ট্রাম্প দোষী সাব্যস্ত হলে তাঁকে কারাদণ্ডে দণ্ডিত করাও যেতে পারে।
ট্রাম্প দোষী সাব্যস্ত হলে তাঁকে কারাদণ্ডে দণ্ডিত করাও যেতে পারে।

কাঠগড়ায় রাজা ডোনাল্ড ট্রাম্প

নিউইয়র্ক সিটির আদালতকক্ষে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অভিনীত যে নাটকটি এখন চলছে, সেটিকে আর দশটা সাধারণ ফৌজদারি বিচার বলা যাবে না। এটি তার চেয়ে বেশি কিছু। আদতে এটি পরস্পরবিরোধী দুটি আদর্শের মধ্যকার লড়াই।

এই লড়াইয়ের এক পক্ষে আছে আইনের একটি উদার গণতান্ত্রিক ধারণা। অন্য পক্ষে আছে এমন একটি অনুদার ধারণা, যা বিদ্যমান আইনি ব্যবস্থার বাইরে একটি একগুঁয়ে কর্তৃত্বের প্রতিনিধিত্ব করে।

আমরা সাধারণভাবে ফৌজদারি মামলার কার্যক্রমকে যে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখে থাকি, সেখান থেকে বিবেচনা করলে বলা যায়, এখানে আমেরিকার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আসামি হওয়া একজন সাবেক প্রেসিডেন্টের (এবং বর্তমান প্রেসিডেন্ট প্রার্থী) বিচারের মধ্যে পুরো বিষয়টি সীমাবদ্ধ থাকছে না।

এর বাইরে ফৌজদারি মামলা হিসেবেও এর আলাদা গুরুত্ব আছে।

ট্রাম্পের সঙ্গে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হওয়ার বিষয়ে মুখ না খোলার জন্য পর্ন অভিনেত্রী স্টর্মি ড্যানিয়েলসকে ট্রাম্পের প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ দেওয়া হয়েছিল এবং সে-সংক্রান্ত নথিপত্র নষ্ট করতে ট্রাম্প ইচ্ছাকৃত ও বেআইনিভাবে তাঁর নিজস্ব ব্যবসায়িক রেকর্ডে মাজাঘষা করেছিলেন—বিষয়টি সরকারি কৌঁসুলিরা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

রাষ্ট্রপক্ষ আরও দাবি করছে, ‘হাশ মানি’ বা মুখ বন্ধ রাখার অর্থকে ট্রাম্প ও তাঁর আইনজীবীরা ‘লিগ্যাল ফি’ বা আইনানুগ প্রাপ্য পারিশ্রমিক হিসেবে দেখিয়েছিলেন এবং এর মাধ্যমে তাঁরা ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারাভিযানের শেষ দিনগুলোয় প্রার্থী সম্পর্কে জনসাধারণের কাছে প্রাসঙ্গিক তথ্য গোপন করেছিলেন।

এসব অভিযোগ প্রমাণ করার পাশাপাশি যদি কৌঁসুলিরা এটিও প্রমাণ করতে পারেন যে ট্রাম্পের এসব কাজ তাঁর কর জালিয়াতি কিংবা প্রচার-সংক্রান্ত জমাখরচের হিসাবের আইন লঙ্ঘনের মতো অন্যান্য বেআইনি কার্যকলাপকেও বেগবান করেছিল, তাহলে তাঁর প্রাথমিক অপরাধটি একটি ছোট অপকর্ম থেকে বড় একটি অপরাধে রূপ নেবে।

সেটি হলে ট্রাম্পের অপরাধ সবার সামনে প্রকাশিত হবে। আর তিনি দোষী সাব্যস্ত হলে তাঁকে কারাদণ্ডে দণ্ডিত করাও যেতে পারে।

তবে প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি এটি ব্যাখ্যা করা কঠিন যে প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার হিসেবে ওয়াশিংটনে শক্তিশালী অবস্থানে থাকা মাইক জনসনের নেতৃত্বে রিপাবলিকান কর্মকর্তাদের একটি বড় গোষ্ঠী কেন ট্রাম্পের বিচারের সময় আদালতে উপস্থিত হচ্ছেন।

জনসনের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন ফ্লোরিডার সিনেটর রিক স্কট (যিনি আগামী নভেম্বরে পুনর্নির্বাচনের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন) এবং ওহাইওর সিনেটর জে ডি ভ্যান্স, যাঁকে ব্যাপকভাবে ভাইস প্রেসিডেন্টের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখা যাচ্ছে।

এ ছাড়া আলাবামার সিনেটর টমি টিউবারভিল, নর্থ ডাকোটার গভর্নর ডগ বার্গাম, কলোরাডো থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য লরেন বোয়েবার্ট, জর্জিয়া থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য মার্জরি টেলর গ্রিন, ফ্লোরিডা থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য বায়রন ডোনাল্ডস ও কোরি মিলস, নিউইয়র্ক থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য নিকোল ম্যালিওটাকিস, রিপাবলিকান পার্টি থেকে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা বিবেক রামস্বামী ট্রাম্পের প্রতি সমর্থন জানাতে আদালতে উপস্থিত হয়েছিলেন।

রিপাবলিকান পার্টির মনোনীত প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ও দলের কার্যত নেতা হিসেবে ট্রাম্পের চারপাশে উপস্থিত থেকে তাঁর প্রতি রাজনৈতিক সমর্থন দেওয়ার এই ‘জাতীয় প্রদর্শন’কে কেউ কেউ যুক্তিযুক্ত বলে দাবি করতে পারে।

যদ্দুর মনে হয়, আইনগত দিক থেকে তা অশুদ্ধ কিছু নয়। কিন্তু আদালতে তাঁদের এ ধরনের উপস্থিতির যে প্রভাব, তা প্রচলিত পক্ষপাতমূলক রাজনীতির বাইরেও বড় ধরনের ভূমিকা রাখে।

এই উপস্থিতির মধ্য দিয়ে ট্রাম্পের মিত্ররা যদি আনুগত্য প্রকাশ করে থাকেন, তাহলে সংগত কারণেই প্রশ্ন উঠবে, তাঁদের এই আনুগত্য ঠিক কিসের প্রতি? কার প্রতি?

এ কথা মনে আসতেই পারে যে তাঁদের এই সংহতি প্রদর্শনের অর্থ হলো, রাজনৈতিক শত্রুরা, বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তাঁর সর্বোচ্চ নির্বাহী ক্ষমতার অপব্যবহার করে ট্রাম্পকে পাতানো বিচারের মাধ্যমে ভিকটিম বানানো হচ্ছে বলে ট্রাম্প যে নির্লজ্জ দাবি করে আসছেন, তাকেই অন্ধভাবে সমর্থন দেওয়া।

ট্রাম্প সম্প্রতি একটি সমাবেশে বলেছেন, ‘জো বাইডেন এবং তাঁকে নিয়ন্ত্রণ করা ফ্যাসিবাদীরাই গণতন্ত্রের জন্য সত্যিকারের হুমকি। তাঁরা ডিওজে (ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস), এফবিআই (ফেডারেল ব্যুরো ইনভেস্টিগেশন) এবং আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে যাচ্ছেন। তাঁরা আমাদের নির্বাচনে কারচুপি করেছেন এবং বাক্‌স্বাধীনতাকে আক্রমণ করেছেন...তাঁরা নির্বাচন কারচুপি করা লোকদের ধরতে মোটেও আগ্রহী নন।’

ট্রাম্প ঠিক এই ধরনের অভিপ্রায়ের ইঙ্গিত ইতিমধ্যে দিয়েছেনও। তিনি বলেছেন, ‘(আমি) যদি প্রেসিডেন্ট হই এবং দেখি আমাকে কেউ খারাপভাবে আক্রমণ করছে, তাহলে আমি তাদের (এফবিআই ও বিচার বিভাগকে) বলব, যাও তাদের ধরো, তাদের অভিযুক্ত করো। আমি প্রেসিডেন্ট হলে তাদের বেশির ভাগই তাদের চাকরি হারাবে। তাদের বের করে দেওয়া হবে, তারা নির্বাচনের বাইরে থাকবে।’

ট্রাম্পের ভাষ্য অনুযায়ী, যদি ‘দৈত্য’ সত্যি সত্যি ‘বাক্সের বাইরে’ চলে এসে থাকে, অর্থাৎ যদি আইনের শাসন সত্যিই অচল হয়ে গিয়ে থাকে এবং বাইডেন সরকার যদি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য বিচার বিভাগকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন, তাহলে সুযোগ পেলে অন্য পক্ষ কেন সেই রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিজেদের ‘ওষুধ’ হিসেবে ব্যবহার করবে না?

ট্রাম্প ঠিক এই ধরনের অভিপ্রায়ের ইঙ্গিত ইতিমধ্যে দিয়েছেনও। তিনি বলেছেন, ‘(আমি) যদি প্রেসিডেন্ট হই এবং দেখি আমাকে কেউ খারাপভাবে আক্রমণ করছে, তাহলে আমি তাদের (এফবিআই ও বিচার বিভাগকে) বলব, যাও তাদের ধরো, তাদের অভিযুক্ত করো। আমি প্রেসিডেন্ট হলে তাদের বেশির ভাগই তাদের চাকরি হারাবে। তাদের বের করে দেওয়া হবে, তারা নির্বাচনের বাইরে থাকবে।’

এভাবেই রাজনৈতিক গুন্ডামি স্বাভাবিক হয়ে উঠতে থাকে।

এ ক্ষেত্রে চিরাচরিত কৌশলটি হলো, প্রথম দিকে আপনার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর আপনি যে নিপীড়ন করেন, তা নিজের সমর্থকদের সামনে তুলে ধরুন, যাতে আপনার আচরণকে অন্তত সমর্থকদের কাছে ন্যায়সংগত করে তোলা যায়।

তারপর যখন আপনার অপরাধমূলক কাজগুলো সবার সামনে ধরা পড়ে যাবে, তখন আপনার অপরাধমূলক অভিযোগগুলোকে নিজের গায়ে নিয়ে সেটিকে ‘সম্মানসূচক পদক’ বলে অভিহিত করুন এবং ট্রাম্পের মতোই নিজেকে ভিকটিম হিসেবে তুলে ধরে তাঁর সঙ্গে সমর্থকদেরও জড়িয়ে ফেলুন।

ট্রাম্প যেমনটা বলেছেন, ‘আপনাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্যই আজ আমাকে ভিকটিম বানানো হচ্ছে।’

ট্রাম্প যে ধরনের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব হাতের মুঠোয় নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা করেন, তা নিচ থেকে ওপরের দিকে উঠে আসা সর্বস্তরের জনগণের ক্ষমতার উদার গণতান্ত্রিক বোধের সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক।

সার্বভৌম ক্ষমতার ব্যক্তিকেন্দ্রিক দাবি ট্রাম্পের কর্তৃত্ববাদী বক্তব্যে প্রতিধ্বনিত হয়: ‘আমিই তোমাদের ন্যায়বিচার, আমিই ইনসাফ...আমিই তোমাদের প্রতিশোধ।’

যে জনগণ স্বাধীনভাবে তাঁদের রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের হাতে তাঁদের ক্ষমতা অর্পণ করতে (বা তাঁদের কাছ থেকে ক্ষমতা প্রত্যাহার করে নিতে) চান, সেই জনগণের স্বাধীনতার চেতনার সঙ্গে ট্রাম্পের আকাঙ্ক্ষা সাংঘর্ষিক হয়ে পড়ে।

ট্রাম্প এমন একটি অনুদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অভিলাষ পোষণ করেন, যেখানে ক্ষমতা জনগণ থেকে শীর্ষে অবস্থানরত সর্বোচ্চ নেতার কাছে যায় না, বরং শীর্ষে থাকা নেতার কাছ থেকে নিচের দিকে চুইয়ে পড়ে।

সেখানে সর্বোচ্চ নেতা দাবি করেন, একমাত্র তিনিই জনগণের সম্মিলিত ইচ্ছাকে মূর্ত করার ক্ষমতা রাখেন এবং জনগণের ক্ষমতায়নকে বাস্তবে রূপ দিতে পারেন।

সার্বভৌম ক্ষমতার এ ধরনের ব্যক্তিকেন্দ্রিক দাবি ট্রাম্পের কর্তৃত্ববাদী বক্তব্যে প্রতিধ্বনিত হয়: ‘আমিই তোমাদের ন্যায়বিচার, আমিই ইনসাফ...আমিই তোমাদের প্রতিশোধ।’

সুতরাং, যখন উচ্চপদস্থ রাজনীতিবিদ ও ক্ষমতার দালালেরা সাবেক প্রেসিডেন্টের সঙ্গে একাত্মতা প্রদর্শনের জন্য আদালতে উপস্থিত হন, তখন আর এটিকে প্রচলিত ফৌজদারি বিচারের পটভূমিতে স্বাভাবিক রাজনীতি বলে চালানো যায় না।

এই অনুগত ব্যক্তিরা মার্কিন সংবিধান এবং আইনের শাসনের ঊর্ধ্বে থাকতে চাওয়া একটি বিকল্প অনুদার শক্তিকে বৈধতা দিতে তাঁদের সম্মতিসূচক ইঙ্গিত দিচ্ছেন। সেই শক্তির উৎস হলেন একজন ব্যক্তি। তিনি ট্রাম্প।

আজ সহজেই অনুমান করা যাচ্ছে, রাজতন্ত্রবিরোধী যে নেতারা আজকের উদার আমেরিকাকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তাঁরা যদি জানতেন একজন প্রেসিডেন্ট সপ্তদশ শতকের একজন নিরঙ্কুশবাদী শাসকের (ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুই) ‘আমিই রাষ্ট্র, আমিই জাতি’ উক্তিটিকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার অভিলাষ পোষণ করছেন, তাহলে তাঁরা কতটা হতবাক হতেন।

  • স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
    অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
    রিচার্ড কে শেরউই নিউইয়র্ক ল স্কুলের আইনের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও রাজনীতিবিষয়ক লেখক।