মতামত

একক ভর্তি পরীক্ষার কাঠামো: কারা সামলাবে, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন হবে কীভাবে

কারা কীভাবে ভর্তি প্রক্রিয়া সামলাবে?

এই লেখাটি যখন আমি লিখছি, তখন দেশের পত্র-পত্রিকায় খবর বের হয়েছে যে, কেন্দ্রীয়ভাবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্নাতকে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষ অধ্যাদেশ, ২০২৩ এর খসড়া চূড়ান্ত করেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। তবে সেটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রকাশ পাবে। তবে প্রথম আলোর খবর বলছে, ন্যাশনাল টেস্টিং অথরিটি (এনটিএ) গঠন করা সম্ভব না হওয়ায় আপাতত এই অধ্যাদেশের অধীনেই চলতি শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষা নেয়া হবে। ঠিক কবে নাগাদ পূর্ণাঙ্গ এনটিএ কার্যক্রম শুরু হবে তা স্পষ্ট নয়। যদিও এই ধরনের অধ্যাদেশের জন্য এর আগে মাননীয় রাষ্ট্রপতি ইউজিসিকে দায়িত্ব দিয়েছিল। আমি নিশ্চিত নয়, এই খসড়ায় ঠিক কী বলা আছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আইনগত জটিলতা এড়াতে খসড়াটি শিক্ষামন্ত্রণালয় হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য মাননীয় রাষ্ট্রপতি দপ্তর থেকে অধ্যাদেশ জারি হওয়ায় কাঙ্ক্ষিত হবে।

ভারতে যেহেতু একই নামে একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেখানে অথরিটির জায়গায় তাঁরা বলেছে ন্যাশনাল টেস্টিং এজেন্সি। এই এজেন্সির অধীনে দেশটির ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিকেল, সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক, স্নাতকোত্তরে আলাদা করে ভর্তি পরীক্ষায় আয়োজন করে যা কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। এর বাহিরে আরো কিছু পরীক্ষা কার্যক্রম দেখভাল করে প্রতিষ্ঠানটি। বাংলাদেশ যদি সেই আদলে ন্যাশনাল টেস্টিং অথরিটি হয়ে থাকলে, এই অথরিটি ঠিক কোন কোন ভর্তি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব নেবে তা জানতে হবে।

বাংলাদেশের মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ করে বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিল বা বিএমডিসি। এখন দেশের মেডিকেল কলেজগুলোতে এমবিবিএসের ভর্তি পরীক্ষা বিএমডিসির অধীনে যাবে না এনটিএ অধীনে যাবে তা নির্ধারণ করতে হবে। সারা বিশ্বের মেডিকেলের শিক্ষার্থীদের ভর্তি কার্যক্রম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে হয়ে থাকে কিন্তু বাংলাদেশে গত কয়েক দশক ধরে ভর্তি পরীক্ষা রয়েছে বিএমডিসির কাঁধে। সরকার যেহেতু একক ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করতে যাচ্ছে, সেহেতু এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষাও ঠিক একই কাতারে আনতে হবে।

প্রথমত আমি অনুকরণের বিপক্ষে। এনটিএ ভারত করেছে, সেটি যে আমাদেরও একই নামে করতে হবে কেন তা বোধগম্য নয়। আমরা ইচ্ছে করলে এনটিএ নামকরণের পরিবর্তে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অ্যাডমিশন কমিশন (বিইউএসি) অথবা অ্যাডমিশন অথরিটি ফর হাইয়ার এডুকেশন (এএএইচএ বা আহা) অথবা আন্ডারগ্রাজুয়েট অ্যাডমিশন অথরিটি (ইউজিএএ) নামকরণ করা যেতে পারে। এই সংস্থার অধীনে প্রকৌশল, মেডিকেল ও সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করা যেতে পারে।

কখন ভর্তি পরীক্ষা নেয়া হবে?

গত কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশের ভর্তি পরীক্ষাগুলোর দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এইচএসসি পরীক্ষার পর বছরের মাঝামাঝি সময়ে ভর্তি পরীক্ষা শুরু হয়। কিন্তু ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ করে ক্লাস শুরু হয় পরের বছর জানুয়ারি কিংবা মার্চে। যে কারণে আমাদের নীতি নির্ধারকরা কৌশলে ভর্তি সেশন ২০২২-২৩ কিংবা ২০২৩-২৪ লিখে। অথচ সেটি হওয়ার কথা নয়। একইভাবে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির সময়কাল দুই বছর। আঠারো মাসে পরীক্ষার আয়োজন করা হলেও কার্যত সেশন দুই বছর পার হয়ে যায়।

ধরুন এবার এসএসসি পাসকৃতরা ২০২৩-২০২৫ সেশনে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হলো। এখন আমরা যদি তাদের পরীক্ষা ২০২৬ নিয়ে ফেলি তাহলে সেটি চরম সময় অপচয় হয়। যা কখনোই কাম্য নয়। ২০২৫ সেশন শেষ মানে সেই বছরই এইচএসসি পরীক্ষা সম্পন্ন ও ফলাফল ঘোষণা করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি সময়সীমা থাকবে এইচএসসির ফলাফল ঘোষণার আগ পর্যন্ত। একজন শিক্ষার্থী ফলাফল ঘোষণার পরবর্তী ২/৩ মাসের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি সম্পন্ন করতে পারে, সেই ব্যাপারে নতুন 'একক ভর্তি' কার্যক্রমে তা মাথায় রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, ২০২৩ সেশন মানেই হলো, একজন শিক্ষার্থী উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে সেই বছরই ভর্তি প্রক্রিয়া সেরে একাডেমিক সেশনেই ক্লাস শুরু হওয়ার কথা। 'একক ভর্তি' পরীক্ষা শুরু আগে একটি প্রোফাউন্ড অ্যাকাডেমিক শিডিউল থাকা চাই, যা অনুসরণ করে বছরের কোন সময়ে ভর্তি পরীক্ষা নেয়া হবে, কতদিনের মধ্যে ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা একজন শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার আগে জানতে পারে।

হ্যাঁ, এই কথা সত্য আমাদের দেশে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগকালীন সময়ের দরুন শিক্ষার্থীদের পড়াশুনা থমকে যায়। সেইসব মাথায় রেখে সিডিউল নির্ধারণ করা উচিত। যাতে ২/১ সপ্তাহ আগ-পিছ হলেও চূড়ান্ত সেশনের ক্লাস সময়মত শুরু হয়।

ভর্তি পরীক্ষার দিন

যেহেতু একযোগে সারা দেশে কয়েকলাখ শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষায় বসবে, সেহেতু রাস্তাঘাটে যানজট কিংবা ভোগান্তি কমাতে ওইদিন সরকারিভাবে ঘোষণা দেয়া থাকবে যে অফিস, আদালত, শেয়ার মার্কেট, ব্যবসা-বাণিজ্যের শুরু নির্ধারিত সময়ের চেয়ে দুয়েক-এক ঘণ্টা পিছিয়ে শুরু হবে। ফলে ওইদিন রাস্তায় ভর্তিচ্ছুদের প্রাধান্য থাকবে। ভর্তি পরীক্ষা শেষের পর পরবর্তীতে অফিসগামী, কর্মজীবী মানুষ রাস্তায় নামবে। এরফলে ভর্তি পরীক্ষার কেন্দ্র ও তার আশে-পাশে যেমন কোলাহল কমবে, তেমনি যানজটবিহীন ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণ করতে সবপক্ষে সুবিধা পাবে।

যেভাবে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করা যেতে পারে

বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় যদি প্রকৌশল, বিজ্ঞান, কলা, বাণিজ্য আর মেডিকেলকে একই কাতারে আনা হয়, তাহলে সেই ক্ষেত্রে প্রশ্নপত্রে একটি বিভাগ থাকবে যেখানে যৌথ প্রশ্ন হিসেবে ভাষা জ্ঞান, সাধারণ জ্ঞান ও গণিতকে সন্নিবেশিত করা যেতে পারে আর একটি বিভাগে ঐশ্চিক বিষয় থাকবে যার উত্তরে মিলবে বিষয় ভিত্তিক বিভাগ। বিজ্ঞানে বিষয়ে পড়তে গেলে শিক্ষার্থীকে রসায়ন, বায়োলজি, পদার্থ ও গণিত যেমন বাধ্যতামূলক তেমনি বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হিসেবে কেউ যদি বাণিজ্য কিংবা কলা বিভাগে ভর্তি হতে চায়, সেই ক্ষেত্রে তাকে সামাজিক বিজ্ঞান, অর্থনীতি বিষয়ক প্রশ্নপত্র উত্তর দিতে হবে। যদিও আমাদের প্রচলিত উচ্চমাধ্যমিকে এই ধরনের সুযোগ রাখা হয়নি, তবে সেখানে ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে আগামী সিলেবাসে যেকোনো একটিতে অধ্যয়নের সুযোগ দেয়া যেতে পারে। তেমনি বাণিজ্য, কলার শিক্ষার্থীদের উচ্চমাধ্যমিকে পঠিত রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস, সামাজিক বিজ্ঞান, ম্যানেজমেন্ট প্রশ্ন সুযোগ মিলবে। এই ক্ষেত্রে ভর্তি পরীক্ষা এক ঘণ্টায় না হয়ে অন্তত ২ বা তিন ঘণ্টার করা যেতে পারে।

ভাষা জ্ঞান: বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষাগুলোতে স্বীয় দেশের ভাষার দক্ষতায় গুরুত্ব কম দেয়া হয়। এমনকি বাংলা বিষয়ক প্রশ্নপত্র থাকলেও সেটি অনেকক্ষেত্রে ঐচ্ছিক পর্যায়ে থাকে। যে-সব দেশ সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করে আসছে, তাঁদের দিকে আপনি যদি তাকান তাহলে দেখবেন, তাঁরা মাতৃভাষার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছে। কারণ, সেই সব দেশের উচ্চশিক্ষা ইংরেজির পাশাপাশি অনেকটায় মাতৃভাষায় প্রদান করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মাতৃভাষায় ভারত, চীন, জাপান, কোরিয়া, রাশিয়ায় পাঠ্যপুস্তক থাকায় তাদের সুবিধা থাকায় ভর্তি পরীক্ষায় একজন শিক্ষার্থীর যোগ্যতা নিরুপণে মাতৃভাষার দক্ষতার প্রতি জোর দেয়া হয়। কিন্তু আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিশেষ করে বিজ্ঞানে মাতৃভাষায় এখনো উপযুক্ত পাঠ্যপুস্তক না থাকায় ভর্তি পরীক্ষায় মাতৃভাষার দক্ষতা যাচাইও ম্রিয়মাণ হয়ে পড়েছে। তবে নিজ দেশের মাতৃভাষার দক্ষতার জন্য অন্তত ভর্তি পরীক্ষায় ভাষা বিষয়ক প্রশ্ন থাকা আবশ্যিক। এর বাহিরে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত বিদেশি ভাষা হিসেবে ইংরেজির দক্ষতা যাচাই বাধ্যতামূলক। এই ক্ষেত্রে এইক্ষেত্রে যদি আমাদের সম্ভব হতো, তাহলে ইংলিশ প্রোফিসিয়েন্সি টেস্টগুলোর স্কোর রাখা যেত। আরবি, ফারসি বিভাগুলোতে যেহেতু অনেক শিক্ষার্থী পড়াশুনা করে, সেহেতু ভর্তি পরীক্ষার সময় এইসব ভাষাও রাখা যৌক্তিক কিনা তা ভাবতে হবে।

সাধারণ জ্ঞান: দেশ ও বিশ্ব পরিচিতির ধারণা প্রতিটি শিক্ষার্থীর থাকা উচিত। তবে এই ক্ষেত্রে অমুক রাজধানী, তমুক মুদ্রা, যুদ্ধ, সেনাপতির নামের চেয়ে বরং প্রশ্ন থাকা উচিত বিশ্ব সভ্যতায় বিজ্ঞান, বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার, বাণিজ্যে ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের রেখাপাত জানা প্রয়োজন। নিজ দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতির জ্ঞান অন্তত পরবর্তীতে একজন শিক্ষার্থীর স্বদেশ ভাবনা যেমন প্রকট হয়ে উঠে তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর বিশ্ব মানবের কাঠগড়ায় নিজেদের মেলে ধরতে সহায়তা করতে পারে। আর জন্য একটি মৌলিক সিলেবাস কাঠামো থাকা প্রয়োজন।

গণিত: অর্থনীতি, বাণিজ্য, বায়োলজিক্যাল সায়েন্স ও প্রকৌশল বিষয়ক কোর্সগুলোর জন্য গণিত জানা অনেকটাই বাধ্যতামূলক। বলতে গেলে, গণিত ছাড়া প্রকৌশল বিদ্যায় জ্ঞান অর্জন অনেকটায় অসম্ভব। তাই এই বিষয়ে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের সম্মুখ ও যৌক্তিক জ্ঞান থাকা জরুরি। কিন্তু আমাদের দেশে দীর্ঘদিন ধরে উচ্চমাধ্যমিকে গণিত চর্চা কেবল বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের কাঁধে ন্যস্ত ছিল। ফলশ্রুতিতে কলা কিংবা বাণিজ্যের বিভাগগুলোতে শিক্ষার্থীরা ভর্তির পর নতুন করে ক্যালকুলাস, নির্ণায়ক করতে শিখে, যা তাঁদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। আগামী শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় গণিত জানার কোন বিকল্প নেই। আর এর জন্য উচ্চমাধ্যমিক থেকে গণিত বিষয় সব শ্রেণির শিক্ষার্থীর জন্য বাধ্যতামূলক করা উচিত। আর সেটি করা গেলে, আগামীতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় গণিত ভর্তি  বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়নে গাণিতিক প্রশ্নের সমাধানের দক্ষতার উপর ভিত্তি করে শিক্ষার্থীকে প্রকৌশল বিদ্যায় অধ্যয়নের সুযোগ দেয়ার বিষয় আসতে পারে।

আগামীতে যেহেতু পাবলিক পরীক্ষা কমে আসছে, সেহেতু এসএসসি ও এইচএসসি ফলাফল কেবল ভর্তির আবেদন যোগ্যতা ও এইচএসসিতে বিষয় ভিত্তিকে প্রাপ্ত গ্রেড বা মার্ক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এবং তাদের বিভাগগুলোতে ভর্তির যোগ্যতা নির্ধারণে ব্যবহার করা যাবে। আবেদনের সময় শিক্ষার্থীদের পছন্দের ক্রম উল্লেখ করতে হবে। যেমন প্রকৌশল, মেডিকেল ও সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়। প্রাপ্ত স্কোর ও বিভাগগুলোর দেয়া বিষয়ভিত্তিক নম্বরের শর্তপূরণ সাপেক্ষে ভর্তি পরীক্ষার স্কোর, র‍্যাংক, বিশ্ববিদ্যালয় পছন্দক্রম ফলাফলে চলে আসবে।

ধরুন ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে গণিতে দুইটি (এ ও বি) বিভাগে মোট ৩০ টি প্রশ্ন থাকবে। একটিতে ১০ টি আর অপরটিতে ২০ টি। চারটি অপশনে এমসিকিউ আকারে এই ১০ টি প্রশ্ন কিছুটা সহজ হবে যার মধ্যে দিয়ে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার যোগ্যতার জন্য সকল ভর্তিচ্ছুদের কমপক্ষে ৫/৭ টি সঠিক উত্তর দেয়া প্রয়োজন। আর বাকী ২০ টি প্রশ্ন থাকবে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্টান্ডার্ডে কিছুটা জটিল। আর এই প্রশ্নগুলোর মধ্যে থেকে সর্বোচ্চ সঠিক উত্তর প্রদানকারীদের মধ্যে থেকে শর্টলিস্ট করে ভর্তি পরীক্ষার ফরমে দেয়া পছন্দের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ক্রমনুসারে ভর্তির ফলাফল ঘোষণা করা যেতে পারে। যেহেতু প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ব্যতীত দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকৌশল বিষয়ক বিভাগ রয়েছে, সেহেতু সেখানেও একই ক্রম অনুসারে বিভাগগুলোতে অগ্রাধিকার পাবে।

বায়োলজি, রসায়ন ও পদার্থ: কিছুদিন আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ভিডিও ইতিরকম সরগরম হতে দেখেছিলাম। হালের এক অনলাইন সেলিব্রেটি মোটিভেশন্যাল বক্তব্য দিতে গিয়ে বলে ফেলছেন, যাঁরা ডাক্তার হতে চাও, কেবল তাঁরাই বায়োলজি পড়, আর যাঁরা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বে তাঁদের বায়োলজি পড়ার প্রয়োজন নেই।এই বক্তব্যটি কেবল তাঁর ব্যক্তিগত কল্পনাপ্রসূত হলেও দীর্ঘদিন ধরে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় ইতিরকম এই রেওয়াজই চলে এসেছে। মেডিকেলে ভর্তিচ্ছুদের গণিত বিষয়ে ভর্তি পরীক্ষায় প্রস্তুতি গ্রহণ করার দরকার পড়ে না। আর প্রকৌশলবিদ্যায় আগ্রহী ভর্তিচ্ছুদের বায়োলজি পড়ার দরকার নেই।

ভর্তি পরবর্তী পড়াশুনার অভিজ্ঞতায় হয়ত বিষয় ভিত্তিক এইসব পড়াশুনায় গণিত কিংবা বায়োলজিক্যাল পড়াশুনার প্রয়োজন হয়ে উঠে না, তবে এইসব বিষয় সামগ্রিক জ্ঞান থাকা যে জরুরি তা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতি নির্ধারকদের জানা প্রয়োজন। বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাইভারসিটি জ্ঞান অর্জন করে যাচ্ছে। ধরুন, কেউ একজন কম্পিউটার সায়েন্সে স্নাতক সম্পন্ন করছে, পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ চুকানোর পর তিনি নিউরোসায়েন্স নিয়ে গবেষণা করছেন, কিংবা বায়োমেডিক্যাল ইনস্টিটিউট বা কোম্পানিতে জব করছেন। এখন এইসব জায়গায় যেতে হলে বেসিক বায়োলজিক্যাল জ্ঞান থাকা অনেকটাই বাধ্যতামূলক।

তাই বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় বায়োলজি, রসায়ন ও পদার্থ উপর প্রশ্নের উত্তর বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। একইভাবে প্রতিটি বিষয়ে দুই বিভাগে (এ ও বি) প্রশ্ন থাকবে, একটিতে তুলনামূলক সহজ আর অন্যটিতে বিশ্লেষণমূলক। ৩০ টি প্রশ্নের প্রথম বিভাগ (এ) ১০ টি প্রশ্নের উত্তরের মধ্যে কমপক্ষে ৫ টি সঠিক হওয়া প্রয়োজন আর ২০ টি প্রশ্নের উত্তরে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীর মিলবে ফার্মেসি, রসায়ন, প্রাণরসায়ন, প্রাণিবিদ্যা, বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিংসহ বিভিন্ন বিষয়।

এই আলোচনা উদাহরণ হিসেবে কেবল বিজ্ঞানের বিষয়গুলোই আলোকপাত করা হয়েছে। একই ভাবে কলা, ও বাণিজ্যের বিষয়গুলো প্রশ্ন প্রণয়ন করা হবে।

যেভাবে স্কোর ও বিশ্ববিদ্যালয় নির্ধারণ করা যেতে পারে

ভর্তি পরীক্ষার প্রাপ্তস্কোরকে ভর্তির নিট স্কোরকে মুখ্য হিসেবে ধরতে হবে। কারণ, একজন শিক্ষার্থীর এসএসসি ও এইচএসসি জিপিএ স্কোরিং করে ভর্তি পরীক্ষার স্কোরে সংযোজন কিছুতেই ভর্তি পরীক্ষার যাচাইয়ের মানদণ্ড হতে পারে না। এর ফলে অনেক সময় নানা কারণে মেধাবী শিক্ষার্থীরা জিপিএ খারাপ করলেও ভর্তি পরীক্ষায় ভাল করার পরও পিছিয়ে পড়ে।  যা নৈতিকভাবে কখনোই সমর্থনযোগ্য নয়। অথচ এইসব ছেলে-মেয়ে পরবর্তীতে স্নাতক-স্নাতকোত্তরে মেধার সাক্ষর রেখে যায় বরং ওইসব জিপিএর চেয়ে প্রাকৃতিক মেধা যাচাই সৃজনশীল ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে অনেক মেধাবীদের ঝরে পড়া থামানো সম্ভব।

আগামীতে যেহেতু পাবলিক পরীক্ষা কমে আসছে, সেহেতু এসএসসি ও এইচএসসি ফলাফল কেবল ভর্তির আবেদন যোগ্যতা ও এইচএসসিতে বিষয় ভিত্তিকে প্রাপ্ত গ্রেড বা মার্ক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এবং তাদের বিভাগগুলোতে ভর্তির যোগ্যতা নির্ধারণে ব্যবহার করা যাবে। আবেদনের সময় শিক্ষার্থীদের পছন্দের ক্রম উল্লেখ করতে হবে। যেমন প্রকৌশল, মেডিকেল ও সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়। প্রাপ্ত স্কোর ও বিভাগগুলোর দেয়া বিষয়ভিত্তিক নম্বরের শর্তপূরণ সাপেক্ষে ভর্তি পরীক্ষার স্কোর, র‍্যাংক, বিশ্ববিদ্যালয় পছন্দক্রম ফলাফলে চলে আসবে।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আসন পূরণের পরই শিক্ষার্থীদের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধীন কলেজগুলোতে ভর্তি কার্যক্রম শুরু করবে। এই ক্ষেত্রে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ওগুলো একই পরীক্ষার স্কোরে শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পাবে।

আমি কেবল প্রস্তাবনাগুলো দিয়ে গেলাম। আমার মত অনেক শিক্ষানুরাগী মানুষের ভাবনা আছে। সেইগুলোকে সমন্বয়ের সুযোগ দেয়া উচিত। আমার বিশ্বাস ইউজিসি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একক ভর্তি পরীক্ষা আয়োজনে দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়ে একটি স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করবে।

  • ড. নাদিম মাহমুদ গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ই–মেইল: nadim.ru@gmail.com