আমরা এমন এক দুনিয়ায় বাস করছি, যেখানে চারদিকে সেলিব্রিটিদের রমরমা। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ও ভবিষ্যৎ প্রেসিডেন্ট এক দশকের বেশি সময় রিয়েলিটি টিভি তারকা হিসেবে কাটিয়েছেন। এই তো কয়েক দিন আগে টেলর সুইফট বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ও লাভজনক পপ মিউজিক ট্যুর শেষ করলেন। বৃহৎ বিনোদনমাধ্যমগুলো এখনো তারকানির্ভর। এই ছুটির মৌসুমে যাঁরা `উইকেড' বা `গ্ল্যাডিয়েটর-২' দেখতে যাচ্ছেন, তাঁদের জিজ্ঞাসা করলেই এ কথার প্রমাণ পাবেন। আর এর বাইরে আকর্ষণীয় ও বিখ্যাত ব্যক্তিদের ছোটখাটো সব নাটক তো আছেই। এগুলো নিয়েই তো আমরা গুজবে মেতে থাকি।
এখন আমি এমন একটা যুক্তি দিতে যাচ্ছি, যা শুনলে আপনাদের কাছে অদ্ভুত মনে হতে পারে। কারণ, কথাটা যা বললাম, তার পুরোপুরি বিপরীত। আমরা এই ঐতিহ্যবাহী গণ–সেলিব্রিটির যুগ থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। শুধু সরে যাচ্ছি না, বরং আমরা এক নতুন ও অনিশ্চিত যুগের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। এমনকি কয়েক বছর আগেও যাঁরা অন্ধভক্তি পেতেন, এই নতুন জগতে তাঁদের প্রতি এখন নতুন একধরনের বিদ্বেষ দেখা দিয়েছে।
এই নতুন জগতের একটি বড় অংশ সবচেয়ে তরুণ প্রাপ্তবয়স্ক প্রজন্ম, তথাকথিত জেনারেশন জি এবং ৪০-এর নিচের বয়সী মিলেনিয়ালদের কাছ থেকে। জেনারেশন জি সম্ভবত সবচেয়ে ভুল বোঝা প্রজন্ম। তারা এমন একসময় প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছে, যখন পুরোনো একপক্ষীয় সংস্কৃতি ভেঙে পড়ছিল। তাদের অনেকেরই বয়স কম। কেব্ল টেলিভিশনের আধিপত্য, জুলিয়া রবার্টস থেকে ব্র্যাড পিট পর্যন্ত তারকাদের সোনালি সময় বা স্টিভ জবসের মতো প্রযুক্তি মোগল একসময় যে উন্মত্ত ভক্তির পাত্র ছিলেন, এ কথা তাদের জানতে পারার কথা নয়।
গত পাঁচ বছরে মূল ধারার গণমাধ্যম জেনারেশন জি সম্পর্কে বিভিন্ন কথা বলেছে। কথাগুলোর একটার সঙ্গে আরেকটার মিল নেই। তারা হয়তো অতিমাত্রায় উদার, অতিরিক্ত বৈষম্যসচেতন অথবা ইন্টারনেটের প্রভাবে বিষাক্ত হয়ে পড়া চূড়ান্ত ডানপন্থী। এরা বই পড়ে না, কিছু পডকাস্টে আসক্ত।
আগামী দশকের বড় লড়াই বাম ও ডানের মধ্যে হবে না। হবে যাঁরা বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রকাশ্যে ঘৃণা করেন এবং যাঁরা নতুন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চান, তাঁদের মধ্যে। মাঞ্জিওনের প্রতি এই ভক্তি আসলে মাঞ্জিওনের জন্য নয়। এই ভক্তি বরং আমরা কোথায় যাচ্ছি, তারই ইঙ্গিত দিচ্ছে। এই ক্ষোভ থামবে না।
বাস্তবতা আরও জটিল। কারণ, প্রতিটি প্রজন্মই আগের প্রজন্মের চেয়ে জটিল। কিছু জেনারেশন জি ও তরুণ মিলেনিয়ালের সাধারণীকরণ করা একটু বেশি কঠিন। কারণ, তারা এমন একসময়ে বাস করছে, যখন সংস্কৃতি ভাঙনের মুখে পড়েছে। এখন আর এই লাখ লাখ কিশোর বা তরুণ কোনো নির্দিষ্ট সময়ে প্রচারিত টিভি শো বা নাটক একত্রে উপভোগ করে না। তারা আর কোনো টক শো থেকে তাদের রাজনৈতিক ধারণাগুলো গ্রহণ করে না।
টেলিভিশনের মতো একপক্ষীয় সম্প্রচারের দিন শেষ হয়ে গেছে। টেলিভিশন দিয়ে নির্বাচনে প্রভাব রাখা যায় না আর। হলিউডও আর সংস্কৃতির কেন্দ্রস্থল হিসেবে নিজের আধিপত্য ধরে রাখতে পারছে না।
এখন আর কোনো কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি নেই। অন্তত এটি যে দ্রুত দুর্বল হয়ে পড়ছে, তাতে সন্দেহ নেই। টিকটকের মতো নতুন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে খ্যাতি অর্জন করেছেন অনেকেই। সম্প্রতি একটি প্রবণতা ভাইরাল হয়েছে। টিকটক ব্যবহারকারীদের ডাক দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন সেলিব্রিটি ও প্রভাবশালীকে ইচ্ছাকৃতভাবে উপেক্ষা করতে, যাতে প্রমাণ করা যায় যে সেলিব্রিটিদের চেয়ে টিকটকারদের ক্ষমতা কম নয়। এর ফলে বিশাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনুসারী থাকা সেলিব্রিটিদের ভিডিওতে লাইকের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমে যায়।
অবশ্য এসব সেলিব্রিটি এতটাই ধনী যে এতে তাঁদের আর্থিক কোনো ক্ষতি হয়নি। তবে এই প্রবণতা পাঁচ বছর আগেও অকল্পনীয় ছিল। সেলিব্রিটিরা যে সতর্ক হয়েছেন, এতে সন্দেহ নেই।
লেখক মো ডিগস এই প্রবণতাকে বলেন ‘ব্যক্তিত্বে বিরক্তি’। বিশেষত ইন্টারনেট জগতে সাধারণ মানুষ ধনী ও বিখ্যাত ব্যক্তিদের নিয়ে বিরক্ত হয়ে পড়েছে। আর রাজনৈতিকভাবে নেতাদের বা যাঁরা তাদের কী করতে হবে, তা বলে বেড়ান, তাঁদের মানুষ সন্দেহ করে। আগের মতো আর তাঁদের কথা বিনা বাক্যে গ্রহণ করে না।
এবারের মার্কিন নির্বাচনেও এমন দেখা গেছে। টেলর সুইফট ও বিয়ন্সে মারাত্মক জনপ্রিয়। কিন্তু উদ্দীপনামূলক সমর্থনের পরও তাঁরা তরুণ ভোটারদের কমলা হ্যারিসের পক্ষে উল্লেখযোগ্যভাবে নিয়ে আসতে পারেননি। বামপন্থী ঝোঁকের জেনারেশন জি ভোটাররা বিশেষভাবে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন সেই সব সেলিব্রিটির ওপর, যাঁরা গাজার ঘটনায় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নেননি। অভিজাত ব্যক্তিদের প্রতি এই অবিশ্বাস ক্রমাগত বাড়ছে।
এই শূন্যতায় এসে প্রবেশ করেছেন চূড়ান্ত ‘অ্যান্টি-ইনফ্লুয়েন্সার’ ২৬ বছর বয়সী লুইজি মাঞ্জিওনে। ইউনাইটেড হেলথকেয়ারের সিইও ব্রায়ান টম্পসনকে হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত মাঞ্জিওনে। তিনি এখন অনলাইনে বিশাল এক ভক্তগোষ্ঠী পেয়েছেন। সাম্প্রতিক ইতিহাসে এমনটা আগে দেখা যায়নি। ২০২৩ সালে ১ বছরেই ১২ লাখ মার্কিন ডলার আয় করা এক সিইওকে হত্যার এই অভিযোগ সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। কিন্তু তা কোনো দলের সঙ্গে যুক্ত নয়।
বেন শাপিরো বা ম্যাট ওয়ালশের মতো ডানপন্থী বিশ্লেষক যখন এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করেন, তখন তাঁদের কমেন্ট সেকশন মার্কিন স্বাস্থ্যসেবা ব্যবসার বিরুদ্ধে ক্ষোভ এবং হত্যার প্রতি সমর্থনে ভরে যায়।
টম্পসনকে হত্যার নিন্দা জানানো উদারপন্থীরাও খুব একটা ভালো অবস্থানে নেই। গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো মাঞ্জিওনের প্রতি মানুষের মোহ নিয়ে একমত যে এটা ভালো হচ্ছে না। কিন্তু অনলাইনে সাধারণ মানুষের মনোভাব অন্য রকম। অ্যামাজনে ভিডিও গেম চরিত্র লুইজি ব্যাপকভাবে বিক্রি হচ্ছে। কেউ কেউ মাঞ্জিওনের ছবিসংবলিত মোমবাতিও কিনেছেন।
এসব থেকে একটা বার্তা স্পষ্ট, যদি নতুন কোনো আইডল তৈরি হয়, তবে তা আর কোনো গায়ক, নৃত্যশিল্পী বা অভিনেতা হবেন না। অন্তত তরুণ প্রজন্ম এমনটাই মনে করছে। প্রতিষ্ঠানের প্রতি তাদের ক্ষোভ ক্রমেই বাড়ছে। তাদের লুইজি মিম বানানো বন্ধ করতে বললে আর কোনো লাভ হবে না। যে ট্রাম্প নিজেকে বড় পরিবর্তনকারী বলে দাবি করেন, আবার প্রেসিডেন্ট হয়েও এই প্রবণতার আওতার বাইরে তিনি থাকতে পারবেন না।
আগামী দশকের বড় লড়াই বাম ও ডানের মধ্যে হবে না। হবে যাঁরা বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রকাশ্যে ঘৃণা করেন এবং যাঁরা নতুন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চান, তাঁদের মধ্যে। মাঞ্জিওনের প্রতি এই ভক্তি আসলে মাঞ্জিওনের জন্য নয়। এই ভক্তি বরং আমরা কোথায় যাচ্ছি, তারই ইঙ্গিত দিচ্ছে। এই ক্ষোভ থামবে না।
রস বারকান নিউ ইয়র্কবাসী লেখক
গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ জাভেদ হুসেন