বিলম্বে হলেও সরকারের পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার দিকে এখনই নজর দেওয়া উচিত। সমস্যা সমাধানে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকারের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) চুক্তি হয়েছে। উচিত ছিল চুক্তি দ্রুত বাস্তবায়ন করা। কারণ, সমস্যা সমাধানের বিলম্ব প্রক্রিয়ায় লাভের চেয়ে ক্ষতির আশঙ্কাই বেশি। বিশেষ করে, রাজনৈতিক সমস্যার ক্ষেত্রে সেটি আরও বেশি জরুরি। কিন্তু সরকার সিকি শতাব্দী ধরে বিলম্ব তত্ত্বে (ডিলে থিওরি) রয়েছে। প্রকৃত বিবেচনায় চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ১৯৯৮ সালের মধ্যে আটকে থাকা তারই প্রমাণ। ফলে স্বাভাবিকভাবে সমস্যাটি ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত হানাহানি ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে চলেছে। চুক্তি বাস্তবায়নে বিলম্বিত প্রক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া যদি এই হয়, তাহলে জেনেশুনেই এখানে অবহেলা করা হচ্ছে, তাই নয় কি?
২০১৭ সাল থেকে সংঘাতে এখন পর্যন্ত তিন জেলায় শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। পার্বত্য চুক্তির পর থেকে হিসাব করলে মৃতের সংখ্যা আরও বেশি। এই সংখ্যা হাজারের ওপর হতে পারে। পার্বত্য চুক্তির পর জেলা ও উপজেলা শহর থেকে দূরে দুর্গম এলাকায় হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু ২০১৭ সালের পর দেখা যাচ্ছে, জেলা ও উপজেলা শহরসংলগ্ন এলাকা, জনবহুল বাজার—যেখানে অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতির কাছাকাছি হত্যাকাণ্ড হচ্ছে। ২০১৭ সালে খাগড়াছড়ি জেলা শহরের স্বনির্ভর বাজারে ছয়জন, ২০২০ সালের ৭ জুলাই বান্দরবানের রাজবিলা ইউনিয়নের বাঘমারা বাজারপাড়ায় ছয়জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। সর্বশেষ কুকি-চীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট ( কেএনএফ) নামে একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী ও তাদের গোপন আস্তানায় জঙ্গিগোষ্ঠী জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কিয়ার সদস্যদের প্রশিক্ষণের বিষয়টি উঠে এসেছে। বলা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সঙ্গে যোগ হওয়া নতুন উপসর্গ এটি।
রাজনৈতিক সমস্যা রাজনৈতিকভাবে সমাধানের জন্য স্বাক্ষরিত পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে পক্ষে ও বিপক্ষে জোরালো বক্তব্য শোনা যায়। সরকারি পক্ষ বলছে, অধিকাংশই বাস্তবায়িত হয়েছে। অবশিষ্ট অংশ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। পার্বত্যবাসীর পক্ষে চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী পিসিজেএসএস নেতাদের দাবি, চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলোসহ অধিকাংশই বাস্তবায়িত হয়নি। বাস্তবতাও বলছে তাই, সরকারের দাবি সঠিক হলে পরিস্থিতির এতটা অবনতি হওয়ার কথা নয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা রাজনৈতিক। সমাধানও হতে হবে রাজনৈতিক উপায়ে। সেই লক্ষ্যে সরকার ও পিসিজেএসএসের চুক্তি হয়েছে, যা পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি হিসেবে দেশ-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে। শান্তির পায়রা ধরাও দিয়েছিল। চুক্তির পর জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র শাখা শান্তিবাহিনীর সদস্যরা অস্ত্র সমর্পণ করেছিলেন। সহিংস ঘটনায় বাস্তুচ্যুত হয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীরা ফিরে আসে। প্রায় আড়াই দশকের সহিংসতার অবসান হওয়ায় মানুষের মধ্যে ব্যাপক আশা-আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠে। একসময় কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ দূর হয়ে অবাধে ও নির্ভয়ে সব জায়গায় চলাচলের দুয়ার খুলে গিয়েছিল। অশান্ত ও অস্থির পাহাড়ি সমাজে মোটামুটি স্থিতিশীলতা ফিরে আসে। তারা নিজ নিজ উন্নয়নে মনোনিবেশ করে। সরকারি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোও ব্যাপক কার্যক্রম নিয়ে এগিয়ে আসে।
চুক্তির চার বছর পর ২০০১ সালের একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি। সমতলের কয়েকজন বন্ধুসহ রাঙামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার দুর্গম ফারুয়া ইউনিয়নে গিয়েছিলাম। ফারুয়া বাজার থেকেও অনেক ভেতরে রাইনক্ষ্যং রিজার্ভের বিভিন্ন পাড়ায় নির্ভয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি। অথচ চুক্তির আগে বিলাইছড়ি, বিশেষ করে, ফারুয়া ছিল ভয়ংকর সহিংসতাপ্রবণ এলাকা। চুক্তির সুবাদে অবাধ চলাচলে মানুষের মধ্যে দেখেছি কী উচ্ছ্বাস! কোনো শঙ্কা, ভয়ভীতির পরিবেশ নেই। যেখানে গিয়েছি, সেখানে মানুষ জুমে, বনে, বাজারে, পাড়াগ্রামে অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এবং কাজ করছেন। ২০০৫ সালের পর থেকে পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতির দিকে যেতে থাকে। সম্প্রতি খবর নিয়েছি, সেসব এলাকায় এখন চুক্তির আগের ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সেখানকার মানুষ ভেতরে ও বাইরে নানামুখী চাপে এবং হুমকিতে রয়েছে। এই পরিস্থিতি শুধু বিলাইছড়িতে নয়, খাগড়াছড়ির দুদুকছড়া থেকে পানছড়ি, সাজেক, দীঘিনালা, বাঘাইছড়ি হয়ে বান্দরবানের রুমা, রোয়াংছড়ি, আলীকদম ও থানচি—প্রায় একই রকম অবস্থা।
