মতামত

ভোট নতুন রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে এল নেপালে

নেপালের এবারের নির্বাচনের অঘটন একটাই, তা হলো নতুন একটা দল ‘রাষ্ট্রীয় স্বতন্ত্র পার্টি’র উত্থান
ছবি: রয়টার্স

রাজনীতি বরাবরই অসম্ভবের শিল্পকলা। সর্বশেষ নেপালের নির্বাচনের কথাই ধরা যাক। নির্বাচনী ফলে তুলনামূলকভাবে ভালো করেছে মধ্যপন্থী নেপালি কংগ্রেস। একক দল হিসেবে এগিয়ে আছে তারা। দ্বিতীয় হয়েছে ‘ইউএমএল’ নামের কমিউনিস্ট পার্টি। বড় ব্যবধানে তৃতীয় হয়েছে ‘মাওবাদী’ নামে পরিচিত আরেক কমিউনিস্ট দল। কিন্তু কাঠমান্ডুতে গুঞ্জন আছে, নেপালে এবার মাওবাদী দলের নেতা পুষ্পকুমার দহলও প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন। কিংবা আরও ছোট কোনো দলের কেউ। সাধারণ বিবেচনায় এটা বিস্ময়কর। কিন্তু রাজনীতির পাটিগণিতে সেটা সম্ভব। সেই সম্ভাব্য ‘অসম্ভব’-এর যোগসূত্র রয়েছে নেপালের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ছাড়িয়ে ভূরাজনীতিতেও।

ভোটের ফল পেতে বিলম্ব যে কারণে

নেপাল ছোট দেশ। কিন্তু নির্বাচনী চূড়ান্ত ফল পেতে সব সময় দেরি হয়। ব্যালট গণনা এবং পাহাড়ি দূরদূরান্ত থেকে কাঠমান্ডুতে ফল আসতে সপ্তাহ গড়িয়ে যায়। গত ২০ নভেম্বরের গণনাও চূড়ান্ত হবে কেবল মাস শেষে। ভোট গণনা শেষে আসনের চূড়ান্ত হিসাব পেতে আরও সময় লাগবে। এই বিলম্ব এবং জটিলতা মূলত দেশটির নির্বাচনী পদ্ধতির বিশেষ ধরনের কারণে।

ফেডারেল পার্লামেন্ট এখানে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট। নিম্নকক্ষের নাম প্রতিনিধিসভা, অন্যটা রাষ্ট্রীয় সভা। এ ছাড়া দেশটিতে রয়েছে সাতটি প্রাদেশিক সভা। প্রাদেশিক সভার প্রতিনিধিরাও নির্বাচিত। দেশটিতে জাতীয় ভোট মানে সমান্তরালভাবে চার ধরনের জনপ্রতিনিধি বাছাই। ব্যক্তি প্রার্থীদের ঘিরে সরাসরি ভোট হয় ২৭৫ আসনের ‘প্রতিনিধিসভা’র ১৬৫ আসনে। এ ভোটের সময় ভোটাররা পুরো দেশ থেকে আসনভিত্তিক ১৬৫ জন প্রার্থী বাছাইয়ের পাশাপাশি যে দলকে যে সংখ্যায় ভোট দেন, তার ভিত্তিতে আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রতিনিধিসভার বাকি ১১০ জন সদস্য নির্বাচিত হন বিভিন্ন দলের তালিকা থেকে। এভাবে সেখানে গঠিত হবে ২৭৫ সদস্যের প্রতিনিধিসভা।

অন্যদিকে একই সময় মানুষ সাতটি প্রাদেশিক প্রতিনিধিসভার জন্যও ভোট দিয়েছে। উপরন্তু জাতীয় প্রতিনিধিসভা এবং প্রাদেশিক প্রতিনিধিসভার সদস্যরা মিলে পরে ৫৯ সদস্যের (তিনজন রাষ্ট্রপতি মনোনীত) ‘রাষ্ট্রীয় সভা’ বা ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি নামে ফেডারেল পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ গঠন করবেন।

প্রতিনিধিসভায় যে দল বা জোট সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় সাধারণত তারাই সরকার গঠন করে। রাজনীতিবিদ ও জনগণ উভয়ের কাছে নির্বাচনে প্রধান আকর্ষণ প্রতিনিধিসভার প্রাথমিক ১৬৫ আসনের লড়াই। সেটাই হলো ২০ নভেম্বর।

ফলাফল জটিল সমীকরণের ইঙ্গিত দিচ্ছে

জাতীয় ভোটের সর্বশেষ প্রাপ্ত ফলাফলে এগিয়ে নেপালি কংগ্রেস। ১৬৫ আসনে তারা এ পর্যন্ত ঘোষিত ফলাফলে পেয়েছে ৪৯ আসন; এগিয়ে আছে আরও ৫টিতে। দলটি একা এ সফলতা পায়নি। আরও চারটি দল নিয়ে তাদের জোট ছিল। এই জোটে ছিল মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টি। মাওবাদীরা নির্বাচনে একক দল হিসেবে তৃতীয় সর্বোচ্চ আসন পেল। জিতেছে ১৬টি আসনে; এগিয়ে আছে ২টি আসনে। সুতরাং আপাতত ফলের হিসাবটা এই জোটের জন্য এ রকম: কংগ্রেস ৫৪, মাওবাদীরা ১৮; দুই দল মিলে ১৬৫-এর মধ্যে ৭২ আসন। এই জোটের অন্য তিন ক্ষুদ্র শরিকের আসন এবং সবার আনুপাতিক ভোটের আসন অনুমান করে বলা যায় কংগ্রেস ও মাওবাদীরা মিলে অনায়াসে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে এবং সরকার গড়তে পারবে।

সে ক্ষেত্রে ‘স্বাভাবিক হিসাবে’ নেপালি কংগ্রেসের কারোরই প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা। কিন্তু ঠিক এখান থেকে নতুন একটা হিসাব-নিকাশের শুরু হয়ে গেছে।

‘মাওবাদী’ দল বলছে, আসনের হিসাবে জাতীয়ভাবে তৃতীয় এবং জোটের মধ্যে দ্বিতীয় হলেও প্রধানমন্ত্রী পদটি তাদের দিতে হবে। না হলে তারা বিরোধী ইউএমএল দলকে সমর্থন দেবে। অন্যদিকে ইউএমএল-ও এই সমীকরণে সম্মত বলে জানিয়েছে। ইউএমএল ১৬৫ আসনের মধ্যে ৩৮টিতে জিতেছে এ পর্যন্ত এবং এগিয়ে আছে ৬টিতে। আনুপাতিক ভোটের আসন ছাড়াই তারা ৪৪ আসন পেল। আসনের হিসাবে চতুর্থ হয়েছে রাষ্ট্রীয় স্বতন্ত্র পার্টি। তারা ৭টির মতো আসন পাচ্ছে।

উপরের চিত্রের সারমর্ম দাঁড়াচ্ছে। কংগ্রেস ও মাওবাদীরা চাইলে সরকার গড়তে পারবে। আবার মাওবাদীরা এই জোট থেকে বেরিয়ে ইউএমএল-কে সমর্থন দিলে পুরো চিত্রটি অন্য রকম হতে পারে। নৈতিকভাবে এটা জনমতের সঙ্গে একধরনের তামাশা হলেও ভোটের গণিতে বিষয়টি সম্ভব। নেপালে এ রকম জোট ভাঙাগড়া দেখতে জনগণ অভ্যস্ত। যদিও তারা বিরক্ত।

বিবিধ কারণে নেপাল বিষয়ে ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে খুব আগ্রহী। ভোটের প্রাথমিক ফলাফল ভারতের জন্য স্বস্তিদায়ক হয়েছে। কংগ্রেসের সঙ্গে তাদের বোঝাপড়া কমিউনিস্ট সংগঠনগুলোর চেয়ে ভালো। কিন্তু উদীয়মান নতুন পরিস্থিতিতে কংগ্রেস যদি সরকার গড়তে না পারে, তাহলে ভারতের দ্বিতীয় পছন্দ হবেন প্রচন্ড। ভোটের ফলাফল চীনকে কিছুটা হতোদ্যম করেছে কে পি অলির দল প্রথম স্থান না পাওয়ায়।

নতুন দলের উত্থান এবং ‘কমিউনিস্ট’দের লাগাতার আপসকামিতা

নেপালের এবারের নির্বাচনের অঘটন একটাই, তা হলো নতুন একটা দল ‘রাষ্ট্রীয় স্বতন্ত্র পার্টি’র উত্থান।

