মতামত

সর্বনাশের আরেক নাম ‘ঘাস মারা বিষ’

ফসলের মাঠ, রাস্তার ধারের জঙ্গল, খেতের বা পুকুরের আলে গজানো ঘাসগুলোকে মেরে ফেলতে চিন্তাভাবনা ছাড়াই ‘বিষ’ ব্যবহার করা হচ্ছে। ব্যবহারের কোনো বিধিনিষেধ না থাকায় দোকানদারেরা সাধারণ পণ্যের মতো পৌঁছে দিচ্ছেন পরিবেশঘাতী এই বিষাক্ত পদার্থ। ‘ঘাস মারা বিষ’ নিয়ে লিখেছেন গওহার নঈম ওয়ারা

খুলনা–বাগেরহাট আসা–যাওয়ার পথে সুযোগ পেলে ভ্যাট্টেপাড়ায় (ভাটিয়াপাড়া) বিরতি নেওয়ার চেষ্টা করি। সেখানে এক প্রবীণ চা বিক্রেতা খুব আদর করে চা পরিবেশন করেন। চায়ের চেয়ে মন টানে তাঁর কথায়। কত খবর যে জমা থাকে তাঁর বুকে!! শুধু খেই ধরিয়ে দিলেই হলো। তিনিও জানতে চান, ‘কী ধান্দায় কোথায় মেলা করছি। কত দিনের সফর? ফেরার পথে রাত হবে কি না? তাড়া থাকলে একটা মিসড কল মাইরে দেবেন। সর (দুধের সর) উঠায়ে রাখব মালাই চা খাইয়ে যাবেন।’

এবার ফেরার পথে দেখি, সন্ধ্যার আগেই তাঁর দোকানের ঝাঁপ নামানো। খোঁজ নিতেই জানা গেল, তাদের গ্রামের একজন বিষ খেয়েছে, তাকে নিয়ে ছোটাছুটি চলছে। দোকান বন্ধ করে ছোটাছুটির দলের নেতৃত্ব দিতে গেছেন প্রবীণ চা বিক্রেতা। আমার মিসড কলের সূত্র ধরে রাত ১১টার দিকে ফোন করলেন প্রবীণ। তিনি তখনো রোগীর সঙ্গে মেডিকেলের পথে।

ফোনে তিনি জানালেন, ‘আমরা পদ্মা সেতুতে। মালা (ছদ্মনাম), পড়াশোনা না করে মোবাইল হাতড়াইতে ছিল। তাই বাবায় তারে বকা দেয়। আর তাতেই রাগ করে মালা ঘাস মারার বিষ গিলে ফেলে। মুমূর্ষু মালাকে নিয়ে এখন যমে মানুষের টানাটানি চলছে। অবস্থা কেরোসিন (আশঙ্কাজনক)। কচি বেডিডা বাঁচবে কি না কওয়া যাচ্ছে না।’

মুরব্বি প্রবীণ সাধারণত মুখ খারাপ করেন না। এবার করলেন, ধমকও দিলেন। তাঁর বোধে আসে না আমরা কী ‘ফ্যালাইতাছি’। আবার তাড়া দিলেন ‘ধান্দাবাজি’ না করে মানুষ ও মানুষের সমস্যা নিয়ে লেখার জন্য। তিনি প্রথম আলোর একজন গুণমুগ্ধ কিন্তু ছেড়ে কথা না বলা পাঠক।

প্রবীণের ধমক খেয়ে মনে পড়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নেফ্রোলজি বিভাগের ডা. মো. সাদ্দাত হোসেনের কথা। একটি জাতীয় দৈনিকে গত ১০ জুন ২০২৩ প্রকাশিত এক লেখায় তিনি বলেছিলেন,‘আগেও খেতে পোকামাকড় মারার বিষ (ইনসেক্টিসাইড) খেয়ে মানুষ আত্মহত্যা করার চেষ্টা করত।

বিশ্বাস করুন, যারা পোকামাকড় মারার বিষ খেয়ে আসত, তারা যদি কোনো হাসপাতালে পৌঁছাতে পারত, তবে তাদের শতকরা ৯৯ ভাগ রোগী ভালো হয়ে যেত। কিন্তু এই ঘাস মারার বিষ খেয়ে যারাই ভর্তি হচ্ছে, এটা এতটাই বিষাক্ত যে ওদের কাউকেই বাঁচানো সম্ভব হচ্ছে না।’

তিনি মানবদেহে এই বিষের প্রতিক্রিয়া ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লিখেছিলেন, ‘প্রথম দিকে এর প্রতিক্রিয়া তেমন অনুভূত হয় না। শুধু জিহ্বায় কিছু ঘা দেখা দেয়। এরপর আস্তে আস্তে অন্যান্য অঙ্গ বিকল হতে থাকে। প্রথমে কিডনি, তারপর লিভার, তারপর ফুসফুস। একপর্যায়ে এসে শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। শেষ মুহূর্তে লাইভ সাপোর্ট দেওয়া লাগে। লাইভ সাপোর্ট দেওয়ার পরও রোগীকে বাঁচানো যায় না। কারণ, ফুসফুস আক্রান্ত হয়ে ফাইব্রোসিস হয়ে যায়, যা আর কোনো চিকিৎসাই ভালো করা যায় না।’

শুধু মানুষ নয় গবাদি প্রাণীও বেঘোরে মারা যাচ্ছে

ঘাস মারা বিষের যথেচ্ছ ব্যবহারে গবাদি প্রাণীর মৃত্যু সংবাদের মর্যাদা হারিয়ে নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে। গত বছরের (২০২৩) সেপ্টেম্বরে কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার বেলগাছা ইউনিয়নের যুগীর ভিটা গ্রামে ছয়টি ছাগল ঘাস খেতে খেতে মারা যায়। কাউকে না জানিয়ে পুকুরের পাড়ে ঘাসে কীটনাশক ছিটিয়ে দিয়েছিলেন পুকুরের মালিক রিন্টু মিয়া। সেই ঘাস খেয়ে ছাগলগুলো মারা যায়। ঘাস খাওয়ার একপর্যায়ে ছাগলগুলো হঠাৎ নিস্তেজ হয়ে মাটিতে পড়ে যায়। পরে স্থানীয় লোকজন ছাগলগুলো বাড়িতে নিয়ে এলে চারটি ছাগল মারা যায়। আর দুটি ছাগল দ্রুত জবাই করা হয়।

এর আগে ঝিনাইদহের শৈলকূপার ভুলুন্দিয়া গ্রাম থেকে বিষাক্ত ঘাস খেয়ে গরু মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটে। শুধু ভুলুন্দিয়া গ্রাম নয়, দিন পনরোর ব্যবধানে পার্শ্ববর্তী কয়েক গ্রাম মিলে কমপক্ষে ১২টি গরু মারা যায়।

মানুষ ও গবাদি প্রাণীর অকাল মৃত্যুর চেয়ে এই ঘাস মারা বিষ প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্টের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নাম না–জানা এক তরুণ কৃষক সব দেখেশুনে ছড়া বেঁধেছেন—

ঘাস মারা বিষ,

পাখিরা দেয় না শিস।

মারা যায় মাটির সব পতঙ্গ, কীট 

বেঁচে থাকার অনুষঙ্গ সকল জীব।

সারা দেশে কৃষিজমিতে আগাছানাশকের ব্যবহার বাড়ছে। জমি প্রস্তুত করার আগে আগাছা দমন করা জরুরি। ফসলের মাঠ, রাস্তার ধারের জঙ্গল, খেতের বা পুকুরের আলে গজানো ঘাসগুলোকে মেরে ফেলতে চিন্তাভাবনা ছাড়াই এটি ব্যবহার করছে। ফলে জমির উর্বরতা কমে যাচ্ছে।

আগে আগাছা দমন করে সেগুলো খেতের পাশে স্তূপ করে রাখা হতো। পরে চাষের সময় সেগুলো মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হতো। ফলে ফসলের জমির উর্বরতা ও অণুজীবের সংখ্যা বৃদ্ধি পেত। বর্তমানে আগাছা দমনে অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের ফলে সেগুলো পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। সময় ও খরচ কমার সঙ্গে সঙ্গে মাটির ভৌত গুণাগুণ হ্রাস পাচ্ছে, আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে মাটিতে অণুজীবের সংখ্যা, যা মাটির স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।

এসব কারণে মাটির উর্বরতা কমছে দিনের পর দিন। ফলে অনেক চেষ্টা করেও ফসলের কাঙ্ক্ষিত ফলন মিলছে না। মাঠে গবাদিপশুর জন্য কাঁচা ঘাস বিষের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে গোচারণভূমি। যখন বিষ দেওয়া হচ্ছে, তখন পাখি, পোকামাকড় যা-ই এই বিষের ওপর বসুক না কেন বা খাবার গ্রহণ করুক না কেন, তারই মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে। নিস্তার নেই জলজ ও স্থলজ জীবন চক্রের ছোট–বড় পাখিজাতীয় প্রাণীর।

হাজারো কীটপতঙ্গ আছে, যারা উদ্ভিদ খেয়ে বেঁচে থাকে আর সাপ, ব্যাঙ, শিয়াল, বনবিড়ালসহ আরও নানা রকম প্রাণী আবার এসব ছোট কীটপতঙ্গ খেয়ে বেঁচে থাকে। তাই ঘাস যদি হারিয়ে যায়, তাহলে এসব প্রাণীর সংখ্যাও দিন দিন হারিয়ে যাবে। কেঁচো, শামুকের মতো উপকারী অনেক প্রাণীর বেঁচে থাকার আশ্রয় ক্রমেই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। মাটিতে এই বিষ অধিক মাত্রায় ব্যবহার করার ফলে যেসব পাখি নানা রকম ঘাসের বীজ খেয়ে ও লতা বা গুল্মের ফল খেয়ে জীবন ধারণ করে থাকে, তাদেরও খাদ্যের সংকট দেখা দিতে পারে।

আমাদের দেশীয় ও পরিযায়ী পাখি নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এই বিষক্রিয়ার ফলে। বন্য প্রাণীদের খাদ্যের সংকট দেখা দেওয়ার পাশাপাশি তাদের বাসস্থানের ক্ষেত্রেও সংকট দেখা দেবে। কারণ, এসব প্রাণী ছোট ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে থাকে বা ঝোপের নিচে গর্ত করে বসবাস করে। কিন্তু বিষ প্রয়োগের ফলে ঝোপের সংখ্যা ক্রমেই কমে যাচ্ছে, যার ফলে বন্য প্রাণীও পড়ছে বাসস্থানের সংকটে।

হারিয়ে যাচ্ছে প্রাকৃতিক খাদ্যভান্ডার

দেশের অনেক মানুষ এখনো প্রকৃতিতে কুড়িয়ে পাওয়া শাক, নানা রকম সবজি শস্যদানা সংগ্রহ করে খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা মিটিয়ে থাকেন। অনেকে, বিশেষ করে প্রান্তিক নারীরা এগুলো সংগ্রহ করে হাটবাজারে বিক্রি করেন। জীবিকার এটাও একটা পথ। কিন্তু এই বিষ ব্যবহারের ফলে সেসব পথ ক্রমেই রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। প্রাকৃতিক এসব খাদ্যভান্ডার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন হাজারো মানুষ। এতে দেখা দেবে পুষ্টির ঘাটতিও।

প্রকৃতিতে কুড়িয়ে পাওয়া খাদ্য শুধু মানুষের খাবার হিসেবে নয়, বরং এর নানান ঔষধিগুণের কারণে গ্রহণ করে থাকেন। কিন্তু রাস্তার ধারেই হোক বা পুকুরের পাড়েই—সব জায়গায় এখন বিষ ছিটানো হচ্ছে। ফলে ‘দুষ্প্রাপ্য’ হয়ে পড়ছে এসব নিখরচার অমূল্য খাদ্যসামগ্রী।

তারপরও এই বিষ কেন এত জনপ্রিয়

ফসলের জন্য জমি তৈরির আগে আগাছা দমন করা জরুরি। জমিতে ধান কাটার পরে প্রচুর পরিমাণে আগাছা জন্মায়। হাল আমলে শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি ও শ্রমিকের অভাবের কারণে কৃষকেরা আগাছানাশক ব্যবহারে ঝুঁকছে। এক বিঘা জমির আগাছা দমন করতে হলে এলাকাভেদে ১৫ থেকে ২০ জন শ্রমিক লাগে। সেখানে ১৮০ টাকার বিষ দিলেই আগাছা পুড়ে যাচ্ছে। সকালে বিষ দিলে বিকেলেই মরে যাচ্ছে আগাছা। ফলে কম খরচে আগাছা দমনের সুযোগ কেউ হাতছাড়া করতে রাজি নন।