রাজনৈতিক সমস্যা রাজনৈতিকভাবে সমাধানের জন্য স্বাক্ষরিত পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে পক্ষে ও বিপক্ষে জোরালো বক্তব্য শোনা যায়। সরকারি পক্ষ বলছে, অধিকাংশই বাস্তবায়িত হয়েছে। অবশিষ্ট অংশ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। পার্বত্যবাসীর পক্ষে চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী পিসিজেএসএস নেতাদের দাবি, চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলোসহ অধিকাংশই বাস্তবায়িত হয়নি। বাস্তবতাও বলছে তাই, সরকারের দাবি সঠিক হলে পরিস্থিতির এতটা অবনতি হওয়ার কথা নয়। চুক্তি সম্পর্কে যাঁরা মোটামুটি খোঁজখবর রাখেন, তাঁরাও বলে থাকেন, কার্যত চুক্তি বাস্তবায়ন এখনো প্রস্তুতির পর্যায়ে রয়েছে। বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ১৯৯৮ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়, আঞ্চলিক পরিষদ, জেলা পরিষদ, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন, শরণার্থী পুনর্বাসন টাস্কফোর্সসহ প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গঠন করা হয়েছে। সেই প্রতিষ্ঠানগুলোয় ভূমির বিষয়, পুলিশ বিভাগসহ বিভিন্ন বিভাগ হস্তান্তর, আইনের বিধিবিধান প্রণয়ন, ক্ষমতায়ন ও কাজের পরিবেশ তৈরির মধ্য দিয়ে চুক্তি বাস্তবায়নের কথা, কিন্তু সেই রকম কিছুই হয়নি। প্রতিষ্ঠানগুলোকে আধা সক্রিয় ও নিষ্ক্রিয় অবস্থায় বছরের পর বছর ধরে লালন করে যাওয়া হচ্ছে মাত্র।
অন্যদিকে চুক্তি বাস্তবায়ন থেমে থাকলেও সময় কিন্তু থেমে থাকছে না। যেকোনো অঞ্চলে বা দেশে অধিকারপ্রত্যাশী রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান প্রক্রিয়া নিষ্ক্রিয় অথবা বিলম্বিত হলে নতুন করে সংঘাত ও পাল্টা সংঘাতের পরিস্থিতি তৈরি হয়। আঞ্চলিক দল-উপদল সৃষ্টি, প্রাণঘাতী সহিংসতা ও সশস্ত্র সংঘাতের মতো উপসর্গ যুক্ত হয়ে সমস্যা জটিল আকার ধারণ করে। এসব উপসর্গের আবরণে মূল সমস্যা আড়াল হয়ে যায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রেও তা-ই হচ্ছে। মূল সমস্যা আড়ালে গিয়ে এখন সংঘাত-সহিংসতা ও চাঁদাবাজির মতো উপসর্গগুলো সমস্যা হিসেবে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। অথচ উপসর্গের চিকিৎসায় রোগের নিরাময় হয় না। মূল রোগের চিকিৎসার প্রতিকারে উপসর্গের উপশম করতে হয়।
বর্তমানে যুগে বহুত্ববাদী চেতনা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতিতে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করে নেওয়া হচ্ছে। খুব বেশি দূরে যাওয়ার দরকার নেই। উত্তর-পূর্ব ভারতের দিকে তাকাতে পারি। সেখানে গত শতকের ষাটের দশক থেকে জাতিগোষ্ঠীভিত্তিক রাজনৈতিক বহু সমস্যা ও হানাহানি ছিল। বর্তমানে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সেগুলো প্রায়ই নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। এক সময়ের অশান্ত মিজোরাম বর্তমানে সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ অঞ্চল। মিয়ানমার বহুত্ববাদী চেতনা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতি ধারণ করতে পারেনি। তাই এখন অভ্যন্তরীণ ও ভূরাজনীতির জটিল আবর্তে নাকাল অবস্থায় পড়েছে। আমাদেরও নীতিনির্ধারক, আমলাকুলের দৃষ্টিভঙ্গির সংকট থাকলে তা বদলে নেওয়া জরুরি। বহুত্ববাদী চেতনায় জাতিগোষ্ঠীর সমন্বিত প্রতিনিধিত্ব ও অংশীদারত্ব নিশ্চিত হলে স্বাভাবিকভাবে সমতা এবং ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত হবে। তখন দেশ-বিদেশে বহুল প্রশংসিত অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গির পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন সহজ হবে। মনে রাখতে হবে, শান্তি প্রতিষ্ঠায় শান্তিচুক্তি একটি বড় অর্জন। চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে সেই অর্জনের ফসল আহরণ করতে হবে। বিলম্বে কিংবা সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে অর্জনের ফসল আহরণে ব্যর্থ হলে অজ্ঞতাবশে নিজেদের অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার শামিল হবে। অনেক বিলম্ব হয়েছে, আর কালক্ষেপণ না করে বলিষ্ঠ ও দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার সময় এখনই।
বুদ্ধজ্যোতি চাকমা প্রথম আলোর বান্দরবান প্রতিনিধি