ভারতে সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন বন্ধেে দাবিতে বিক্ষোভ
ভারতে সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন বন্ধেে দাবিতে বিক্ষোভ

মতামত

‘ল্যান্ড জিহাদ’: ভারতে মুসলমানদের অধিকার যেভাবে ছেঁটে ফেলা হচ্ছে

হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা সব সময় স্বপ্ন দেখেন, তাঁরা ভারতকে ‘হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রে’ রূপান্তর করবেন। এ স্বপ্ন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তাঁদের সবচেয়ে বড় শত্রু ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানরা। হিন্দু জাতীয়তাবাদী মতাদর্শের সবচেয়ে প্রভাবশালী চিন্তক বিনায়ক দামোদর সাভারকর তাঁর ‘হিন্দুত্ববাদ: কে একজন হিন্দু’ বইয়ে লিখেছেন, ‘ভারত হিন্দুদের পবিত্র ভূমি; এটা মুসলমান অথবা খ্রিষ্ট্রানদের পবিত্র ভূমি নয়।’

একইভাবে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) নেতা এম এস গোলওয়ালকর তাঁর ‘বাঞ্চ অব থটস’ বইয়ে লিখেছেন, ভারতের ভেতরের তিন শত্রু হলো মুসলমান, খ্রিষ্ট্রান ও কমিউনিস্ট।  

এখন যেহেতু এই মতাদর্শের লোকেরা ক্ষমতায় এসেছেন, তাঁরা তাঁদের সেই স্বপ্নকে যেকোনো উপায়ে পূরণ করতে বদ্ধপরিকর। মুসলমানদের তাঁদের পথ থেকে সরাতে না পেরে তাঁরা সম্ভাব্য সব উপায়ে তাঁদেরকে প্রান্তিক করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। সেটা অর্জনের জন্য তাঁরা অব্যাহতভাবে কয়েকটি ভুল বয়ানের ওপর ভিত্তি করে প্রোপাগান্ডা চালিয়ে যাচ্ছেন। এর মধ্যে অন্যতম প্রধান হলো ‘ল্যান্ড জিহাদ’ বা ‘ভূমি জিহাদ’।

‘ভূমি জিহাদ’-এর ষড়যন্ত্রতত্ত্ব

২০১৪-পরবর্তী সময়ে ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা নতুন একটি প্রোপাগান্ডা শুরু করেন। তাঁদের দাবি, মুসলমানরা ভূমি জিহাদের সঙ্গে জড়িত। তাঁদের অভিযোগ ওয়াক্‌ফ বোর্ডের আড়ালে মুসলমানরা হিন্দুদের জমি দখল করতে পারেন।

ওয়াক্‌ফ বোর্ডের বিধানকে ভুলভাবে উপস্থাপন করে তাঁরা সাধারণ হিন্দু জনগোষ্ঠীকে বিভ্রান্ত করেছেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভয় ছড়িয়ে দিয়ে এই বয়ানগুলো শুধু মুসলমানদের বিরুদ্ধে সহিংসতা উসকে দিচ্ছে না, তাঁদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতেও উৎসাহিত করছেন। এ ছাড়া ওয়াক্‌ফ আইনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ভারতজুড়ে ১২০টির বেশি মামলা করা হয়েছে।

ভারতীয় মিডিয়াও এই এজেন্ডাকে সমর্থন করছে এবং সেটা উসকে দিতে ভূমিকা রাখছে।

২০২৩ সালের ২৯ জানুয়ারি ভারতের মুম্বাইয়ে উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন সাকাল হিন্দু সমাজ তাদের মিছিলে ভূমি জিহাদ ও ভালোবাসা জিহাদ স্লোগান দেয়। মিডিয়াগুলো সরাসরি সেই মিছিলের ভিডিও চিত্র প্রচার করে। সেই মিছিল থেকে সরাসরি মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে সহিংসতার ডাক দেওয়া হয়। মিডিয়াগুলো এটাকে প্রশ্ন না করে বরং উল্টো সমর্থন দেয়।

বিজেপি–শাসিত রাজ্যগুলোর ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ ভূমি জিহাদের বয়ান ব্যবহার করছে, বেআইনিভাবে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য। মিডিয়া সেটার ন্যায্যতা উৎপাদনে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে চলেছে। কর্তৃপক্ষ যখন বানোয়াট অভিযোগের ভিত্তিতে বুলডোজার দিয়ে বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দিচ্ছে, মিডিয়া তখন এগুলোকে ভূমি জিহাদের মামলা বলে চিত্রিত করেছে, সরকারের কাজের ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা করেছে।