নির্বাচনে তারা প্রত্যাশার চেয়েও ভালো করেছে। নির্বাচনের আগে বিভিন্ন পেশার কিছু তরুণ দলটি গঠন করে। তাদের বক্তব্য ছিল দেশটিতে পুরোনো রাজনীতিবিদ এবং দলগুলো জনতাকে প্রত্যাশামতো কিছু দিতে পারছে না। রাজনীতিতে একটা পালাবদল দরকার। ফলাফলে মনে হচ্ছে, স্বতন্ত্র পার্টির বক্তব্য জনগণ নিয়েছে। তারা ১৬৫ আসনে ৭টি আসন পেয়ে চতুর্থ হওয়ার পাশাপাশি দলীয় সমর্থনের ভোটে তৃতীয় হয়েছে। অর্থাৎ তারা মাওবাদীদের চেয়েও বেশি ভোট পেয়েছে, যা অচিন্তনীয় সফলতা। দেশটির পুরোনো বৃদ্ধ রাজনীতিবিদদের জন্য তরুণদের তরফ থেকে এটা বড় এক সতর্কবার্তা ছিল এবার। সরাসরি ভোটের আসন এবং আনুপাতিক ভোটের আসন মিলে পার্লামেন্টে স্বতন্ত্র পার্টির ১৫-১৬টি আসন হবে।

কোয়ালিশন সরকার হলে সেই সরকারের ভাঙাগড়ায় স্বতন্ত্র পার্টিও ‘কিং মেকারে’র ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে। নেপালের এবারের নির্বাচনের আরেকটি দিক হলো কমিউনিস্টদের আদর্শিক আপসকামিতা। তারা এমনকি রাজতন্ত্র সমর্থকদের সঙ্গেও জোট করেছে।

সরকার গঠনের পাটিগণিত বেশ জটিল

দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির একটা কৌতূহলোদ্দীপক বৈশিষ্ট্য হলো কেবল নেপালে সমাজতন্ত্রীরা এখনো বেশ শক্তিশালী। এবারের ভোটে এখানে তিনটি কমিউনিস্ট উপদল পৃথক পৃথকভাবে নির্বাচন করে বেশ ভালো করেছে। এর মধ্যে ইউএমএল-প্রধান কে পি শর্মা অলি এবং মাওবাদী উপদলের প্রধান পুষ্পকুমার দহলের (প্রচন্ড) মধ্যে নির্বাচনের বহু আগে থেকে কথা বলা বন্ধ। ভোটও করেছেন তাঁরা পরস্পরের বিরুদ্ধে পৃথক জোট গড়ে। কিন্তু এখন ভোটের ফল আসতে থাকার মুখে তাঁরা পরস্পরকে ফোন করেছেন। এত দিনের তিক্ততা ছুড়ে ফেলে একত্রে সরকার গড়তে চান তাঁরা। অন্তত অলি তাতে আগ্রহী। স্বভাবত প্রচন্ড ভাবছেন এই সুযোগে চাইলে তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন। ফলে নেপালি কংগ্রেসকে আর তিনি আগের মতো শর্তহীন সমর্থন দিতে রাজি নন। ভোটে তৃতীয় হয়েও প্রচন্ড হঠাৎ করেই এখন ‘কিং মেকার’ হয়ে উঠেছেন। এমনকি ‘কিং’ও হয়ে যেতে পারেন।

১৬৫ আসনের ভোটে এখন পর্যন্ত নেপালি কংগ্রেস প্রথম স্থানে এবং ইউএমএল দ্বিতীয় স্থানে থাকলেও দলভিত্তিক সমর্থনে মানুষ কংগ্রেসের চেয়ে ইউএমএল-কে বেশি ভোট দিয়েছে। ইউএমএলের ভারতবিরোধিতা এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে বলে মনে হয়। ফলে আনুপাতিক ভোটের হিসাবে পাওয়া আসনে তারা কিছুটা বেশি আসন পাবে। এতে ২৭৫ আসনের চূড়ান্ত হিসাবে কে পি অলির ইউএলএল ৮০টি এবং কংগ্রেস ৮৫টি আসন পেতে পারে। অন্যদিকে মাওবাদীদের আনুপাতিক পদ্ধতির আসনসহ সর্বমোট আসন হতে পারে ৩২-৩৩টি। চতুর্থ দল রাষ্ট্রীয় স্বতন্ত্র পার্টি প্রাথমিক ভোটে ৬টি আসন পেয়েছে এবং ১টিতে এগিয়ে আছে। আনুপাতিক ভোটে তারা ৮-৯টি আসন পেয়ে নিজেদের প্রতিনিধি ১৫-১৬-তে উন্নীত করতে পারবে।

সরকার গড়ার ক্ষেত্রে ইউএমএলেরও সম্ভাবনা তখনই তৈরি হয়, যদি তারা তৃতীয় কোনো বড় দলকে কাছে পায়। এ রকম বিবেচনা থেকে তৃতীয় ও চতুর্থ স্থানে থাকা দুটি দলের কদর বেড়ে গেছে।

নেপালে সংবিধানের ৭৬ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ২৭৫ আসনের পার্লামেন্টে ১৩৮ জনের সমর্থন থাকলে সরকার গঠন করা যাবে। সুতরাং নেপালি কংগ্রেসের যেমন সরকার গঠনের জন্য ছোট দলগুলোর প্রায় ৫০টি আসনের সমর্থন দরকার, তেমনি ইউএমএলেরও সে রকম ৫৫ আসনের সমর্থন লাগবে। এই টানাপোড়েনকে কাজে লাগিয়ে ছোট দলগুলো বড় কারও সমর্থন নিয়ে নিজেরা সরকার গড়তে চাইতে পারে। অঙ্ক মেলানোই যখন শেষ কথা!

সরকার গঠনে ছাপ থাকবে ভূরাজনীতিরও

বিবিধ কারণে নেপাল বিষয়ে ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে খুব আগ্রহী। ভোটের প্রাথমিক ফলাফল ভারতের জন্য স্বস্তিদায়ক হয়েছে। কংগ্রেসের সঙ্গে তাদের বোঝাপড়া কমিউনিস্ট সংগঠনগুলোর চেয়ে ভালো। কিন্তু উদীয়মান নতুন পরিস্থিতিতে কংগ্রেস যদি সরকার গড়তে না পারে, তাহলে ভারতের দ্বিতীয় পছন্দ হবেন প্রচন্ড। ভোটের ফলাফল চীনকে কিছুটা হতোদ্যম করেছে কে পি অলির দল প্রথম স্থান না পাওয়ায়। কিন্তু তারা আশাবাদী, কে পি অলি মাওবাদীদের কাছে টেনে সরকার গড়তে সমর্থ হবেন। যদি সেটা না ঘটে তাহলে তাদেরও দ্বিতীয় পছন্দ পুষ্পকুমার দহল প্রচণ্ড। এভাবে দুই দিক থেকে ‘কমরেড প্রচন্ডে’র সম্ভাবনা তৈরি হলো। আবার অতি উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রচন্ডকে সামাল দিতে কংগ্রেস এবং ইউএমএলের মতো পুরোপুরি বৈরী দুটি দলও একসঙ্গে সরকার গড়তে পারে বলে অবিশ্বাস্য অনুমানও আছে কাঠমান্ডুতে।

শেষ পর্যন্ত নেপালে যদি এ রকম কোনো সরকার গঠিত হয়, যা আসলে ভোটের প্রবণতার সঙ্গে মেলে না, তাহলে দেশটিতে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা চলতে থাকবে। আপাতত কোনো কৃত্রিম জোট গড়ে সরকার গঠিত হলেও হঠাৎ যেকোনো সময় তা ভেঙে যেতে পারে। এ রকম ভাঙাগড়ায় দীর্ঘ মেয়াদে লাভবান হবে দেশটির নবাগত চতুর্থ দলটি। নেপালে ১৬ বছর ধরে ভোটের আগে-পরে বিভিন্ন জোটের ভাঙাগড়া চলছে। যে কারণে গত ১৬ বছরে এখানে প্রায় ১৩ দফা সরকার গঠিত হয়েছে। জনগণের একটা অংশ ওই প্রবণতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এবার স্বতন্ত্র পার্টির তরুণদের সমর্থন দিয়েছে। জনগণের সেই সতর্কবার্তা প্রচন্ড, অলি বা দেউবা কতটা আমলে নেন, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

  • আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক