দেশের স্বার্থে, জাতির স্বার্থে, উন্নয়নের স্বার্থে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র-ছাত্রীদের জড়ো হওয়ার সুযোগ কোনোমতেই দেওয়া যাবে না।
দেশের স্বার্থে, জাতির স্বার্থে, উন্নয়নের স্বার্থে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র-ছাত্রীদের জড়ো হওয়ার সুযোগ কোনোমতেই দেওয়া যাবে না।

সরকারের জন্য কিছু ‘অমূল্য’ হিতোপদেশ

মানুষের ন্যায্য দাবি মেনে না নেওয়ার অভ্যাস হয়ে গেছে সরকারের। কোটা সংস্কারে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এবং পরবর্তী পরিস্থিতিতেও আমরা তা-ই দেখছি।

সরকারকে অনেকে সদুপদেশ দিলেও তারা শোনে না, নাগরিক সমাজের সঙ্গে পরামর্শ করা তো দূরে থাক। এখন সরকার যে খাদের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে বরং কিছু হিতোপদেশ দেওয়া যেতে পারে। যদিও তাদের কাছে তা উল্টো উপদেশ মনে হতে পারে।

১. কথিত আন্দোলনকারীদের সর্বশেষ নয়টি দাবির একটিও মানা যাবে না। প্রথমে দাবি ছিল একটি, তারপর হলো চারটি, এরপর নয়টি, এরপর আটটি, এখন আবার নয়টি।
একটি দাবিও যদি মানা হয়, তাহলে দাবিদারেরা আশকারা পেয়ে হুট করে আরও নতুন ১০টি দাবি নিয়ে হইচই শুরু করে দেবে। তাই সরকারকে থাকতে হবে শক্ত অবস্থানে এবং একটি দাবিও মানা যাবে না।

২. আপিল বিভাগ বলেছেন যে কোটার ব্যাপারে সরকার এদিক-সেদিক করতে পারে। বিদ্যমান কোটার বাইরে ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী ও নেতাদের জন্য নতুন কোটার ব্যবস্থা করতে হবে।

আরও ভালো হয় ১৪ থেকে ২০তম গ্রেডে চাকরির অন্যান্য যোগ্যতার সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী ছিলেন, এ-সংক্রান্ত সার্টিফিকেট লাগবে।

আর ৯ থেকে ১৩তম গ্রেডের চাকরির জন্য তাঁদের নিজ নিজ কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কমিটির নেতৃত্বের পদে থাকার সার্টিফিকেট লাগবে। সার্টিফিকেটগুলো ইস্যু করবেন সংশ্লিষ্ট কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সভাপতি।

এই বন্দোবস্তে সভাপতিদের আর্থিক লাভ বৃদ্ধি পাবে এবং ছাত্রলীগের সদস্যসংখ্যাও হু হু করে বেড়ে যাবে।

৩. আওয়ামী লীগের আর্থিক লাভের জন্য যেসব ব্যক্তিরা নিজ নিজ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বরাবর আওয়ামী লীগের জন্য এক কোটি টাকা সাহায্য বা অনুদান প্রদান করবেন, বাংলাদেশ ব্যাংক তাঁদেরকে এক কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি প্রদান করবে।

এতে প্রথমত জেলা আওয়ামী লীগ আর্থিকভাবে লাভবান হবে, দ্বিতীয়ত বৈদেশিক মুদ্রা পাচার তো হচ্ছেই, কিন্তু সেটাকে একটা আইনি কাঠামোর মধ্যে আনা যাবে।

আর তৃতীয়ত, ‘মানি লন্ডারিং মানি লন্ডারিং’ বলে হইচই অনেক কমে যাবে।

৪. এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে সরকারের মাথাব্যথার অন্যতম প্রধান কারণ ফেসবুক। ফেসবুককে শায়েস্তা করতে হলে সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে এর নতুন নামকরণ করতে পারে ‘ শয়তানের বই’ হিসেবে।

প্রয়োজনে শয়তানের বইয়ের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এই আন্দোলনে ধার্মিক জগতের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সংযুক্ত করা যায় কি না, সেটা ধর্ম মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটিতে বিস্তারিত আলোচনা করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

শয়তানের বইয়ের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলনকে বেগবান করতে বাংলাদেশ সরকারের টেলিভিশন (সংক্ষেপে বাংলাদেশ টেলিভিশন) সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে।

‘ডিবি হারুন’ কে আর বিলম্ব না করে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) পদে পদোন্নতি দিতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে এই বলে যে মাননীয় মহামাননীয় আইজিপির সহায়সম্পদ নিয়ে কোনো সংবাদমাধ্যমে টুঁ শব্দটিও করা যাবে না।

৫. আগামী একনেক সভায় জরুরি ভিত্তিতে প্রতিটি জেলায় অন্তত পাঁচ হাজার বন্দীর ধারণক্ষমতাসম্পন্ন নতুন কারাগার স্থাপনের প্রজেক্ট পাস করতে হবে।

প্রতিটি কারাগারের জন্য খরচ নির্ধারণ করতে হবে প্রথমে ৫ হাজার কোটি টাকা করে এবং প্রতি ৬ মাস অন্তর ব্যয় বাড়িয়ে তা ২০ হাজার কোটি টাকায় নিয়ে যেতে হবে।
এ কারাগারগুলো স্থাপনের ঠিকাদার বা কনট্রাক্টর হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে আমাদের সংসদের মাননীয় শ দুয়েক ব্যবসায়ী সংসদ সদস্যকে।

এতে সরকারের প্রতি তাঁদের আনুগত্য রাতারাতি অনেক বেড়ে যাবে। বিপদে-আপদে হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যবসায় বলীয়ান হয়ে সরকারের পক্ষে প্রচুর লোকবল সহজেই জড়ো করতে পারবেন। তখন দেখব, কথিত আন্দোলনকারীরা ঠেলা কেমনে সামলায়।

৬. কিছু আইনি হিতোপদেশও অত্যন্ত জরুরি। আইনগত দিক দিয়ে নতুন কিছুই করতে হবে না। সেই ৫০ বছরের পুরোনো, অর্থাৎ ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনটি আবার দেদারে প্রয়োগ করতে হবে।

পাঠকেরা হয়তো ভুলে গেছেন যে এই আইনে সরকার যাঁকেই সন্দেহজনক মনে করে, তাঁকেই আটক করতে পারবে। এ জন্য মামলা করার দরকার হবে না, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে নেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই এবং এই আটকাদেশগুলো জামিনের অযোগ্য।

আইনেই বলা আছে যে প্রথমে দফায় ছয় মাসের জন্য আটক করা যাবে এবং এরপর আটকের মেয়াদ ছয় মাস ছয় মাস করে অনন্তকাল বৃদ্ধি করা যাবে। অপরাধ প্রমাণ করার জন্য সাক্ষীসাবুদও আনতে হবে। অর্থাৎ সরকারের ঝামেলা অনেক কমবে।
আর খুব বেশি জোরালো পদক্ষেপ হিসেবে হাইকোর্টের রিট ক্ষমতা বাতিলও করা যেতে পারে। এর জন্য অবশ্য সংবিধানের সংশোধন লাগবে।

রিট ক্ষমতা রহিত করার সংশোধন নতুন করে রচনা করতে হবে না, এটা ১৯৭৫ সালের সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী আইন থেকে হুবহু ‘টুকলিফাই’ করা যেতে পারে।

৭. ঝুটঝামেলার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ২০২৪ সালের শেষ পর্যন্ত বন্ধ তো অবশ্যই রাখতে হবে। দেশের স্বার্থে, জাতির স্বার্থে, উন্নয়নের স্বার্থে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র-ছাত্রীদের জড়ো হওয়ার সুযোগ কোনোমতেই দেওয়া যাবে না।

ছয় মাস পড়াশোনা না করলে আহামরি কোনো ক্ষতি হবে না। বরং শিক্ষক-কর্মচারীরা ছয় মাস ঘরে বসে বেতন-ভাতা পাওয়ার উল্লাসে ঢোল বাজাতে বাজাতে মিছিলেও নেমে যেতে পারেন। সেই মিছিলকে অবশ্যই বাধাগ্রস্ত করা যাবে না।

৮. গ্রেপ্তার-বাণিজ্য তো চলছেই; কেউ বলেন ৫ হাজার, কেউ বলেন ৭, ৮ বা ১০ হাজার ব্যক্তিকে ইতিমধ্যেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কমবেশি ২০ দিনে মাত্র ১০ হাজার—গ্রেপ্তারের এই গতিতে মোটেও সন্তুষ্ট হতে পারছি না।

গ্রেপ্তারের গতি বাড়াতে হবে। এত কষ্ট করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে গ্রেপ্তার না করে দেখামাত্রই গ্রেপ্তারের নতুন নীতি প্রয়োগ করলে সংখ্যাটা অতি সহজেই বাড়বে। সঙ্গে সঙ্গে বাড়বে গ্রেপ্তার-বাণিজ্য।

মনে রাখতে হবে, যেকোনো মূল্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সন্তুষ্ট রাখতে হবে।

‘ডিবি হারুন’ কে আর বিলম্ব না করে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) পদে পদোন্নতি দিতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে এই বলে যে মাননীয় মহামাননীয় আইজিপির সহায়সম্পদ নিয়ে কোনো সংবাদমাধ্যমে টুঁ শব্দটিও করা যাবে না।

পত্রিকা রিপোর্ট করলে পত্রিকার ডিক্লারেশন আপনা-আপনি বাতিল হয়ে যাবে এবং একই পরিণতি হবে টিভি ও অন্যান্য তথাকথিত সংবাদমাধ্যমগুলোর।

আমি আশাবাদী যে, সব কটি না হলেও সরকার ওপরের উপদেশগুলোর অন্তত কয়েকটি অবিলম্বে বাস্তবায়ন করবে।

  • ড. শাহদীন মালিক, অ্যাডভোকেট বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট এবং ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের আইনের শিক্ষক।