এভাবে ২০১৪ সালে ভূমি জিহাদ প্রোপাগান্ডা শুরু করলেও ২০১৯ সালে বিজেপি পুনর্নির্বাচিত হওয়ার পর এই প্রচারণা গতি পায়। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহসহ বিজেপির বিশিষ্ট নেতারা প্রকাশ্যে এই বয়ান ব্যবহার করেছিলেন। ২০২১ সালের মার্চ মাসে আসাম বিধানসভার একটি নির্বাচনী প্রচারণায় অমিত শাহ ঘোষণা দেন, ‘আমাদের বেশ কয়েকটি প্রস্তাব রয়েছে, এর মধ্যে সবচেয়ে বড় হলো, বিজেপি সরকার ভালোবাসা জিহাদ ও ভূমি জিহাদের বিরুদ্ধে একটি আইন আনবে।’

ঝাড়খন্ড ও মহারাষ্ট্রের সাম্প্রতিক নির্বাচনী প্রচারণায় বিজেপি নেতারা ওয়াক্‌ফ নিয়ে ভুয়া খবর ও মিথ্যা গল্প ছড়িয়ে হিন্দু জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভীতি জাগিয়ে সমাজকে মেরুকরণ করে নিজেদের ঝুলিতে ভোট পুরতে চেয়েছেন। বেশির ভাগ নির্বাচনী বক্তৃতায় অমিত শাহ ওয়াক্‌ফ ইস্যুটি সামনে আনেন। তিনি মিথ্যাভাবে দাবি করেন, ওয়াক্‌ফ বোর্ডকে ব্যবহার করে জনগণের সম্পত্তি দখল করা হয়। তিনি বলেন, ‘বিরোধীদের প্রতিরোধ থাকা সত্ত্বেও আমরা ওয়াক্‌ফ আইন সংশোধন করব।’ এসব বিবৃতি থেকে এটা পরিষ্কার যে বিজেপি সরকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে ওয়াক্‌ফ আইন সংশোধন করা।

২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে বিজেপি নির্বাচনী প্রচারণার সময় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে তারা এবারে ৪০০টির বেশি আসনে জিতলে ওয়াক্‌ফ আইন পুরোপুরি বাতিল করবে। এখন সরকার সংশোধনী বিল পেশ করেছে। বিজেপি নেতারা প্রকাশ্যে বলছেন, বিলটি দেশে ভূমি জিহাদ বন্ধে আনা হয়েছে।

এখানে উল্লেখ্য, প্রস্তাবিত বিলটিতে এমন সব বিধান বাতিল ও সংশোধনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, যেগুলো হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলো জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করার জন্য ব্যবহার করে আসছে। সরকারের দাবি হচ্ছে, সংশোধনীটির উদ্দেশ্য হচ্ছে ওয়াক্‌ফ সম্পত্তির ব্যবস্থাপনার উন্নত করা এবং মুসলমানদের উন্নয়নকে উৎসাহিত করা। যাহোক, ভারতের সাম্প্রতিক প্রবণতা অন্য কিছুর ইঙ্গিত করে।

ভারতের ওয়াক্‌ফ সম্পত্তি

ভারতের ৩২টি ওয়াক্‌ফ বোর্ড রয়েছে। জাতীয় পর্যায়ে ওয়াক্‌ফ সম্পত্তি রক্ষার জন্য কেন্দ্রীয় ওয়াক্‌ফ কাউন্সিল স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা হিসেবে পরিচালিত হয়। ৩২টি ওয়াক্‌ফ বোর্ড প্রায় দশমিক ৮৭ লাখ ওয়াক্‌ফ সম্পত্তি দেখভাল করে। সম্প্রতির পরিমাণ প্রায় দশমিক ৯৪ লাখ একর।

মজার ব্যাপার হলো, ওয়াক্‌ফ বোর্ডের বিরুদ্ধে ভূমি জিহাদের অভিযোগ করা হচ্ছে। অথচ সেই বোর্ডগুলো প্রচুর সম্পত্তি হারিয়েছে। গত ২৮ নভেম্বর কেন্দ্রীয় সংখ্যালঘুবিষয়ক মন্ত্রী কিরেন রজ্জু লোকসভায় জানান, ৫৪ হাজার ৯২৯টি ওয়াক্‌ফ সম্পত্তি দখল হয়ে গেছে।

প্রকৃতপক্ষে বিজেপি নেতারা ও হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলো প্রস্তাবিত ওয়াক্‌ফ (সংশোধনী) বিল, ২০২৪-কে ভারতে ঘৃণা ছড়ানোর অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। এটাকে তারা অনেকটা উৎসবের মতো করে নিয়েছে।

  • আফশান খান ইস্তাম্বুলের সাবাহাতিন জাইম বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে পিএইচডি শিক্ষার্থী
    আফরোজ আলম শাহিল ভারতের লেখক ও সাংবাদিক
    মিডল ইস্ট মনিটর থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত