মতামত

আউটসোর্সিং: তথ্যপ্রযুক্তি খাতে সংস্কৃতির সঙ্গে ‘কালচার’ মিলছে না

ইউরোপের কোনো একটা শহরের কথা ধরা যাক। সেখানকার রাস্তায় কয়েক হাজার সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো আছে। রাস্তায় কোনো ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয়েছে কি না, সেটি এই সিসিটিভি ফুটেজ দেখে বের করতে হবে। অথবা ধরা যাক, সেখানকার কোনো প্রতিষ্ঠানের শত–সহস্র ছবি সম্পাদনার কাজ, পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা অনুবাদ কিংবা কি-বোর্ডে টাইপ করে সফটওয়্যারে ইনপুট দেওয়ার কাজের কথা। ইউরোপে বসে যে মানুষগুলো এ কাজগুলো করবেন, তাঁদের মোটা অঙ্কের টাকা দেওয়ার প্রয়োজন পড়বে। কিন্তু এই কাজ ইউরোপে বসে করতে হবে, এমন তো কোনো কথা নেই। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে একই কাজ কম খরচের বাইরের দেশ থেকেই করিয়ে নেওয়া যায়।

এভাবে প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের অংশবিশেষ অন্য কাউকে দিয়ে করিয়ে নেওয়াটাকে বিস্তৃত অর্থে বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং (বিপিও) বলা যেতে পারে। আর্থিক লাভ ছাড়াও এতে প্রতিষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন বিকল্প থাকায়, পছন্দ অনুযায়ী জায়গা থেকে মানসম্পন্ন সেবা পাওয়ার সুযোগ থাকে। ব্যবসার মূল অংশে গুরুত্ব দিয়ে আনুষঙ্গিক কাজগুলো বাইরের কোনো পক্ষকে দিয়ে করিয়ে নিতে পারে। 

ডেলয়েট গ্লোবাল আউটসোর্সিং জরিপ ২০২২ অনুযায়ী, ৫২ শতাংশ নির্বাহী তাঁদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম আউটসোর্স করে থাকেন। আর তথ্যপ্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম আউটসোর্স করেন শতকরা ৭৬ ভাগ নির্বাহী। আউটসোর্স করা ব্যবসায়িক কার্যক্রমের মধ্যে প্রথম পাঁচটি হলো আইনি, কর, মানবসম্পদ, আর্থিক ও ক্রয়সংক্রান্ত কার্যক্রম।

তথ্যপ্রযুক্তি সেবা খাতের প্রথম পাঁচটি হলো সাইবার সিকিউরিটি, অ্যাপ/সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, আইটি অবকাঠামো পরিষেবা, পরবর্তী প্রজন্মের প্রযুক্তি ও ডেটা বিশ্লেষণ। এ ছাড়া গ্রাহকসেবা, কল সেন্টার, অ্যাকাউন্টিং, ডিজিটাল মার্কেটিং, গ্রাফিকস ডিজাইন, অ্যানিমেশনসহ নানা কাজ হচ্ছে বিপিওর মাধ্যমে। স্ট্যাটিস্টার রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বিপিও খাতের বাজার ৩৫০ বিলিয়ন ডলার, যেটি ২০২৮ সালের মধ্যে ৪৪০ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে পৌঁছাবে। আর্থিক সুবিধাদি, দক্ষ জনবল, ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে আউটসোর্সিংয়ের উপযুক্ত দেশের র‍্যাঙ্কিং করে থাকে কিয়ার্নি।

কিয়ার্নির গ্লোবাল সার্ভিস লোকেশন ইনডেক্স ২০১৯ অনুযায়ী, তালিকার প্রথমে আছে প্রতিবেশী দেশ ভারত। আমাদের অবস্থান ৩২তম। ভারত ২০২১-২২ অর্থবছরে তথ্যপ্রযুক্তি সেবা খাতে রপ্তানি করেছে ১০৬ বিলিয়ন ডলার এবং বিপিও খাতে করেছে ৫১ বিলিয়ন ডলার। অথচ প্রণোদনা-উন্মাদনা সব দিয়েও ১ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করতে আমাদের মাথার ঘাম পায়ে এসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। রিপোর্ট অনুযায়ী, বিভিন্ন বিবেচনায় আমরা ভারতের কাছাকাছি নম্বর পেলেও যে জায়গায় তাদের অর্ধেক নম্বরও পাইনি, সেটি হলো ‘দক্ষ জনবল’। এ ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে ব্যর্থ হয়েছি আমরা।

মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা এনে, অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রেখেছেন এ দেশের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। লিখে রাখেন এই ভবিষ্যদ্বাণী, এ দেশের সম্ভাবনাময় তথ্যপ্রযুক্তি খাতও তথাকথিত উচ্চতর ডিগ্রিবিহীন এই সাধারণ মানুষেরাই বাঁচিয়ে রাখবে। 

আমাদের দেশের যে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আছে, সেগুলো দেশের অভ্যন্তরে জনবল সরবরাহ করছে। বৈদেশিক মুদ্রার ক্ষেত্রে সাধারণ জনগণই মূল ভূমিকা রাখছে। রপ্তানির প্রধান দুটি খাত তৈরি পোশাকশিল্প ও জনশক্তি রপ্তানির কোনোটিই উচ্চশিক্ষা–সংশ্লিষ্ট নয়। আমাদের মতো জনবহুল দেশে জনসংখ্যাকে কাজে লাগিয়েই পরিকল্পনা করতে পারলে সেটি ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। 

আমরা চাইলেও প্রতিনিয়ত হাজার হাজার সফটওয়্যার ডেভেলপার বানাতে পারব না। কিন্তু আমরা চাইলে স্বল্পমেয়াদি ট্রেনিং দিয়ে বিপিও ইন্ডাস্ট্রি উপযোগী হাজার হাজার দক্ষ জনবল তৈরি করতে পারব। ঠিক যেমন আমরা জনমিতিক সুবিধা নিয়ে পোশাক আর জনশক্তি রপ্তানি করে সফলভাবে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারছি। বিপিওর মাধ্যমে আমরা একই ধরনের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে পারি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মধ্যপ্রাচ্যে আমরা শুধু জনশক্তি রপ্তানি করব কেন, আমাদের যে বিশালসংখ্যক জনগোষ্ঠীর আরবি ভাষার ওপর দক্ষতা আছে, সেটি কাজে লাগাতে পারলে আমরা আরবি ভাষার অনুবাদ, টাইপিং, রিডিং ইত্যাদি সেবা দিয়ে দেশে বসেই আয় করতে পারব। 

কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে অনুমোদিত ৩৪টি কারিকুলাম দেশের ১০ হাজার ৮৫৬টি সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিচালিত হচ্ছে। এসব শিক্ষাক্রমে ২০২১-২২ অর্থবছরে নিবন্ধনকৃত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৬ লাখ ৬৫ হাজার ৫৮৮ জন, যার মধ্যে শতকরা ২৮ ভাগ ছাত্রী। মাধ্যমিক স্তরে অধ্যয়নরত মোট শিক্ষার্থীর ১৭ দশমিক ২৫ ভাগ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে অধ্যয়নরত। অর্থাৎ এখানে অধ্যয়ন করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, মান নিয়ে, তারা প্রকৃত অর্থে দক্ষ হতে পারছে কি না।

বিপিও খাতের স্বল্পমেয়াদি ট্রেনিং দেওয়ার জন্য, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের যে অবকাঠামো আছে, সেগুলোকে কাজে লাগানো সম্ভব। নতুন অবকাঠামো সৃষ্টিতে প্রচুর বিনিয়োগ না করে, প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্ব বাড়িয়ে, বিদ্যমান অবকাঠামোর সংস্কার করেই দক্ষ জনবল তৈরি সম্ভব।

তবে দেশের তথ্যপ্রযুক্তির যে ‘কালচার’ গড়ে উঠেছে, কাজের বিবেচনায় তার সঙ্গে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের ‘সংস্কৃতি’র পার্থক্য আছে। একই দেশের ভেতর গড়ে ওঠা ভিন্ন ধারা—একটা কালচার, অন্যটা সংস্কৃতি। এই ভিন্নতা দূর করে একসঙ্গে এগোতে হবে।

পাঁচ তারকা হোটেলে বসে উপজেলা শহরের জন্য নীতি হয়তো তৈরি করা যায়, কিন্তু সেটিকে ফলপ্রসূ করা যায় না। মাঠে নামতে হয়, সাংগঠনিক কাঠামোতে স্যুট-টাই পরা এক্সিকিউটিভ ‘মেম্বার’–এর সঙ্গে সঙ্গে খদ্দরের জামা পরা ইউনিয়ন পর্যায়ের ‘সদস্য’কেও রাখতে হয়, তাঁদের কথা শুনতে হবে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা এনে, অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রেখেছেন এ দেশের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। লিখে রাখেন এই ভবিষ্যদ্বাণী, এ দেশের সম্ভাবনাময় তথ্যপ্রযুক্তি খাতও তথাকথিত উচ্চতর ডিগ্রিবিহীন এই সাধারণ মানুষেরাই বাঁচিয়ে রাখবে। 

বি এম মইনুল হোসেন অধ্যাপক, তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

bmmainul@du.ac.bd