মতামত

‘আমার ছেলেকে ধরিছে সন্দমূলক...সে পাঞ্জাবি গায়ে দেয়’

‘...৩ টাকায় দুই পিন প্লাগ, ২০ টাকায় অনায়াসে দেওয়া যাবে। মাত্র ২৭ টাকায় লায়ন মাল্টি। এটা সিক্স পিন, কেউ বলে টু পিন। মাত্র ২৫ টাকায় দিচ্ছি। ...ডিমলাইট ১২ টাকায়। সব প্যাকেটওয়ালা মাল। আকর্ষণীয় জিনিস। মশার লাইট। এটার রেট মাত্র ১০৫ টাকা। ছয় মাস গ্যারান্টি। এটা লাগাইলে মশা দিব দৌড়। ...যারাই বেকারত্ব জীবন নিয়া ঘুরতেছেন, চায়ের দোকানে আড্ডা-মাড্ডা না দিয়া আপনারা এই ব্যবসার ভেতর লিপ্ত হন...’

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ‘মামুন ব্লগ’-এর এই ভিডিও দেখেই ঢাকায় এসেছিলেন শাহাদত হোসাইন, আবুল বাশার ও তাঁদের এক বন্ধু। বগুড়ার শেরপুর শহীদিয়া আলিয়া কামিল মাদ্রাসার ছাত্র শাহাদত ও বাশার মসজিদে থাকেন, পড়ালেখার পাশাপাশি এলাকায় বিদ্যুৎমিস্ত্রির কাজও করেন।

এত সস্তায় গুলিস্তানের সুন্দরবন স্কয়ার সুপার মার্কেটে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম পাওয়া যাচ্ছে দেখে রাতেই রওনা হয়েছিলেন তাঁরা। পৌঁছান ভোরে, দোকানপাট খোলার আগেই। তখনো তাঁরা জানেন না কোন চক্করে পড়তে যাচ্ছেন। এমনকি দুজন পুলিশ সদস্য যখন তাঁদের জেরা শুরু করেছেন, তখনো না।

সেসময় একটু দূরেই দাঁড়িয়েছিলেন ওই দুই তরুণের অপর বন্ধু আবু সালেহ। সেখান থেকেই তিনি দেখেছিলেন পুরো ঘটনা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুলিশের দুই সদস্য হঠাৎ তাঁদের মুঠোফোন হাত থেকে নিয়ে দেখতে শুরু করেন। একটু পরে দেখি পুলিশ ওদের নিয়ে চলে যাচ্ছে। খুঁজতে খুঁজতে ওদের বংশাল থানায় পাই। পুলিশ সেখানে আমার মুঠোফোনও চেক করে। তারপর বাড়ি চলে যেতে বলে।’

পুলিশ বলেছে, তাঁরা ব্যাপক মারামারি ও ফাটাফাটির দায়ে গ্রেপ্তার হয়েছেন। সরকারি ভাষ্য হলো, তাঁরা জামাত-শিবিরের ১৭ জনের একটি দলের সদস্য। ‘হত্যার উদ্দেশ্যে’ পুলিশের ওপর হামলা করে ছয়জনকে আহত করে ককটেল ফাটিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন; যদিও আগের রাতেই পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার মো. জাফর হোসেন প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ওই দুজনসহ আরও কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। তাঁরা বিক্ষোভ মিছিলের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। শাহাদত ও আবুল বাশার এখন হামলা ও বিস্ফোরণের মামলায় জেলে।

শাহাদতের বাবা সাইফুল ইসলাম খেতে কাজ করেন। আবুল বাশারের বাবা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক আবদুর রাজ্জাক। তাঁরা পুলিশের এই ভাষ্যের সঙ্গে একমত নন। কতজন এই ভাষ্যের সঙ্গে একমত হবেন, তারও নিশ্চয়তা নেই। কারণ, ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগেও প্রায় একই কাহিনি নিয়ে পুলিশ হাজির হয়েছিল। সে সময়ের তুলনায় পুলিশ এখন আরও অনেক চৌকস। তাদের মেধা ও দক্ষতায় এখন নতুন আঙ্গিক যুক্ত হয়েছে। ফোনে আড়ি পাতার পাশাপাশি পুলিশ এখন হাটে-মাঠে-ঘাটে মুঠোফোন ঘেঁটে যেকোনো ব্যক্তির রাজনৈতিক পরিচয়, তাঁদের কল্পনা-পরিকল্পনাসহ সবকিছু সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু আইন কি আইনশৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনীকে অসীম ক্ষমতা দিয়েছে? চাইলেই কি তারা মুঠোফোন এভাবে ঘাঁটাঘাঁটি করতে পারে? এ কাজে ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠনের সাহায্য নিতে পারে? নিশ্চয়ই মনে আছে, গত বছর বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশকে কেন্দ্র ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা মুঠোফোন ঘেঁটে বিএনপি-সমর্থক ১০ থেকে ১২ জনকে মারধর করে পুলিশে দেন। তাঁরা অবস্থান নিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তি ও গণতন্ত্র তোরণের কাছে।

একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি আমরা দেখেছি গত জুলাইয়ে ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশের আগে। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড এর করা একটি ভিডিও ওই সময় ভাইরাল হয়। দেখা যায়, এক পুলিশ সদস্য একজন বাসযাত্রীর মুঠোফোনের পিকচার গ্যালারিতে কিছু খুঁজছেন। তাঁদের মধ্যকার কথোপকথন ছিল এমন—

যাত্রী: আমি প্রোগ্রামে যাইতেছি না। সিউর থাকেন। আপনি যে কারণে মোবাইল ঘাঁটতেছেন। এই যে আমার ভিজিটিং কার্ড...

পুলিশ: আপনার ভিজিটিং কার্ড দিয়ে কিচ্ছু হবে না, ভাইয়া।

এর কিছুক্ষণ বাদেই মিছিলের একটি ছবি খুঁজে পায় পুলিশ। তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘এমন কিছু থাকলে আপনাকে মেহমান হতে হবে। বিকেল পর্যন্ত খাওয়াদাওয়া সব ফ্রি। বিকেলবেলা চলে যাবেন।’

মুঠোফোনের গ্যালারিতে মিছিলের ছবি থাকা কেন অন্যায়, এর কোনো ব্যাখ্যা দিতে শোনা যায়নি ওই পুলিশ সদস্যকে।

বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যে অক্ষরে অক্ষরে আদালতের নির্দেশনা যে পালন করছে না, তার বহু উদাহরণ আছে। সে কারণে স্পর্শকাতর মামলা খারিজ হয়ে যাওয়ার উদাহরণও বিস্তর। আসলে শাহাদত হোসাইন ও আবুল বাশারকে দেখে কেন সন্দেহ হলো পুলিশের? কেনই-বা তল্লাশি করে তুলে নিয়ে যাওয়া হলো?

পুলিশ এভাবে মুঠোফোন ঘাঁটাঘাঁটি করতে পারে কি না, তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা আছে। অনেকেই বাংলাদেশের সংবিধানের ৪৩ অনুচ্ছেদের উদাহরণ দেন। সেখানে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা, জনসাধারণের নৈতিকতা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের চিঠিপত্রের ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার থাকিবে।’

আবার জাতিসংঘ মানবাধিকার ঘোষণার ১২ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কারও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা কিংবা তার গৃহ, পরিবার ও চিঠিপত্রের ব্যাপারে খেয়ালখুশিমতো হস্তক্ষেপ কিংবা তার সুনাম ও সম্মানের ওপর আঘাত করা চলবে না। এ ধরনের হস্তক্ষেপ বা আঘাতের বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার প্রত্যেকেরই রয়েছে।’

বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এত কিছু মাথায় রাখার প্রয়োজন পড়ে না। ধারাবাহিকভাবে বিএনপির নেতা-কর্মীদের ফোনালাপ ফাঁস হওয়ার পর ২০১৫ সালে বিএনপির কেন্দ্রীয় শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. এম ওবায়দুল ইসলাম এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘টেলিফোনে আড়ি পাতা কিংবা ফোনালাপ ফাঁস করা, আমার মনে হয় বাথরুমের ছিদ্র দিয়ে দেখার মতো অত্যন্ত সংকীর্ণ মনোভাবের পরিচায়ক। এটি ব্যক্তির গোপনীয়তা লঙ্ঘন, এটি ব্যক্তির মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন; এটি অবশ্যই শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত।’

আড়ি পাতা ও তা প্রকাশ করা যদি হয় বাথরুমের ছিদ্র দিয়ে দেখা, তাহলে হাত থেকে মুঠোফোন কেড়ে নিয়ে তা ঘেঁটে দেখা বাথরুমের দরজা খুলে ঢুকে পড়ার মতো কাজ কি না, সে নিয়ে আলোচনা হতে পারে।

আর সন্দেহের বশে যে কাউকে থামিয়ে তাঁকে তল্লাশি করা নিয়ে হাইকোর্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি দশ দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন। ওতে আছে, কোন যুক্তিতে, কাউকে কোন তথ্যে বা অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, ঠিকানাসহ তা কেস ডায়েরিতে লিখতে হবে। আটক ব্যক্তি কোন কর্মকর্তার তদারকিতে রয়েছেন, তা-ও উল্লেখ করতে হবে। গ্রেপ্তারের সময় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও উপস্থিত মানুষের সামনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের তাঁদের পরিচয় বলতে হবে, প্রয়োজনে পরিচয়পত্র দেখাতে হবে।

আরও বলা হয়েছে, গ্রেপ্তারের স্থান ও সময়ে ব্যক্তির স্বাক্ষরসহ গ্রেপ্তারের পরপরই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এ বিষয়ে একটি মেমোরেন্ডাম তৈরি করবেন। গ্রেপ্তারের সময় ও স্থান এবং আটক রাখার জায়গা তাঁর আত্মীয়কে জানাতে হবে। আত্মীয়স্বজনকে না পেলে বিষয়টি ব্যক্তির নির্দেশনা অনুসারে তাঁর বন্ধুকে জানাতে হবে। এ কাজে ১২ ঘণ্টা অতিক্রম করা যাবে না।

বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যে অক্ষরে অক্ষরে আদালতের নির্দেশনা যে পালন করছে না, তার বহু উদাহরণ আছে। সে কারণে স্পর্শকাতর মামলা খারিজ হয়ে যাওয়ার উদাহরণও বিস্তর। আসলে শাহাদত হোসাইন ও আবুল বাশারকে দেখে কেন সন্দেহ হলো পুলিশের? কেনই-বা তল্লাশি করে তুলে নিয়ে যাওয়া হলো?

সরকারি একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক আবদুর রাজ্জাক এ ব্যাপারে এখনো নিশ্চিত নন তাঁর মুয়াজ্জিন ছেলেটি কেন কারাগারে। ছেলে গ্রেপ্তারের দুই দিন পর তিনি খবর পান।

আর এই পরিবারের কেউ রাজনীতির সঙ্গেই জড়িত নন—এমন তথ্য দিচ্ছেন শেরপুরের গাড়িদহ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. তবিবুর রহমান।

অবশ্য খেতে কাজ করা শাহাদতের বাবা সাইফুল ইসলাম একটা কারণ খুঁজে পেয়েছেন। সোমবার সকালে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ছেলেকে ধরিছে সন্দমূলক...সে পাঞ্জাবি গায়ে দেয়। ভাবিছে শিবির করে। আমরা সবাই কিন্তু আওয়ামী লীগ করি। মেয়রের সঙ্গে আমার ছেলের ছবি আছে।’

  • শেখ সাবিহা আলম প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
    ই-মেইল: sabiha.alam@prothomalo.com