বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু
বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু

ফিলিস্তিনি গণহত্যাকে অপরাধই ভাবে না তারা

২০২২ সালের ডিসেম্বরে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে বর্তমান ইসরায়েলি মন্ত্রিসভা গঠনের পর থেকে পশ্চিমা মূলধারার রাজনীতিকেরা, এমনকি ইসরায়েলের বিরোধী নেতারা একটি বিষয়ে একমত। সেটি হলো, এ মুহূর্তে একটি ইহুদি শ্রেষ্ঠত্ববাদী ও বর্ণবাদী সরকার ইসরায়েলকে চালাচ্ছে।

ইসরায়েলের বর্তমান সরকারের চরিত্র থেকে এটি স্পষ্ট যে দেশটির ইতিহাসের ‘সবচেয়ে উগ্র’, ‘সবচেয়ে মৌলবাদী’ এবং ‘সবচেয়ে বর্ণবাদী’ ভোটাররাই সেখানে এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ। সরকারের বর্তমান উৎপীড়নপ্রবণ বৈশিষ্ট্য এখন সাধারণ বিষয় হয়ে উঠেছে। অনেকে এটিকে ইসরায়েলের ‘প্রথম ফ্যাসিবাদী’ সরকার বলে আখ্যায়িত করছেন।

ইসরায়েলকে তার প্রতিষ্ঠার পর থেকে শুরু করে বিদ্যমান সরকারের উত্থানের বছর দুয়েক আগে পর্যন্ত ইসরায়েলপন্থী মূলধারার পশ্চিমা মানবাধিকার সংগঠনগুলো ‘বর্ণবাদী’ রাষ্ট্র বলে আসছিল। ১৯৬০ সাল থেকে ফিলিস্তিনিরা ও তাঁদের সমর্থকেরাও ইসরায়েলকে বর্ণনা করার জন্য এই ‘লেবেল’ই বেছে নিয়েছিলেন।

ইসরায়েলে এখন সেই একই সরকার, যে কিনা বরাবরই আন্তর্জাতিক নিন্দার বিষয় ছিল। এটি সেই সরকার, যে কিনা ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে চলমান গণহত্যামূলক যুদ্ধ শুরু করেছে। এটি সেই সরকার, যে কিনা এ পর্যন্ত এক লাখের বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে এবং ২০ লাখের বেশি মানুষকে বাস্তুচ্যুত করেছে।

এরপরও সেই বর্ণবাদী সরকার এবং তার গণহত্যামূলক যুদ্ধকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা অর্থ, অস্ত্র ও বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করে আসছে। তারা ইসরায়েলি অপরাধকে ন্যায্যতা দিতে পিছপা হয়নি। এর আগেও তারা ইহুদি বসতি স্থাপনকারী উপনিবেশকে সমর্থন দিয়েছিল, এখনো দিয়ে যাচ্ছে। ইসরায়েলি সরকার বর্ণবাদী, ফ্যাসিবাদী অথবা গণহত্যাকারী কি না, তা নিয়ে বিতর্ক করার প্রবণতা এখন কমে এসেছে। এসব বৈশিষ্ট্যকে ইসরায়েলি সরকারের নীতি হিসেবে ইসরায়েলিরা সানন্দে মেনে নিচ্ছেন।

সম্প্রতি মিডল ইস্ট আইয়ের প্রধান সম্পাদক ডেভিড হার্স্ট তাঁর একটি লেখায় বলেছেন, ‘ইসরায়েলি ইহুদিদের মধ্যে যাঁরা গণহত্যামূলক বর্ণবাদ সমর্থন করে কথাবার্তা বলছেন, তাঁরা এখন আর শুধু সমাজের প্রান্তবর্তী সাধারণ মানুষ নন। এসব লোকের মধ্যে সেনা কর্মকর্তা, সংগীতশিল্পী, চিত্রশিল্পী ও রাজনীতিকেরাও রয়েছেন। এসব মানুষ ইসরায়েলের মূলধারার চিন্তার প্রতিনিধিত্ব করেন।’

এই প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে যে কেউ যুক্তিসংগতভাবে বলতে পারে, ইসরায়েলের ইহুদিরা স্বেচ্ছায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে, বিশেষ করে জার্মানিতে চলে গিয়েছিল। সেখানে তাদের অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে।

ইসরায়েল গাজায় ব্যাপক হারে বোমা হামলা চালানোর এক মাসের বেশি সময় পর (তত দিনে গাজায় কয়েক হাজার মানুষ নিহত হয়েছে) ইসরায়েল ডেমোক্রেসি ইনস্টিটিউট নামের একটি সংস্থা এবং তেল আবিব ইউনিভার্সিটি যৌথভাবে একটি জরিপ চালায়। সেই জরিপে দেখা গেছে, ‘৫৭ দশমিক ৫ শতাংশ ইসরায়েলি ইহুদি বলেছেন, তাঁরা মনে করেন, ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্স (আইডিএফ) গাজায় যে বোমা হামলা চালিয়েছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। ৩৬ দশমিক ৬ শতাংশ ইহুদি বলেছেন, আইডিএফ যথার্থ পরিমাণ গোলাবারুদ ব্যবহার করছে এবং মাত্র ১ দশমিক ৮ শতাংশ ইসরায়েলি ইহুদি বিশ্বাস করেন, গাজায় প্রয়োজনের তুলনায় বেশি গোলাবারুদ ব্যবহার করা হয়েছে।’

ওই জরিপের ফলাফল বিশ্লেষণে গবেষকেরা বলেছেন, ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইসরায়েলিদের ঘৃণা অনেকটা অনুসরণীয় সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। গাজার বিরুদ্ধে ইসরায়েলের যুদ্ধ জায়নবাদকে গণহত্যামূলক ধর্ম হিসেবে উন্মোচিত করেছে।

গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের জাতিগতভাবে নির্মূল করা এবং তাদের মিসরের সিনাই উপত্যকায় তাড়িয়ে দেওয়ার ইসরায়েলি পরিকল্পনা নিয়ে ইসরায়েলের সংবাদমাধ্যমগুলো ইতিমধ্যে ‘যৌক্তিক’ নিবন্ধ ছাপতে শুরু করেছে। ইসরায়েলের একটি পত্রিকা গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের সিনাইয়ে তাড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনাকে সমর্থন দিয়ে বলেছে, ‘সিনাই হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বাসযোগ্য ও সমৃদ্ধ জায়গা যা গাজাবাসীর আশা–আকাঙ্ক্ষা ও শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে পারে।’

এই প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে যে কেউ যুক্তিসংগতভাবে বলতে পারে, ইসরায়েলের ইহুদিরা স্বেচ্ছায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে, বিশেষ করে জার্মানিতে চলে গিয়েছিল। সেখানে তাদের অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে।

● জোসেফ মাসাদ নিউইয়র্কের কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির আধুনিক আরব রাজনীতি এবং বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাস বিষয়ের অধ্যাপক

মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিতভাবে অনূদিত