কৃষক জানেন, আগাছা হাতে তুলে মাটিতে পুঁতে দিলে মাটির উর্বরতা বাড়ে, তবে তাতে খরচ বেশি। যেভাবেই হোক খরচ তাকে কমাতে হবে। সবকিছুর খরচ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জমির মালিকের আগাম বায়নার হার। আগে যে জমি এক সনের জন্য পাঁচ হাজার টাকা আগাম দিতে হতো, এখন সেখানে দিতে হয় ১৫ হাজার টাকা। উর্বরতার জন্য জমির ‘কান্না’ তাই এখন আর কৃষককে নাড়া দেয় না। কৃষক জানেন, ধানখেতে আগে যে রকম মাছ পাওয়া যেত, এখন আর পাওয়া যায় না। কমে গেছে ব্যাঙ প্রজাতি, হারাচ্ছে জলজ প্রাণীও।

জনপ্রিয়তার দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে এই বিষের দারুণ কার্যকারিতা। মানে এই বিষ ব্যবহার করলে সব ধরনের উদ্ভিদ খুব সহজে মারা যায়। এমনভাবে মারা যায় যে খুব দ্রুত এই মারা যাওয়া উদ্ভিদ গজাতেও পারে না। ঝোপজাতীয়, লতানো বা ছোট গাছ সব ধরনের উদ্ভিদের ক্ষেত্রে সমানভাবে কার্যকরী এই বিষ। তাই ভিন্ন ভিন্ন উদ্ভিদ নিধনের জন্য আলাদা আলাদা কোনো ব্যবস্থা নিতে হয় না। এর ফলে কৃষকেরা এই বিষ ব্যবহারে আরও উৎসাহী হয়ে উঠছেন।

তৃতীয় কারণ হচ্ছে সহজলভ্যতা। এই বিষ খুবই সহজে পাওয়া যায় যেকোনো হাটবাজারে। ব্যবহারের কোনো বিধিনিষেধ না থাকায় দোকানদাররা মানুষের কাছে সাধারণ পণ্যের মতো পৌঁছে দিচ্ছেন পরিবেশঘাতী বিষাক্ত পদার্থ।

বিষ থেকে বাঁচার উপায় কী

শ্রীলঙ্কাসহ পৃথিবীর ৩১টি দেশে এটি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আমরা সবাই সচেতন হয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার মাধ্যমে এই ঘাস মারার বিষ ব্যবহার বন্ধ করে দিতে পারি। ঘাস মারার বিষ বেচাকেনা নিষিদ্ধ করলে সস্তায় আগাছা মারার পথ বন্ধ হবে, কিন্তু লাভটা হবে অনেক। সেই সঙ্গে বিকল্প পথে আগাছা নিরোধের সনাতন পদ্ধতিগুলো গবেষণার মাধ্যমে জনপ্রিয় করার ব্যবস্থা করতে হবে।

আগাছার প্রাকৃতিক শত্রু বিভিন্ন রোগ, পোকা অথবা অন্যান্য প্রাণীর মাধ্যমেও আগাছা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। দুধিকানি, বিছুটি, ঘেঁটু হলদের মতো ফসলের ক্ষতিকর আগাছাকে মোজাইক ভাইরাস জব্দ করতে পারে।

বিশেষ এক শ্রেণির স্পাইডার মাইট খেতের আগাছা উত্তম উপায়ে দমন করতে সক্ষম। বাজারেও বিভিন্ন রকমের জৈব আগাছা নিয়ন্ত্রণ আজকাল পাওয়া যাচ্ছে। সেগুলো ব্যবহার করেও সফলতার সঙ্গে আগাছা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।

লাঙল, উইডার, কালটিভেটর ইত্যাদির মাধ্যমেও আগাছা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। জৈব ও অজৈব দুই ধরনের উপাদান দিয়ে মালচিং করেও আগাছার প্রকোপ থেকে রেহাই পাওয়া যেতে পারে। জৈব উপাদান যেমন খড়, কচুরিপানা, শুকনা পাতা, তুষ, ভুসি ইত্যাদি ও অজৈব উপাদানের মধ্যে প্লাস্টিক ফিল্ম ও বিভিন্ন রঙের পলিথিন দিয়েও মালচিং করা হয়ে থাকে। বিষ থেকে দেশকে রক্ষাটা সবচেয়ে জরুরি।

  • গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক