুষ! গাড়িতে যাত্রী বেশি থাকলেই তাঁদের ঝুলতে হয় হ্যান্ডেলে, গোটা দিন যায় তাঁদের ঝুলতে ঝুলতে এবং চিল্লাপাল্লা আর ঝগড়াঝাটির ভেতর দিয়ে। এ যেন ঝুলন্ত এক কর্মজীবন।

একজন পরিবহনশ্রমিকের ভাষ্য, ‘খুব ঝামেলার লাইন। সবার লগেই কাউকাউ করতে হয়। মহাজনের লগে, যাত্রীর লগে, লাইনম্যানের লগে...সবার লগেই কাউকাউ। যাত্রীরা আমাগো মানুষই মনে করে না। আত্মীয়স্বজনের লগেও মিলমিশ নাই। কাউকাউ (ঝগড়া বা কথা কাটাকাটি) কি সাধে করি? কিছু মানুষ আছে, খাইসলতই খারাপ। ভাড়া কম দিতে পারলেই মনে করে বিরাট কিছু হয়া গেল। আমাগো তো চলতে হয়, নাকি? গাড়ি একবার রাস্তায় বের করলে সাত-আট শ টাকা খরচ আছে। এরপর ভেজাল আছে বহুত। চান্দাবাজি আছে, ভাই-বেরাদরগো খুশি রাখতে হয়, কত কত যে কাহিনি রাস্তায়! আমরা তিনজন স্টাফ, তারপর মহাজনরেও লাভ দিতে হয়। লাইনের কাগজ নিতে দিনে দিতে হয় ৫৭০ টাকা।’ (টিবিএস, ১৬ অক্টোবর ২০২২, যে জীবন বাস কন্ডাক্টরের: দিন শুরু যার বচসায়, ভাড়ার বিবাদে!)। টিবিএসের প্রতিবেদনমতে, ড্রাইভার ও হেল্পাররা ‘দুই বেলায় খোরাকি বাবদ ৭০ টাকা পান প্রতিজন। তাতে সব সময় কুলায় না, বিশেষ করে যেদিন গরুর তরকারি দিয়ে ভাত খেতে মন চায়। তখন নিজের পকেট থেকে ভরতে হয়।’ দ্রব্যমূল্যের চরম ঊর্ধ্বগতি, ১২ বছরের সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতির সময় যেখানে ১৫০–২০০ টাকার কমে হোটেলে ভরপেট আমিষ তরকারিসহ খাওয়া দায়, সেখানে ৭০ টাকায় কী খান শ্রমিকেরা, এই চিন্তা কি মালিক ও সরকারের আছে? ১৬ অক্টোবর বিশ্ব খাদ্য দিবসের একটি প্রতিবেদনে বাংলা ট্রিবিউন দেখিয়েছে, ‘খরচ বাড়ায় দুপুরে খাওয়ার আগ্রহ কমছে শ্রমজীবী মানুষের!’

দূরপাল্লার বাসের হেল্পার–কনডাক্টররা দুই ট্রিপের ফাঁকে কিছু বিশ্রাম পান, কিন্তু ট্রিপপ্রতি মজুরির ঝুঁকিপূর্ণ মডেলে তাঁদের বিশ্রামের মূল্য শূন্য। অন্যদিকে শহরের পরিবহনশ্রমিকের বিশ্রাম নেই। যানজটে সময় চলে যায় বলে, শ্রমঘণ্টা দীর্ঘতর হয়। অবসর নিতে গোটা দিনই কাজ থেকে দূরে থাকতে হয়, ফলে কাজ না করা দিনগুলোয় থাকে না কোনো আয়।

পরিবহনশ্রমিক মানেই যাত্রীর সঙ্গে ঝগড়া–বিবাদ, নিত্য ক্যাচাল। গরমে, ভিড়ে, ঘামে, গাদাগাদিতে, দূষিত বায়ুর নিশ্বাসে, কানফাটা উচ্চশব্দে, টয়লেট চাপিয়ে রাখা একদল অমানুষ! গাড়িতে যাত্রী বেশি থাকলেই তাঁদের ঝুলতে হয় হ্যান্ডেলে, গোটা দিন যায় তাঁদের ঝুলতে ঝুলতে এবং চিল্লাপাল্লা আর ঝগড়াঝাটির ভেতর দিয়ে। এ যেন ঝুলন্ত এক কর্মজীবন।

‘ওস্তাদ বাঁয়ে প্লাস্টিক’ হাঁকানো শ্রমিকজীবনের ডানে ও বাঁয়ে উভয় পাশেই যেন প্লাস্টিক! এ কোনো মানবিক জীবন নয়! সত্যিই পেলাস্টিক। পেশা ও পেশার বাইরে সমাজে তাঁদের কেউ ভালোবাসে না।  ‘সমাজে ওঠাবসা কেমন আপনাদের?’ এমন প্রশ্নের জবাবে, পরিবহনশ্রমিক আব্বাস আলী টিবিএসকে বলেন, ‘আমাগো কি সমাজ আছে? গাড়ির লাইনের লোকজনই বন্ধুবান্ধব। দিনে ১২-১৪ ঘণ্টা গাড়ির লগেই যায়। সপ্তাহে চার দিন গাড়িতে থাকি। যেদিন গাড়িত থাকি না, ঘরেই শুয়েবসে কাটাই। আমাগো লগে বাইরের বেশি লোকের ওঠাবসা নাই।’

হতাশাজনক দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, মালিকের টার্গেট ভাড়া তুলতে ব্যর্থ হওয়ার গ্লানি, ভালোবাসাহীন জীবনের হতাশা, মানহীন কর্মপরিবেশের ভয়ংকর চাপ ও উৎকণ্ঠা পরিবহনশ্রমিকদের ভেতর মাদকের বিস্তারে ভূমিকা রাখছে। অবসরহীন পরিশ্রম, একঘেয়ে জীবন, শুকিয়ে আসা পারিবারিক জীবনে ক্লান্ত মানুষ রাসায়নিক সুখে মুক্তি খুঁজবে, সেটা খুবই স্বাভাবিক।

পরিবহনশ্রমিকদের বিরুদ্ধে অভিযোগের তালিকাও বিস্তর। রাত্রে ফাঁকা বাসে সঙ্গীহীন নারী যাত্রীকে হেনস্তা করার অভিযোগ দীর্ঘ। আছে ধর্ষণের অভিযোগ। এমনকি দিনের বেলায়ও ঘটে ইভিটিজিংয়ের ঘটনা। কন্ডাক্টররা মাঝেমধ্যে কাউকাউয়ের জেরে যাত্রীকে বাস থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন, চাকায় পিষ্ট হয়ে মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটে। ঢাকায় চলন্ত বাস থেকে ফেলে যাত্রীকে হত্যার অভিযোগের খবর এসেছে প্রথম আলোতে ১৫ অক্টোবর ২০২২। এমন ঘটনা নতুন নয়।

কয়েক লাখ মেকানিক, গ্যারেজ মিস্ত্রী, বডি মিস্ত্রী, ক্লিনার, হেল্পার, কনডাক্টর, চালক মিলে দেশে মোট পরিবহনশ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৭০ লাখ, এদের কাজের চুক্তিপত্র নেই। বাণিজ্যিক কারণে ব্যবহৃত যানবাহন যথা বাস, ট্যাক্সি, লাক্সারি ট্যাক্সি, হালকা বাণিজ্যিক যানবাহন, ভ্যান, অটোরিকশা, ইজিবাইক, টেম্পো, লরি, ট্রাক, নসিমন, ঠেলাগাড়ি প্রভৃতির সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকগণও পরিবহনশ্রমিক হিসেবে বিবেচিত। শিক্ষাবঞ্চিত, স্বল্প সুযোগপ্রাপ্ত বিশাল জনতা দেশের কর্মসংস্থানের মূলধারায় নেই। অমানবিক শ্রমে নিজেরা ঠকেন বলে, সুযোগ পেলে অন্যদেরও ঠকান, অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। এই চক্র থামাতে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। পরিবহনশ্রমিকদের স্থায়ী ও অস্থায়ী চুক্তিপত্রের মাধ্যমে নিয়োগ দিতে হবে, দৈনিক কর্মঘণ্টা ও ডিউটি শিফট নির্ধারিত থাকবে, ওভারটাইম পেমেন্ট থাকবে, সাপ্তাহিক বা মাসিক বেতনসহ ছুটি থাকবে, ডিউটিকালীন খাবার ভাতা, মাসিক স্বাস্থ্য ও পরিবহন ভাতা বাধ্যতামূলক থাকবে। কাজের চুক্তিপত্রে ন্যূনতম মজুরির গাইডলাইন থাকবে, যেটা হবে শহরে বাঁচার মতো মজুরির হিসেবে নির্ধারিত। পাশাপাশি পরিবহনশ্রমিকদের জন্য জাতীয় বাজেটে সুস্পষ্ট সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প দরকার। এসব নিরাপদ সড়কেরও বড় অনুষঙ্গ হয়ে উঠেবে। কাজের পরিবেশ মানবিক হলে, মজুরি ভালো হলে, গণপরিবহনের সেবাও মানসম্পন্ন হবে।

চুক্তিপত্রহীন চাকরির ভাতা ও সুরক্ষাহীন শ্রমের এই দাসবৃত্তি অমানবিক। অমানবিক শ্রম পাল্টা অপরাধের জন্ম দিচ্ছে। তাই অমানবিক শ্রম বন্ধ করে, মানসম্পন্ন গণপরিবহন সেবার জন্য ‘বাঁচার মতো মজুরি’তে চুক্তিপত্রভিত্তিক মানবিক শ্রমকাঠামো দরকার পরিবহনশ্রমিকদের! পাশাপাশি কিছু আচরণগত, ট্র্যাফিক সিগন্যাল বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ফ্রি ট্রেনিং আয়োজন করা দরকার। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী উদ্যোগ নিলে ভালো হয়। কেন্দ্রীভূত প্রশাসনে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ছাড়া দেশের মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার কোনো বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ আশা করা যায় না!

  • ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক। গ্রন্থকার: চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ; বাংলাদেশ: অর্থনীতির ৫০ বছর; অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের অভাবিত কথামালা; বাংলাদেশের পানি, পরিবেশ ও বর্জ্য। faiz.taiyeb@gmail.com