শিক্ষা সংস্কার: সতর্ক পরিকল্পনা ও কৌশলগত সিদ্ধান্ত ছাড়া অনিশ্চয়তা থেকেই যাবে

শিক্ষার অধিকার এককালে শুধু একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। শিক্ষা ছিল ইউরোপে যাজকশ্রেণি ও অধিপতিশীল শ্রেণি, আর ভারতে ব্রাহ্মণ ও উচ্চবর্ণের প্রাধান্যপূর্ণ। শ্রমজীবী মানুষের জন্য বিদ্যায়তনিক শিক্ষা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে নিষিদ্ধ ছিল। এই প্রেক্ষাপট আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে শিক্ষার অধিকার আদায় করা একটি দীর্ঘ এবং কঠিন প্রক্রিয়া ছিল।

পৃথিবীর দেশে দেশে গণশিক্ষার প্রচলন বলতে গেলে সাম্প্রতিক। গণশিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় শিক্ষার প্রসার এবং তার ফলস্বরূপ সামাজিক উন্নয়ন ঘটেছে। তবে আজও বিভিন্ন দেশে ও সমাজে শিক্ষার বৈচিত্র্যময়তা এবং বৈষম্য রয়ে গেছে। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা বহুমাত্রিক চাহিদা পূরণের জন্য বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা ধারার প্রচলন দেখা যায়, যেমন বাংলা মাধ্যম, ইংরেজি মাধ্যম, ধর্মীয় শিক্ষা, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা এবং নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর শিক্ষা।

এই বৈচিত্র্যময় চাহিদা পূরণ করার জন্য একটি সর্বজনীন এবং বিস্তৃত শিক্ষাদর্শন তৈরি করা জরুরি। শিক্ষাদর্শনের আলোকে শিক্ষাক্রম পরিচালনা করতে হলে প্রগতিবাদ, অপরিহার্যতাবাদ ও গঠনবাদ কোন উদ্দেশ্য সামনে রেখে কাজ করবে তা স্পষ্ট করতে হবে। প্রগতিবাদ শিক্ষাব্যবস্থাকে পরিবর্তনের দিকে ধাবিত করে, অপরিহার্যতাবাদ মৌলিক ও প্রয়োজনীয় জ্ঞান সরবরাহে জোর দেয় এবং গঠনবাদ শিক্ষার্থীর নিজস্ব চিন্তাভাবনা ও সৃজনশীলতাকে প্রাধান্য দেয়।

আবার শিক্ষা এখন অনেকাংশেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমুখী হয়ে গেছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চাহিদা সামনে রেখে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। যদি আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে আমরা শিক্ষাদর্শন নির্ধারণ করতে ব্যর্থ হই, তাহলে আন্তর্জাতিক মানের দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। শিক্ষা সংস্কারের প্রথম পর্যায়ে সামগ্রিক শিক্ষাদর্শন স্পষ্ট হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষাব্যবস্থার সঠিক উন্নয়নের জন্য একটি স্পষ্ট, বিজ্ঞানভিত্তিক এবং সমাজের প্রয়োজনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ শিক্ষাদর্শন গঠন করতে হবে।

শিক্ষাদর্শন ও শিক্ষাক্রমের অস্বচ্ছতা ব্যক্তির ইচ্ছা এবং মতাদর্শকেন্দ্রিক পাঠ্যপুস্তক লেখার সুযোগ তৈরি করে, যা শিক্ষার গুণগত মানের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। শিক্ষাদর্শন যদি অস্পষ্ট থাকে, তাহলে মানুষের মধ্যে শিক্ষা কার্যক্রমের প্রতি আস্থাহীনতা বৃদ্ধি পাবে। তাই শিক্ষাদর্শনকে কেন্দ্র করে শিক্ষাক্রম নিশ্চিত করা এবং তা যথাযথভাবে বাস্তবায়িত করা অতীব জরুরি।

শিক্ষাক্রম পরিবর্তন একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত, যা শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াটি নিয়ে শুরু থেকেই নানা সমালোচনা ও বিতর্ক দেখা গেছে। নতুন শিক্ষাক্রমের পক্ষে যুক্তি হচ্ছে, এটি শিক্ষার্থীদের যুগোপযোগী এবং দক্ষ করে তুলবে, যা বর্তমান বিশ্বের চাহিদার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। এতে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা এবং সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

তবে বিপক্ষ মতবাদও রয়েছে, নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অবকাঠামো, শিক্ষক প্রশিক্ষণ এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সম্পদের অভাব রয়েছে। এ ছাড়া নতুন শিক্ষাক্রমের কাঠামো ও মূল্যায়নপদ্ধতিতে অসংগতি থাকায় শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা—উভয়েই চাপে রয়েছেন। ফলস্বরূপ, নতুন শিক্ষাক্রম শিক্ষার্থীদের জন্য অনেক ক্ষেত্রে অপ্রস্তুত অবস্থায় এবং বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

নতুন কারিকুলাম প্রণয়নের ক্ষেত্রে বাস্তব পরিস্থিতি ও চাহিদার সঙ্গে এর সামঞ্জস্য যাচাই করতে কার্যকরী পাইলট প্রোগ্রাম বা পরীক্ষামূলক উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এমনকি শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট পক্ষের সঙ্গে পরামর্শ করার বিষয়টিও উপেক্ষিত হয়েছে।

নতুন কারিকুলাম নিয়ে অসন্তোষ এতটাই তীব্র হয়েছে যে এটি শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি আস্থার ঘাটতি তৈরি করেছে। এর ফলে একদিকে যেমন শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিক্ষাজীবন নিয়ে অনিশ্চয়তা ও হতাশা বৃদ্ধি পেয়েছে, অন্যদিকে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে গভীর অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছে।

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর নতুন শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়নযোগ্য কি না, তা নিয়ে আলোচনা আরও তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার এই নতুন শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়নযোগ্যতা নিয়ে সন্দিহান হয়েছে। এ জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখন এই বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করছে। অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ উল্লেখ করেছেন যে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নযোগ্য নয় বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। এ অবস্থায় আগের শিক্ষাক্রমে ফিরে যাওয়ার বিষয়টি ভাবা হচ্ছে। তবে এটি এমনভাবে করা হবে, যাতে যেসব শিক্ষার্থী ইতিমধ্যে নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষা গ্রহণ করছে, তাদের কোনো সমস্যায় পড়তে না হয়। এ জন্য শিক্ষাক্রমে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ও পরিমার্জন করার পরিকল্পনা রয়েছে।

নতুন শিক্ষাক্রমের প্রতি এ ধরনের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া এবং আগের শিক্ষাক্রমে ফিরে যাওয়ার প্রচেষ্টা দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় একটি বড় ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি করতে পারে। সে ক্ষেত্রে শিক্ষাক্রম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত যাতে শিক্ষার্থীদের জন্য অসম্পূর্ণ বা অসুবিধাজনক না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারকে শিক্ষাব্যবস্থার ভবিষ্যৎ উন্নয়নের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গঠন করতে হবে; যাতে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মতামত গুরুত্বসহকারে বিবেচিত হয়। এ ছাড়া যেকোনো পরিবর্তন বাস্তবায়নের আগে একটি পর্যাপ্ত পরীক্ষামূলক বা পাইলট প্রকল্প পরিচালনা করা উচিত, যাতে শিক্ষার্থীদের ওপর তার প্রভাব বিশ্লেষণ করা যায় এবং প্রয়োজনীয় সমন্বয় করা যায়।

নতুন শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়ন নিয়ে চলমান বিতর্ক এবং তার ওপর অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থান বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার ভবিষ্যৎ নিয়ে একধরনের অনিশ্চয়তা এবং শঙ্কার জন্ম দিতে পারে। এটি একটি সংকটময় পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে, যা শিক্ষাব্যবস্থার স্থিতিশীলতা এবং শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মানের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে। তবে সতর্ক পরিকল্পনা ও কৌশলগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে এ সংকটের সমাধান করা সম্ভব। তাই এই পরিবর্তনগুলো বাস্তবায়নের আগে পর্যাপ্ত গবেষণা, অভিজ্ঞতা ও সমন্বয়মূলক চিন্তাভাবনা করা প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রেখে শিক্ষাবিদ ও শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতামত গ্রহণ করে একটি কার্যকর, সর্বজনীন এবং টেকসই শিক্ষাক্রম তৈরির দিকে মনোনিবেশ করা উচিত।

  • সাব্বির আহমেদ চৌধুরী সহকারী অধ্যাপক, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
    ই–মেইল: sabbir.ahmed@du.ac.bd