প্রায়ই ফিরে যাই ৮ বছর আগের এক ঐতিহাসিক মুহূর্তে। প্রথম আলো অফিসে আমরা সবাই খুব ব্যস্ত। নতুন ম্যাগাজিন বিজ্ঞানচিন্তা প্রকাশিত হবে। বিজ্ঞানবিষয়ক ম্যাগাজিন। কতটা জনপ্রিয় হবে! দীর্ঘ আট বছর পেরিয়ে এসেছি। এখন নতুন পর্বে পা রাখছে আমাদের বিজ্ঞানচিন্তা।
মনে পড়ে স্কুল জীবনের একটি ঘটনা। আমি তখন বেশ ছোট। ক্লাস সেভেন বা এইটে পড়ি। ১৯৬০–১৯৬৫ সালের কথা। গণিতের স্যার পড়া ধরছেন। ২০ থেকে ৩০-এর ঘরের নামতা শিখে আসার কথা। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ২৩ × ২৫ = ? মনে করতে পারলাম না। শাস্তি হিসেবে বললেন, ‘বাইরের বারান্দায় নিল–ডাউন!’
ক্লাসের অন্যদেরও একই অবস্থা। সবাই বাইরে ‘নিল–ডাউন’। তখন এটাই ছিল সাধারণ শাস্তি। অবশ্য কিছুক্ষণ পর আবার একটু সহজ নামতা ধরলেন। প্রথম প্রশ্নেই আমি পাশ! ফিরে এলাম ক্লাসে। পরে একে একে আমাদের প্রায় সবাই পাশ।
পরদিন ক্লাসে স্যার বললেন, ‘আমি একটা স্বপ্ন দেখেছি।’ আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘তুমি বড় হয়ে বিজ্ঞানী হবে।’ সেই প্রথম আমি বিজ্ঞানী হওয়ার কথা শুনলাম। কথাটা আমার মনে গেঁথে গেল। সে যুগে অবশ্য বিজ্ঞান নিয়ে কেউ খুব বেশি চিন্তা করত না। কিন্তু আমি সবসময় ভাবতাম।
আজ বিজ্ঞানচিন্তা ম্যাগাজিনের সম্পাদক হয়ে মনে হয়, সেই ছোট বেলা থেকেই আমরা অনেকেই হয়তো বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহী হয়েছি। এখন ডিজিটাল বিজ্ঞানের যুগ। তরুণদের প্রায় সবাই বিজ্ঞানে আগ্রহী। আর তা ছাড়া এখন তো বিজ্ঞান শুধু পদার্থবিজ্ঞান বা রসায়ন নয়; ইতিহাস, ভূগোল, ভাষা—সবই তো বিজ্ঞান। বিজ্ঞান ছাড়া জীবন অচল। প্রায় সবকিছু কম্পিউটারে চলে। মোবাইল ফোন ছাড়া জীবন বলা যায় অচল।
তাই বলব, বিজ্ঞানচিন্তা—বলা যায়—এ যুগের তরুণদের প্রায় সবার জন্য অপরিহার্য।
অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর কথা প্রায়ই মনে পড়ে। তিনি প্রথম থেকেই সবার কাছে বিজ্ঞানচিন্তা ম্যাগাজিনের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য বিশেষ অবদান রেখেছেন। বুয়েট, ব্র্যাক ও এরপর এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সময়ে ভিসি হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বিজ্ঞানচিন্তাকে তরুণদের কাছে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য তিনি গভীর মনোযোগ দিয়েছেন। গণিত অলিম্পিয়াড কমিটিতেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতেন।
একদিন জামিল স্যারকে জিজ্ঞেস করলাম, এত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি কীভাবে গণিত–বিজ্ঞান নিয়ে সময় দেন। তিনি বললেন, আজকাল চলাফেরার সময় পথে যানজটে আটকে যাই। তখন চিন্তা করি, সামনের গাড়িটির নম্বর কত! সেই সংখ্যাটির সম্ভাব্য দুটি উৎপাদক বের করি। সংখ্যা দুটির যোগফল ও বিয়োগফল বের করি। ... গুণ করি ... । শেষ পর্যন্ত সংখ্যা দুটির বর্গফল ...। তিনি জানালেন, সব হিসাব করেন মনে মনে ...। যানজটের মধ্যেই গাড়িতে বসে তিনি এভাবে বড় বড় গাণিতিক সমস্যার সমাধান বের করে ফেলতেন। তাঁর এ ধরনের কথাগুলো আমাদের উজ্জীবিত করত। আমরা বিজ্ঞান–গণিতের প্রতি আরও আগ্রহী হয়ে উঠতাম।
আমরা বলতে পারি, আজকের দিনে তরুণদের হাতে হাতে থাকবে বিজ্ঞানচিন্তা ম্যাগাজিনটি। সবার জীবন আরও উন্নত ও সুন্দর করে তোলার জন্য ম্যাগাজিনটি কাজ করে যাবে, আমরা সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে এগোব, এটাই আমার চাওয়া।
আব্দুল কাইয়ুম বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদক