যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী হাজার হাজার মানুষকে হত্যার সঙ্গে জড়িত। তবে মার্কিন সহায়তায় ইসরায়েলের করা গণহত্যা এখন ‘লাইভ স্ট্রিম’ হচ্ছে।
বিশ্ব এবার কী করে চোখ বুজে থাকবে? এককালে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে এক কল্যাণকর সাম্রাজ্য হিসেবে তুলে ধরত। ৯/১১-এর পর তাদের যুদ্ধের চেহারা পাল্টেছে।
এখনো সে গণহত্যার অস্ত্র উৎপাদন করে, টাকা জোগায়। তার মরমি পতন গিয়ে তলানিতে ঠেকেছে।
গাজায় দখলদারির বর্বরতা নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মনোযোগী, আবার একই সঙ্গে নিষ্ক্রিয়। এসবের সঙ্গে ধর্মীয় প্রভাব জড়িত, সন্দেহ নেই। মুসলমানরা ফিলিস্তিনকে পবিত্র ভূমি হিসেবে শ্রদ্ধা করেন, যেমন করেন ইহুদি ও খ্রিষ্টানরা।
এর ঐতিহাসিক বিশেষত্বও রয়েছে। আছে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলের দখলদারির সাত দশকের বেশি ইতিহাস। পশ্চিম তীরে অবৈধ ইসরায়েলি বসতি নির্মাণের পাশাপাশি ইসরায়েলি মানবাধিকার লঙ্ঘনের তালিকা প্রতিদিনই দীর্ঘ হচ্ছে।
আজকাল এই গণহত্যার প্রতিটি ঘটনা সরাসরি সম্প্রচার করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক আদালতের দক্ষিণ আফ্রিকা অংশের উপদেষ্টা ব্লিনে নি ঘ্রালাই বলেছেন, ‘এটি ইতিহাসের প্রথম গণহত্যা, যেখানে আক্রান্ত ব্যক্তিরা নিজেদের মৃত্যু সরাসরি সম্প্রচার করছে।’
আফগানিস্তান এবং পরবর্তী সময়ে ইরাকে মার্কিন সামরিক যন্ত্রের শিকার ব্যক্তিরা যদি তাঁদের নিজেদের মৃত্যু ও ধ্বংসকে লাইভ স্ট্রিম করতে পারতেন, তাহলে?
যুক্তরাষ্ট্র কত গণহত্যা আড়ালে থেকে করেছে আর কতগুলো নিজে করেছে সরাসরি?
২০২০ সালে তথ্য স্বাধীনতা আইনের অধীনে নিউইয়র্ক পত্রিকা ২০০৫ সালের হাদিথা গণহত্যা নিয়ে ছবি খুঁজতে গিয়ে শেষে নৌবাহিনী, মেরিন কর্পস ও ইউএস সেন্ট্রাল কমান্ডের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল। হাদিথায় মার্কিন মেরিনরা হত্যা করেছিলেন ২৪ বেসামরিক ইরাকি পুরুষ, নারী ও শিশু।
নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সী ছিল তিন বছরের একটি মেয়ে এবং আবদুল্লাহ নামে চার বছরের একটি ছেলে। ছয় ফুট দূর থেকে ওদের মাথায় গুলি করা হয়েছিল।
দীর্ঘ চার বছর আইনি লড়াইয়ের পর গত মার্চে ইউএস সেনাবাহিনী সেই রক্তস্নাত হত্যাযজ্ঞের ছবি প্রকাশ করে। অপরাধীরা শাস্তির বাইরেই থেকে যায়।
হাদিথা হত্যাকাণ্ড শুধু ইরাকে মার্কিন দখলদারির নয়, বরং কৃত্রিম পরিবর্তন আনার পশ্চিমাদের বর্বর প্রয়াস, স্থানীয় জনগণের খরচে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থরক্ষা এবং মুসলিম বিশ্বে তার ইচ্ছা চাপিয়ে দেওয়ার নৃশংস প্রচেষ্টার একটি ছোট্ট নজির।
মিডল ইস্ট আই-এর প্রধান সম্পাদক ডেভিড হার্স্ট আল–জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে গাজার জটিল পরিস্থিতি নিয়ে বলতে গিয়ে পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থাকে তীব্র আক্রমণ করেছেন। তিনি বলেছিলেন, ‘গত তিন দশকে পশ্চিমা (উদারপন্থী) জোট যা করছে, তার কিছুই কার্যকর হয়নি। তবু একই রকম কাজ তারা করেই যাচ্ছে।’
আফগানিস্তান ও ইরাকের চিরন্তন যুদ্ধ থেকে শুরু করে ইয়েমেন, পাকিস্তান ও সোমালিয়ায় ড্রোন দিয়ে আক্রমণ চালানো বারাক ওবামার ‘নো বুট অন গ্রাউন্ড’ যুক্তরাষ্ট্রের মরমি মৃত্যুকে আরও নিশ্চিত করেছে।
এ কেবল হত্যা এবং ধ্বংস নয়, এর সঙ্গে আছে ঔদ্ধত্য আর ভণ্ডামি।
ইসরায়েলের মার্কিন নাগরিকদের হত্যার বিষয়ে কয়েক দশক ধরে নীরব। স্টেট ডিপার্টমেন্ট তার নিজের নাগরিকদের হত্যা নিয়েও কথা বলতে চায় না। এই সপ্তাহে ইসরায়েলি বাহিনী ২৬ বছর বয়সী আয়েসনুরকে গুলি করে হত্যা করেছে। তুর্কি-মার্কিন আয়েসনুর বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন নাবলুসের দক্ষিণে অবৈধ ইসরায়েলি বসতির বিরুদ্ধে।
গাজার হাসপাতাল, মসজিদ, গির্জা ও ৫০০টির বেশি স্কুলে যে বোমা ফেলা হয়েছে, সেগুলো মূলত যুক্তরাষ্ট্রের। ইসরায়েলি যুদ্ধাপরাধ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতি মার্কিন সমর্থনই এই দখলদারকে তার চলমান গণহত্যা চালিয়ে যেতে দিচ্ছে।
ইসরায়েলি সন্ত্রাস টিকে থাকে প্রায়ই তার নিজের নাগরিকদের প্রাণের বিনিময়ে। এ সবকিছু মিলে যুক্তরাষ্ট্রের মরমি মৃত্যুর কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিচ্ছে।
২০০৩ সালে র্যাচেল কোরি নামের ২৩ বছর বয়সী মার্কিন রাজনৈতিক কর্মী গাজায় ইসরায়েলি বুলডোজারে পিষ্ট হয়ে মারা যান। বুলডোজারটি ছিল প্রতিরক্ষা কার্যক্রমের অধীনে আমেরিকানদের কাছ থেকে কেনা।
ইসরায়েলের মার্কিন নাগরিকদের হত্যার বিষয়ে কয়েক দশক ধরে নীরব। স্টেট ডিপার্টমেন্ট তার নিজের নাগরিকদের হত্যা নিয়েও কথা বলতে চায় না।
এই সপ্তাহে ইসরায়েলি বাহিনী ২৬ বছর বয়সী আয়েসনুরকে গুলি করে হত্যা করেছে। তুর্কি-মার্কিন আয়েসনুর বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন নাবলুসের দক্ষিণে অবৈধ ইসরায়েলি বসতির বিরুদ্ধে।
ইসরায়েলি কর্মকর্তারা বলেছেন যে তাঁরা ‘বিষয়টি দেখবেন’। এই একই হতাশাজনক প্রতিক্রিয়া কয়েক দশক ধরে প্রতিধ্বনিত হয়ে আসছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়াও একই থাকবে। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বিষয়টা এড়িয়ে যাবে তারা।
ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি দখলদারির ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র কোনো সালিসকারী নয়, পক্ষপাতহীন কণ্ঠস্বর তো নয়ই। যুক্তরাষ্ট্র হলো এই সমস্যা টিকে থাকার অন্যতম কারণ।
গাজা গণহত্যা যুক্তরাষ্ট্র ঘটিয়েছে। মার্কিন নাগরিকেরা কি তাঁদের নামে ঘটা এই হত্যাকাণ্ডের দায় নেবেন?
● ওমর সুলেমান সাউদার্ন মেথডিস্ট ইউনিভার্সিটির ইসলামিক স্টাডিজের সহযোগী অধ্যাপক