গুজরাটের নির্বাচন: তবে কি বিজেপি ভয় পেল...

গুজরাট বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়েছে
ছবি: রয়টার্স

আমার পরিচিত-অপরিচিত সাংবাদিক এবং ভোট-পণ্ডিতেরা, যাঁরা গুজরাট চষে বেড়াচ্ছেন, কাউকেই বলতে শুনলাম না, এবারের ভোট বিজেপির কপালের ভাঁজ গাঢ় করেছে। বরং সবাই খুব জোর দিয়ে বলছেন, আরও পাঁচ বছর রাজ্য শাসনের সিলমোহর বিজেপি নির্বাচন শুরুর আগেই আদায় করে নিয়েছে। ৮ ডিসেম্বরের অপেক্ষা শুধু আনুষ্ঠানিক জয় ঘোষণার জন্য।

অথচ ঠিক পাঁচ বছর আগের বিধানসভা নির্বাচনী চিত্রটি ছিল কত আলাদা! প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তখন মাত্র তিন বছরের পুরোনো। জাতীয় রাজনীতিতে সুনামি ঘটিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন। গুজরাটি জাত্যভিমান চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে সর্বত্র। ‘গুজরাট মডেল’-এর মায়াজাল বিছিয়ে জাদুদণ্ড হাতে ‘আচ্ছে দিন’-এর স্বপ্ন ফেরি করে ক্ষমতাসীন হয়েছেন! অথচ কী আশ্চর্য, বিধানসভায় জেতার প্রশ্নে সেবার তাঁদের বিহ্বল দেখিয়েছিল! কংগ্রেসের প্রচারের জোয়াল কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন রাহুল গান্ধী। সঙ্গী ছিলেন তিন তরুণ তুর্কি হার্দিক প্যাটেল, জিঘ্নেশ মেঘানি ও অল্পেশ ঠাকোর। সাম্রাজ্য ধরে রাখতে জান-প্রাণ এক করে দিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহরা। ১৮২ আসনের মধ্যে ৯৯টি পেয়ে হাঁপ ছেড়েছিল বিজেপি। কংগ্রেস থেমে গিয়েছিল ৭৭-এ। রাজ্যে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর সেই প্রথম বিজেপির এক শর নিচে নামা! ক্ষমতা হারানোর দুই দশক পর কংগ্রেসেরও সেটা ছিল সেরা সংগ্রহ।

তত দিন পর্যন্ত গুজরাটের ভোট-চরিত্র ছিল দ্বিমুখী। এই প্রথম তা ত্রিমুখী। শাসককে প্রবল চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে আম আদমি পার্টি (আপ)। ভোটের পাটিগণিত চিরকাল প্রমাণ করেছে, লড়াই বহুমুখী হলে শাসকের লাভ। কেননা তাতে শাসকবিরোধী ভোট ভাগ হয়। সেই হিসেবে বিজেপির এবার দিবানিদ্রা দেওয়ার কথা! কংগ্রেস হতোদ্যম। হীনবল। অর্থবলেও দরিদ্র। ‘আপ’ হইহল্লা করছে প্রবলভাবে। কিন্তু সাংগঠনিকভাবে অতি দুর্বল। অথচ, কী দেখছে গোটা দেশ? বিজেপি সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়েছে। দিনরাত এক করে ফেলেছেন ভূমিপুত্র নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহ। মুখ্যমন্ত্রীদের লাইন দিয়ে প্রচারে নামানো হয়েছে। বাদ নেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরাও। গুজরাট জিততে এক মাস পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে সংসদের শীতকালীন অধিবেশন। হিমাচল প্রদেশের সঙ্গে একযোগে ভোট না করে প্রধানমন্ত্রীকে প্রকল্প ঘোষণার জন্য বাড়তি সময় দিয়েছে নির্বাচন কমিশন! একমেবাদ্বিতীয়ম প্রধানমন্ত্রী প্রচারের শেষ বেলায় এক দিনে ৫০ কিলোমিটার রোড শো করছেন! এমন দৃশ্য গত আট বছরে কেউ দেখেনি!

তবে কি বিজেপি ভীতিগ্রস্ত? প্রশ্নটি আলোচিত হচ্ছে প্রচারের শেষবেলায় অমিত শাহ কুড়ি বছর আগে ঘটে যাওয়া (বিরোধী বয়ানে পরিকল্পিতভাবে ঘটানো) গুজরাট দাঙ্গার প্রসঙ্গ টেনে আনায়। ভরা জনসভায় তিনি বলেন, ‘কংগ্রেসের আমলে দাঙ্গা ছিল নৈমিত্তিক ব্যাপার। ২০০২ সালে “তাদের উচিত শিক্ষা” দেওয়া হয়েছে। তারপর থেকে তারা সমঝে গেছে। মারদাঙ্গার রাস্তা ছেড়েছে। কুড়ি বছর ধরে গুজরাট তাই চিরশান্তির নিকেতন!’

পোড় খাওয়া রাজনীতিকেরা জানেন, কারও নাম না করেও কীভাবে, কতটুকু বলে বুঝিয়ে দেওয়া যায়, কাকে বা কাদের লক্ষ্য করে কথাটা বলা। এ ক্ষেত্রেও শাহ ‘তাদের’ বলতে কারা, সেই ব্যাখ্যায় যাননি। ‘উচিত শিক্ষা’ কারা পেয়েছে, বলেননি সে কথাও। কিন্তু যখন বলেন, ‘উচিত শিক্ষার’ দরুন কুড়ি বছর গুজরাট দাঙ্গাহীন, কারফিউহীন এবং সেই কৃতিত্ব তাঁদের, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না, তাঁর লক্ষ্য কারা এবং ওই বয়ানের মধ্য দিয়ে ঠিক কোন বার্তা তাঁরা দিতে চাইছেন।

পণ্ডিতি ভাষ্যে, গুজরাটের এবারের লড়াইয়ের আকর্ষণ দ্বিতীয় স্থানাধিকারী ঘিরে। কংগ্রেস না ‘আপ’, আগামী দিনে মোদি-রাজ্যে বিজেপির চ্যালেঞ্জার কে, ভোট পর্বের আলোচনার কেন্দ্রে সেটাই? কিন্তু তা ছাপিয়ে ‘উচিত শিক্ষা’ গোটা দেশকে কত দ্রুত ‘প্রকৃত শিক্ষিত’ করে তোলে, সেটাই হতে চলেছে আগামী দিনের বৃহত্তর আকর্ষণ।

পাশাপাশি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বয়ান এই সত্যও প্রকাশ করে দিল, গুজরাট-দাঙ্গা বাঁধানোর নেপথ্যে কারা ছিল। মুসলমান নিধনযজ্ঞের পুরোহিত কে ছিলেন!

‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ, সবকা বিশ্বাস’-এর বাণী আওড়ানো বিজেপির ধারণা মুসলমানদের প্রতি আদতে ঠিক কী, খোদ প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার তা বুঝিয়ে দিয়েছেন। গুজরাট-দাঙ্গা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘রাস্তাঘাটে কুকুর গাড়িচাপা পড়লেও কষ্ট হয়’। ঝাড়খন্ডে ‘সিএএ-এনআরসি’র বিরোধিতা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘যারা হিংসা ছড়াচ্ছে, আগুন লাগাচ্ছে, তাদের টিভিতে দেখা যাচ্ছে। পোশাক দেখেই বোঝা যায়, তারা কারা!’ 

কেরালার ওয়েনাড থেকে রাহুল গান্ধীর প্রতিদ্বন্দ্বিতার সিদ্ধান্তের পর অমিত শাহ বলেছিলেন, ‘ওখানে গেলে মনে হয় পাকিস্তানে রয়েছি।’ প্রত্যেকবার ভোটের আগে বিজেপি এভাবেই ধর্মীয় মেরুকরণের রাস্তায় হাঁটে। কখনো অযোধ্যার রামমন্দির ও তার রেশ ধরে কাশী-মথুরার ‘শৃঙ্খলমোচন’। কখনো সিএএ, এনআরসি, অনুপ্রবেশ, উইপোকা। কখনো পুলওয়ামা। কখনো গো-মাংস, হিজাব, আজান, লাভ জিহাদ। কখনোবা অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রণয়নের নির্ঘোষ। হিন্দুত্ববাদী আবেগে এভাবে ধুনো দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন আদায় শাসকের তাৎক্ষণিক লক্ষ্য হয়ে উঠেছে। গুজরাটে অমিত শাহর হুংকারও সেই অভ্যাসেরই লক্ষণ।

তবে এই মেরুকরণ স্রেফ গুজরাটজয়ের জন্য মনে করাটা অনুচিত হবে। এ রকম ছোট ছোট লক্ষ্য পূরণের মধ্য দিয়ে ব্যাপকার্থে হিন্দুরাষ্ট্র গঠন এবং সেই সঙ্গে ইতিহাসের বিনির্মাণ সংঘ পরিবারের চূড়ান্ত লক্ষ্য। বিজেপি ধীরে অথচ নিশ্চিতভাবে সেটাই করে চলেছে। প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান করায়ত্ত করছে। সেসবের পুনর্গঠনে দৃঢ়ভাবে উপেক্ষা করছে সব আপত্তি, যা করছে, বুক ফুলিয়ে তা জাহির করছে। ন্যায্য প্রতিপন্ন করছে। লক্ষ করুন, নাথুরাম গডসে নামটি এখন আর ঘৃণার উৎস নয়! বিপুল মানুষের কাছে ওই নাম আজ সম্মানের সঙ্গে উচ্চারিত! একাধিক রাজ্যে গডসের মন্দিরও প্রতিষ্ঠিত! তাঁর জন্মদিন ধুমধাম করে উদ্‌যাপিত হয়! নেতারা প্রকাশ্যে জয়গান করেন! মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ও বিনায়ক দামোদর সাভারকরকে বসানো হচ্ছে এক আসনে। কোনো জড়তা ছাড়াই। স্বাধীনতাসংগ্রামী হিসেবে যেসব নাম এতকাল বিবেচিত হয়নি, ইতিহাস বিনির্মাণের কারণে আজ তাঁরা মহিমান্বিত। পাল্টে দেওয়া হচ্ছে ইতিহাস ও তার ব্যাখ্যা। খলনায়ক করে তোলা হচ্ছে প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকে। দ্বিধাহীন কণ্ঠে গর্বের সঙ্গে শীর্ষ নেতারা জাহির করছেন, দেশের যত নষ্টের গোড়া নেহরু-গান্ধী পরিবার।

গুজরাটে ‘উচিত’ শিক্ষাদানের প্রেক্ষাপট এই আলোতেই বিচার করতে হবে। ইতিহাস বলে, মোদি-শাহদের জীবনে গুজরাট-দাঙ্গা এক ‘কালো’ অধ্যায়। আন্তর্জাতিক দুনিয়াও সেই অধ্যায়ের কড়া সমালোচক। ইতিহাস বিনির্মাণের মধ্য দিয়ে বিজেপির ‘রাম-লক্ষ্মণ জুটি’ সেই অধ্যায়ের ‘কলঙ্ক’ মুছতে আগ্রহী। তা করতে গেলে ওই পর্বকে মহিমান্বিত করা জরুরি। অন্যায়কে ন্যায্য প্রতিপন্ন করে তাকে মহিমান্বিত বা গৌরবান্বিত করার সেই প্রচেষ্টা সর্বস্তরে চলছে। সরকার পরিচালনায় এতকাল যা ছিল অস্বাভাবিক ও ব্যতিক্রমী, ‘উচিত শিক্ষার’ প্রসার, শিক্ষালয়ের বাড়বাড়ন্ত ও তার পাঠ্যক্রমপ্রণেতাদের গৌরবান্বিত করার মধ্য দিয়ে সামাজিক স্তরে সেই মানসিকতার গ্রহণযোগ্যতা আজ স্বাভাবিক করে তোলা হচ্ছে। ‘নতুন ভারতে’ সরকার অনুপ্রাণিত ওই মনোভাব সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়ছে। ক্রমেই তা হয়ে উঠছে স্বাভাবিক ও সর্বজনীন।

পণ্ডিতি ভাষ্যে, গুজরাটের এবারের লড়াইয়ের আকর্ষণ দ্বিতীয় স্থানাধিকারী ঘিরে। কংগ্রেস না ‘আপ’, আগামী দিনে মোদি-রাজ্যে বিজেপির চ্যালেঞ্জার কে, ভোট পর্বের আলোচনার কেন্দ্রে সেটাই? কিন্তু তা ছাপিয়ে ‘উচিত শিক্ষা’ গোটা দেশকে কত দ্রুত ‘প্রকৃত শিক্ষিত’ করে তোলে, সেটাই হতে চলেছে আগামী দিনের বৃহত্তর আকর্ষণ।

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি