সোশ্যাল মিডিয়া কি স্বৈরশাসকদের জন্য সহায়ক

যেসব দেশে গণতন্ত্র নেই, কিংবা সীমিত গণতন্ত্র চর্চা হয়, সেখানে মতপ্রকাশের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে সোশ্যাল মিডিয়া অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

সোশ্যাল মিডিয়াকে কেন্দ্র করে অনেক আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে। আরব বিশ্বে স্বৈরশাসকদের ভিত নাড়িয়ে দিয়ে যে ‘আরব বসন্তের’ সূচনা হয়েছিল, সেখানে সোশ্যাল মিডিয়া অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ দীর্ঘ ১৫ বছরের স্বৈরশাসন অবসানের ক্ষেত্রেও সোশ্যাল মিডিয়া ভূমিকা ছিল। প্রচলিত গণমাধ্যমে সরকারের নজরদারি থাকার কারণে আন্দোলনকারীরা সোশ্যাল মিডিয়াকেই তাদের কর্মসূচি ঘোষণা ও যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছিল।

সেই অর্থে অনেকেই মনে করে সোশ্যাল মিডিয়া মতপ্রকাশ, বাক্‌স্বাধীনতা এবং জনগণের দাবিদাওয়া তুলে ধরার তথা গণতন্ত্র চর্চার অন্যতম মাধ্যম; কিন্তু এটা যে স্বৈরশাসকদেরও হাতিয়ার হতে পারে, সে রকম ব্যাখ্যা দিয়েছেন সেভা গানিতস্কি। তিনি তাঁর প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রবন্ধে দেখিয়েছেন অটোক্র্যাট, ডিক্টেটর বা কর্তৃত্ববাদী শাসকদের স্থিতিশীলতার জন্য সোশ্যাল মিডিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

বাংলাদেশে, তুরস্ক, হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ডের মতো দেশগুলোতে কর্তৃত্ববাদী শাসনের স্থায়িত্ব লক্ষ্য করা গেছে। এসব দেশে শাসকেরা সোশ্যাল মিডিয়াকে তাঁদের পক্ষে ব্যবহারের চেষ্টা করেছেন নানাভাবে। স্বৈরতান্ত্রিক দেশে সাধারণত মতপ্রকাশের আনুষ্ঠানিক মাধ্যমগুলো কাজ করে না।

বিশেষ করে বিরোধী রাজনৈতিক দল এবং সাধারণ নাগরিকেরা বিভিন্ন ইস্যুতে স্বাধীনভাবে তাঁদের মতপ্রকাশ করতে পারেন না। তবে সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে জনগণ বিকল্প পদ্ধতিতে সরকারের সমালোচনা করে।

এই প্রক্রিয়ায় জনগণ বিভিন্ন বিষয়ে তাদের ক্ষোভ জানাতে পারলেও সেভা গানিতস্কে দেখিয়েছেন, এতে চূড়ান্তভাবে লাভবান হয় সরকার। বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিভিন্ন দাবিতে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় উঠলে সরকার সে ব্যাপারে কিছু কিছু পদক্ষেপ নেয়। কিছু সমস্যার ত্বরিত সমাধানও করে।

ফলে ভোটহীন কিংবা জন-সমর্থনহীন সরকারের পক্ষে জনমত গড়ে ওঠে। জনগণ এই বলে সন্তোষ অনুভব করে যে সরকার তো আমাদের কথা শুনছে। এটাকে সরকার কাজে লাগিয়ে তার শাসনকে দীর্ঘস্থায়ী করে।

গানিতস্কে দেখিয়েছেন, আরব বসন্তের সময় সোশ্যাল মিডিয়া গণতন্ত্র বিকাশের একটি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার হলেও বর্তমানে একনায়কদের একটি দরকারি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

সাধারণত মনে করা হয়, একনায়করা তথ্যের অবাধপ্রবাহ বন্ধ করে সমাজ ও জনগণের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার চেষ্টা করে। কিন্তু গানিতস্কি দেখিয়েছেন, একনায়কেরা একটু ভিন্নভাবেই তাঁদের শাসনের স্বার্থে সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করেন। তিনি দেখিয়েছেন, রাশিয়া, চায়না ও মধ্যপ্রাচ্যের মতো দেশগুলোতে একনায়ক সরকার তাদের শাসনকে দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য চারভাবে সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে। এ ক্ষেত্রে কয়েকটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।

প্রথমত, বিভিন্ন বিষয়ে জনগণের ক্ষোভ এবং জনগণের অগ্রাধিকারগুলো জানার জন্য একনায়কদের কাছে সোশ্যাল মিডিয়া সবচেয়ে নিরাপদ ও সহজ মাধ্যম।
স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় মতপ্রকাশের স্বাধীনতা না থাকা এবং ভিন্নমত দমনের ফলে একনায়কেরা জনগণের চিন্তা সম্পর্কে জানতে পারেন না।

এ ছাড়া এ ধরনের সরকার ব্যবস্থায় জনগণ তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামত ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে বা কৌশলে উপস্থাপনের কারণে শাসক বুঝতে পারেন না যে কখন নীরব জনগণ প্রতিবাদী হয়ে উঠবে।

সোশ্যাল মিডিয়া একজন স্বৈরশাসককে এ ক্ষেত্রে জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি জানতে সহায়তা করে। দ্যি পিপলস ডেইলিতে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সেই সময়কার চীনের প্রেসিডেন্ট হু জিন তাও বলেছিলেন,‘জনগণের উদ্বেগ বোঝার জন্য ইন্টারনেট একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম’।

এ ছাড়া পুতিন সরকার রাশিয়ার সাধারণ জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি জানার জন্য ইন্টারনেটের ওপর নজর রাখে। এভাবে সোশ্যাল মিডিয়া একনায়কদের জনগণের প্রকৃত দৃষ্টিভঙ্গি এবং সম্ভাব্য অস্থিতিশীল অবস্থা জানতে সাহায্য করে।

দ্বিতীয়ত, সোশ্যাল মিডিয়া স্থানীয় পর্যায়ে সরকারি কর্মকর্তা ও প্রতিনিধিদের কার্যকরতা মূল্যায়ন করার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। সাধারণত স্থানীয় পর্যায়ে কর্মকর্তারা স্থানীয় জনগণের কাছে জবাবদিহি করেন না।

এ ছাড়া কেন্দ্রীয় সরকার স্থানীয় কর্মকর্তা এবং স্থানীয় প্রতিনিধিদের কাজ, কর্মক্ষমতা এবং জনপ্রিয়তা সম্পর্কে পুরোপুরি খবর রাখে না। মতপ্রকাশের অবাধ স্বাধীনতা ও অবাধ নির্বাচন না থাকার কারণে স্থানীয় প্রতিনিধিরা (কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধি) কোনো ধরনের দায়বদ্ধতা ছাড়াই তাদের কাজ পরিচালনা করে।

ফলে স্থানীয় পর্যায়ে দুর্নীতি বৃদ্ধি ও জনগণের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয় যা সামগ্রিকভাবে সরকারের বৈধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে।
জনগণ কর্তৃক সোশ্যাল মিডিয়ায় স্থানীয় সমস্যা তুলে ধরার কারণে এসব স্থানীয় কর্মকর্তাদের জনগণের কাছে এবং তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে জবাবদিহি করার একটা সুযোগ তৈরি হয়।

স্থানীয় পর্যায়ে দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং সমস্যা সমাধান প্রকারান্তরে কেন্দ্রীয় সরকারকে অধিক সংবেদনশীল ও সাড়া প্রদানকারী হিসেবে উপস্থাপন করে যা চূড়ান্ত পর্যায়ে জনগণের কাছে কেন্দ্রীয় সরকারের কার্যকারিতা ও বৈধতা বাড়ায়।

তৃতীয়ত, সোশ্যাল মিডিয়া শাসকের জন্য তাদের সমর্থকদের কাছে পৌঁছানোর একটি কার্যকর মাধ্যম। বিরোধী দল যেমন করে প্রতিবাদকারীদের একত্রিত করে, শাসকও সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে তাদের সমর্থক ও জোটকে সংগঠিত করে এবং দেশপ্রেমের কথা বলে সাধারণ জনগণকে প্রভাবিত করে।

কিছু শাসক আছেন (যেমন রাশিয়া ও চীনে) যাঁরা জনগণের সমর্থন ও বৈধতা ছাড়া ক্ষমতায় থাকেন। এই শাসকেরা অর্থনৈতিক উন্নতি, দেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদ ইত্যাদির পাশাপাশি পরাশক্তিদের বিরুদ্ধে কথা বলে জনপ্রিয়তা বাড়ানো চেষ্টা করে।

এ ক্ষেত্রে তাঁরা সোশ্যাল মিডিয়াকে সর্বোচ্চ ব্যবহার করেন। এসব শাসকেরা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে তাঁদের সমর্থকদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন। ২০১১ সালে পুতিন বলেছিলেন ইন্টারনেট সমর্থক বাড়ানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।

চতুর্থত, সোশ্যাল মিডিয়া যেকোনো বিষয়ে জনগণের মধ্যে ‘ডিসকোর্স’ বা ‘ন্যারেটিভ’ তৈরি করার একটি সহজ উপায়। সাধারণত একনায়ক বা স্বৈরতান্ত্রিক সরকার তাদের পক্ষে প্রচারণা চালানো জন্য গণমাধ্যমকে (টিভি, রেডিও ও সংবাদপত্র) ব্যবহার করে।
সোশ্যাল মিডিয়া এ ক্ষেত্রে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ক্ষমতাসীন সরকার তাদের পক্ষে প্রচারণা চালানোর জন্য সামাজিক যোগযোগমাধ্যমকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করে থাকে।

সরকার সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে নির্দিষ্ট ও সূক্ষ্মভাবে জনগণের মধ্যে তাদের পক্ষে ‘ন্যারেটিভ’ তৈরি করতে পারে। নির্বাচনের আগে ও পরে সাধারণত শাসক দল এগুলো ব্যবহার করে থাকে।

তাহলে প্রশ্ন তৈরি হয়—ভবিষ্যৎ গণতন্ত্রের জন্য সোশ্যাল মিডিয়া কি আসলেই কোনো ভূমিকা রাখবে?  গানিতস্কি দেখিয়েছেন, আসলে চূড়ান্ত পর্যায়ে সোশ্যাল মিডিয়া কর্তৃত্ববাদী শাসকদেরই সহায়তা করবে।

মিসরে স্বৈরচারী শাসক হোসনি মোবারকের পতনের ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়া বড় ভূমিকা পালন করলেও সেখানে পুনরায় কর্তৃত্ববাদী শাসন জেঁকে বসেছে।

বর্তমান কর্তৃত্ববাদী সরকার সোশ্যাল মিডিয়াকে তাদের পক্ষে ব্যবস্থার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। তুরস্কে দীর্ঘদিন ধরে কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার স্থায়িত্ব লক্ষ্য করা গেছে। এসব দেশে সোশ্যাল মিডিয়া শাসকের পক্ষেই বড় ধরনের সমর্থন জোগাতে সহায়তা করে।
প্রকৃত প্রস্তাবে এখনকার স্বৈর-শাসকেরা বিভিন্ন সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অনেক বেশি অভিযোজনযোগ্য।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্বৈরাচারী শাসকদের সতর্ক অবস্থান তাই গণতন্ত্রের জন্য হুমকি বাড়াবে। শুধু একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নয় মিশ্র গণতন্ত্র রয়েছে এমন অনেক দেশেও এই বৈশিষ্ট্যগুলো লক্ষ্য করা যায়।

এসব দেশে শাসকেরা প্রাথমিকভাবে সোশ্যাল মিডিয়ার ওপর নজর রাখলেও তাঁরা দীর্ঘ সময়ের জন্য সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধ করেন না; বরং সোশ্যাল মিডিয়ার কনটেন্ট ও জনগণের প্রতিক্রিয়া থেকে শাসকেরা তাঁদের কৌশল নির্ধারণ করেন, যা তাঁদের শাসনকে দীর্ঘস্থায়ী করতে সহায়তা করে।

  • মো. শহিদুল ইসলাম গণতন্ত্র ও সুশাসন বিষয়ক গবেষক। পিএইচডি ফেলো, ইউনিভার্সিটি অব ফ্লোরিডা।