ইসরায়েল যেখানে হেরে গেছে

যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন নিয়ে ইসরায়েল যে গণহত্যা চালাচ্ছে, তার প্রতি বিশ্ব চোখ বন্ধ করে রাখবে, এমনটা আশা করা যায় না।
ছবি : এএফপি

নিউ মিডিয়ার দুনিয়ায় জাঁদরেল পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলো নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। নিয়ন্ত্রণ এখন ইনস্টাগ্রাম রিল, টিকটক ভিডিও ও ইউটিউব শর্টসের হাতে। ফলে অধিকৃত গাজা উপত্যকায় ইসরায়েল যে যুদ্ধ চালাচ্ছে, তা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে।

এক মাসের বেশি সময় ধরে বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষ ফিলিস্তিনি উপত্যকায় ইসরায়েলের নির্বিচার বোমা হামলার সচিত্র খবর দেখছেন। এ জন্য তাঁরা তাঁদের পছন্দসই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে বেছে নিচ্ছেন। ইন্টারনেটের কল্যাণে বোমা হামলায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া শিশু, কংক্রিটের নিচে চাপা পড়া নারী, মায়ের কোলে শিশুর মরদেহের সচিত্র প্রতিবেদন এখন সবার হাতের মুঠোয়।

ইসরায়েলও পাল্লা দিয়ে গাজার এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ এবং দশকের পর দশক ধরে চলা দখলদারি নিয়ে ভিন্ন ভাষ্য প্রচারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

গাজা পরিস্থিতি সম্পর্কে যে সাংবাদিকেরা সত্য তথ্য প্রচারের চেষ্টা করছেন, তাঁদের সন্ত্রাসী আখ্যা দিতে এতটুকুও দ্বিধা করছে না ইসরায়েল। শুধু চলমান যুদ্ধে ইসরায়েল ৫৩ জন সাংবাদিক ও সংবাদকর্মীকে হত্যা করেছে। কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টের মতে, সাংবাদিক ও তাঁদের পরিবারকে নিশানা করে ইসরায়েলি বাহিনী এই হামলা চালিয়েছে। আল–জাজিরার (আরবি) গাজা প্রতিনিধি ওয়ায়েল দাহদুহ তাঁর স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, দৌহিত্রকে হারিয়েছেন এমনি এক হামলায়। তিনি যখন সম্প্রচারে তখনই ওই হামলার ঘটনা ঘটে।

ইসরায়েল বিদেশি সাংবাদিকদের গাজায় ঢুকে স্বাধীনভাবে সংবাদ প্রকাশ করতে দিচ্ছে না। সিএনএনের ফরিদ জাকারিয়া সম্প্রতি স্বীকার করেছেন, ইসরায়েল এই মুহূর্তে কেবল সেই সব সাংবাদিকের সুযোগ দিচ্ছে, যাঁরা ফুটেজ প্রকাশের আগে তাদের অনুমতি নিয়ে নিচ্ছে। জাকারিয়া বলেন, সিএনএন এই সুযোগ নিয়েছে। এতে ইসরায়েলি অভিযানের সামান্য অংশ হলেও দেখানো সম্ভব হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন নিয়ে ইসরায়েল যে গণহত্যা চালাচ্ছে, তার প্রতি বিশ্ব চোখ বন্ধ করে রাখবে, এমনটা আশা করা যায় না। স্বল্পস্থায়ী যুদ্ধবিরতি দ্রুতই শেষ হয়ে গেল। এই সময়ে গাজায় কিছু মানবিক সহায়তা পৌঁছেছে। ফিলিস্তিনিরা প্রিয়জনকে কবর দিতে পেরেছেন, যত দূর সম্ভব ক্ষতে প্রলেপ দিতে পেরেছেন। যুদ্ধবিরতির পর ইসরায়েলের লক্ষ্য আরও বোমা বর্ষণ ও গাজাকে পুরোপুরি অবরুদ্ধ করে ফেলা। ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের যুদ্ধ খুব দ্রুত শেষ হবে না, কিন্তু জনমতের কাছে তারা পরাজিত হয়েছে।

এত কসরতের পরও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে কী করছে, তা আর এখন ধামাচাপা দিতে পারছে না। ফিলিস্তিন ইস্যুতে জনমত গঠনের নিয়ন্ত্রণ এখন আর ইসরায়েলিদের হাতে নেই। মূল ধারার গণমাধ্যম পশ্চিমারা কিংবা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা অগণিত শ্রোতা-পাঠক-দর্শক কী শুনবেন-পড়বেন বা দেখবেন, তা এককভাবে চাপিয়ে দিতে পারছে না। ফলে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের বর্বর দখলদারি সবার কাছে উন্মুক্ত হয়ে গেছে।

গাজা ইস্যুতে ইসরায়েলিদের পিঠ বাঁচানোর বেপরোয়া চেষ্টা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এখন ব্যাপক ব্যঙ্গবিদ্রূপ চলে। মূল ধারার গণমাধ্যম তোতা পাখির মতো ইসরায়েলি ভাষ্য প্রচার করলেও ধরা পড়ে যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ২৯ নভেম্বর থেকে হ্যাশট্যাগ উইওন্টবিসাইলেন্সড (আমাদের চুপ করিয়ে দেওয়া যাবে না) নামে একটি প্রচার চলছে।

এক হাতে মুখ চেপে ধরে অন্য হাতে বার্তা লেখা পোস্টার আপলোড করতে উৎসাহিত করা হচ্ছে ব্যবহারকারীদের। ক্যাম্পেইনটি শুরুর পর থেকে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হাজার হাজার প্রতিক্রিয়া জমা পড়েছে। এই প্রতিরোধ অব্যাহত থাকবে বলে আশা করা যায়, কারণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকের অ্যাকাউন্ট নিষিদ্ধ হচ্ছে, অনেককে মত প্রকাশে বাধা দেওয়া হচ্ছে ও ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে।

শুধু ইসরায়েল নয়, তাদের সবচেয়ে বড় অর্থদাতা ও সহায়তাকারীও বুঝতে পারছে ইসরায়েলি প্রচারণা ক্রমেই মুখ থুবড়ে পড়ছে। গত সপ্তাহের অস্থায়ী যুদ্ধবিরতির ঘোষণার পর মার্কিনরা ফিলিস্তিন ইস্যুতে জনমতের পরিবর্তন হওয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

এ ক্ষেত্রে অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি নিয়ে বাইডেন প্রশাসনের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার উদ্বেগ নিয়ে পলিটিকোর প্রতিবেদনটি উল্লেখযোগ্য। ওই কর্মকর্তা বলেছিলেন, ‘সাময়িক যুদ্ধবিরতি হলে সাংবাদিকেরা আরও বেশি সংখ্যায় গাজায় প্রবেশ করবেন। এতে ইসরায়েল গাজায় যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, তা প্রকাশ হয়ে পড়বে। জনমত ইসরায়েলের বিপক্ষে চলে যাবে।’

তাঁর এ বক্তব্যের মানে দাঁড়ায়, মার্কিন কর্মকর্তারা জানেন গাজায় বোমা বর্ষণের পর জনমত ঘুরে গেছে। এই প্রেক্ষাপটে সাংবাদিকদের ব্যাপক প্রবেশ গাজায় ইসরায়েল যে গণহত্যা চালাচ্ছে, তা প্রকাশ করে দেবে। আর এ কথা তো সবারই জানা, যুক্তরাষ্ট্রের অনুমতি ও সমর্থন নিয়েই ইসরায়েল এই যুদ্ধ চালাচ্ছে।

গাজা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এবারই প্রথম কোনো ইস্যুতে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের ভাষ্য প্রশ্নের মুখে পড়ল, এমন না। তবে গণমাধ্যমের ভাষ্য ও জনমত গঠনের ওপর ইসরায়েলিদের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হয়ে পড়েছে, তা মোটামুটি পরিষ্কার। গাজায় যুদ্ধ শুরুর বেশ আগে এ বছরের মার্চে গ্যালাপ একটি ডেটা প্রকাশ করে। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ‘ডেমোক্র্যাটদের বড় অংশ এখন মধ্যপ্রাচ্যে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে, ৪৯ বনাম ৩৮ শতাংশ।’ এই ভোটাভুটি প্রমাণ করে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন নিয়ে জাঁদরেল সংবাদমাধ্যমগুলোর ভাষ্য দুর্বল হয়ে পড়েছে।

রিপাবলিকানদের মধ্যেও ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সম্পর্ক ও বৈদেশিক সাহায্য নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি অনেক আমেরিকানকে নতুন করে ভাবাচ্ছে। ইসরায়েলকে নিয়মিত সামরিক সহযোগিতা প্রদান দলটির বৈদেশিক নীতিতে কতটা অগ্রাধিকার পেতে পারে, এমন প্রশ্নও তারা তুলছে।

৭ অক্টোবরের পর থেকে যারাই ফিলিস্তিনি বেসামরিক জনগণকে পাইকারি হারে খুনের ঘটনা প্রকাশ করেছে, তাদের সেন্সর করার চেষ্টা হয়েছে। ফিলিস্তিনিদের পক্ষে থাকা ৯০ ভাগ আধেয় তারা মুছে দিয়েছে বলেও অভিযোগ আছে। এখন এক্স (সাবেক টুইটার) কীভাবে ইসরায়েলি প্রচারণার চাপ সামলায় তা-ই দেখার বিষয়।

নিজস্ব প্ল্যাটফর্মে ইহুদিবিদ্বেষী আধেয় প্রকাশের পর ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন ইলন মাস্ক। ক্ষতি পোষাতে সম্প্রতি তিনি ইসরায়েল সফর করেছেন। সেখানে তিনি ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ‘প্রচারণা সফরের’ অংশ হিসেবে ইলন মাস্ক প্রতিশ্রুতি দেন যে ইসরায়েলি সরকারের অনুমতি ছাড়া গাজায় তিনি স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা দেবেন না।

ইসরায়েলি দখলদার বাহিনী গাজার পানি, বিদ্যুৎ, খাবার ও মানবিক সহায়তা কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে—এখন মাস্কের ইন্টারনেট সেবাও নিয়ন্ত্রণ করবে। যদিও এখনো দৃঢ়চিত্তে অনেকে বলতে চায় ইসরায়েল দখলদার বাহিনী নয়।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে ভাবমূর্তি খোয়ানোর জন্য ইসরায়েল শুধু নিজেকেই দায়ী করতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন নিয়ে ইসরায়েল যে গণহত্যা চালাচ্ছে, তার প্রতি বিশ্ব চোখ বন্ধ করে রাখবে, এমনটা আশা করা যায় না। স্বল্পস্থায়ী যুদ্ধবিরতি দ্রুতই শেষ হয়ে গেল। এই সময়ে গাজায় কিছু মানবিক সহায়তা পৌঁছেছে। ফিলিস্তিনিরা প্রিয়জনকে কবর দিতে পেরেছেন, যত দূর সম্ভব ক্ষতে প্রলেপ দিতে পেরেছেন। যুদ্ধবিরতির পর ইসরায়েলের লক্ষ্য আরও বোমা বর্ষণ ও গাজাকে পুরোপুরি অবরুদ্ধ করে ফেলা। ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের যুদ্ধ খুব দ্রুত শেষ হবে না, কিন্তু জনমতের কাছে তারা পরাজিত হয়েছে।  

  • ইমাম ওমর সুলেমান মার্কিন মুসলিম পণ্ডিত ও মানবাধিকারকর্মী।

    নিবন্ধটি আল–জাজিরায় প্রকাশিত, ইংরেজি থেকে অনূদিত।